ছড়ানো ছেটানো উঠোন // পৃথা রায় চৌধুরী

follow-upnews
0 0

রোজ সকাল থেকে তটস্থ হয়ে থাকেন রমা দেবী, কখন আবার অশান্তি পাকিয়ে ওঠে। বাড়ীর বাইরের উঠোনে যে বাসন ধোবার, কাপড় কাচার জন্য কল, তাতেই সকালের ব্রাশ করা, কাপড় কাচা, নিজেদের সারাদিনের বাথরুম ইত্যাদির জল বালতি করে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া, সবই করতে থাকে ওবাড়ির লোকজন। ওবাড়ির লোকজন বলতে তাঁর ছোট দেওর, জা, তাদের দুই ছেলেমেয়ে; এদের ছাড়াও এসব করতে আসে রুমা, তাঁর বড়ো ভাসুরের ছোট ছেলের বউ। এদের কাউকেই ঠিক সহ্য করতে পারে না তাঁর বড়ো বউমা, ছোট বউমার অবশ্য এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। সে দিব্যি রান্নাঘরে সকালের চা বা জলখাবারে তাঁকে সাহায্য করতে করতে জানলা দিয়ে ওদের সাথে গল্প গাছা করে। বড়ো বউমা নিজের ঘরের ভেতর থেকে গজগজ করতে থাকে… “রোজ রোজ মজা পেয়ে গেছে সব। পাম্পের এই কাঁড়ি কাঁড়ি যে বিল আসে, সব এদের জন্য। সকাল থেকে এসব হলো, এরপর একে একে লাইন দিয়ে হাগামোতা, চান করা, সব করতে আসবে একে একে!…” আরও অনেক অনেক কিছুই চলতে থাকে, আর রমা দেবী আরও তটস্থ হয়ে চুপচাপ কাজ করতে থাকেন… এই বুঝি ওদের কেউ শুনে ফেললো, আর শুরু হলো অশান্তি।

বিয়ে হয়ে এসেছিলেন যখন ওবাড়ীতে, সেই প্রায় চল্লিশ বছর আগে, তখন চার ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবার, এক হাঁড়ি। সংসারে সমান সমান টাকা দিতে হতো সব ভাইকে। স্বামী চাকরি করতেন যে জুট মিলে, তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, শুরু করলেন গাঙ্গুরাম মিষ্টির দোকানের সামান্য পয়সার কিছু টাইপ এবং হিসেবের খাতা লেখার চাকরি। শ্বশুর শাশুড়ির ছায়া পাননি, চার ভাই অতি ছেলেবেলাতেই হারিয়েছিলেন তাঁদের। চার ভাইয়ের জন্য সেই বাড়ি তৈরি করে দেন তাঁদের মামা। তারপর থেকে চার ভাইয়ের ঠিকানা ওই বাড়ি। বারো ভুতের অমন একখানা বিশাল বাড়িতে মামারা বানিয়ে দিয়েছিলেন মোটে একখানা বাথরুম। সকাল থেকে উঠে লাইন পড়ে যেতো, কে আগে যাবে। রমা দেবী সাক্ষী আছেন সেই সময়ের নানা ধরনের জ্ঞাতিদের মধ্যে বজ্জাতির। দেখতেন, বড়ো ভাসুর আর বড়ো জায়ের ইচ্ছাকৃত ভাবে পাঁচ ছেলেমেয়েদের নিয়ে একের পর এক বাথরুম আটকে রাখা, নিজের ছোট ছোট দুই ছেলের স্কুল যেতে দেরি হয়ে যাবে ভেবে, অন্ধকার থাকতেই তাদের ঘুম থেকে তুলে তৈরি করে দিতেন। নাহলে এমনও দিন গেছে, ছেলেরা হয় বিনা চানে, না হয় সকালের প্রাতঃকৃত্য না সেরেই স্কুল যেতে হয়েছে। এরই মধ্যে বিশেষ সুবিধে পেতেন মেজো ভাসুর, তিনি বিশাল মাপের চাকরি করতেন, তাঁকে নিতে গাড়ি আসতো রোজ। আর তাই, তাঁর যাবার সময় বাথরুম আটকে রাখার সাহস কেউ করতো না।

রমা দেবী নিজে সেই যুগে দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন নিজের ঠাকুমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও, যদিও শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিক আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি তাঁর। সুউপায়ী পাত্র দেখেই তাঁকে পাত্রস্থ করা হলেও, স্বামীর ছোটখাটো চাকরির সময়ের কিছু কষ্টের দিনও তিনি দেখেছেন। স্বামী, নারায়ণ বাবু এক নিপাট ভালোমানুষ। সুপুরুষ সুভদ্র নারায়ণ বাবুকে নিয়ে তিনি যথেষ্ট গর্ববোধ করতেন। সেই সময় ছোট দেওর, রাম ছিলেন তাঁর পরম বন্ধু। তখনকার দিনে এমন চাকরির আকাল ছিলো না, নারায়ণ বাবুও হাতের নাগালে স্টেট ট্রান্সপোর্টের চাকরি পেয়ে গেছিলেন, কিন্তু সেই হাতে পাওয়া সরকারি চাকরি তিনি পাইয়ে দেন রামকে। রাম চাকরি পেলো, তাকে বিয়ে দেওয়া হল সুন্দরী মধ্যবিত্ত বাড়ীর মেয়ে দেখে, এবং কালে রামের দুই ছেলেমেয়ে হলো। সবই তো তাঁর সামনে। রাম কিন্তু আজীবন দাদাবউদির পাশে দাঁড়িয়েছে নানা বিপদআপদে। এমনও সময় গেছে, নারায়ণ বাবুর হাত একেবারেই খালি, সেই সময় তাঁর ভাগের টাকা মিটিয়েছে রাম। রমা দেবীর নিজের দুই ছেলে, আর তাঁর অদম্য জেদ ছিলো, এদের মানুষ করে তোলার ব্যাপারে। সংসারের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি ছিলই, অথচ তার মাঝে শ্যেনদৃষ্টিতে খেয়াল রাখতেন ছেলেদের পড়ার ওপর। নারায়ণ বাবু ব্যবসা শুরু করলেন সামান্য কিছু পুঁজি দিয়ে, সেসময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাম তাঁকে পার্টি জোগাড় করে দিয়েছে। এই ব্যবসা ক্রমে বেড়েছে, আর স্বল্প পুঁজিতে যেহেতু ব্যবসার কাজে কর্মী নিয়োগ সম্ভব হতো না, তাই তিনি নিজে লেবারের জায়গায় দাঁড়াতেন… স্বামীর ব্যবসাও সামলেছেন এভাবে।

ছেলেরা বড়ো হলো। বড়ো ছেলে চাকরিবাকরি না পেয়ে বাপের ব্যবসায় লাগলো, নিজের পছন্দমতো বিয়ে করলো। চুপচাপ প্রকৃতির স্বামী তাঁর, সেই প্রথম কোনো ব্যাপারে এমন তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর সেই মেয়েকে পছন্দ হয়নি। কিন্তু বড়ো ছেলের সেই এক গোঁ। অশান্তি চরমে ওঠার আগে, লোকজন হাসাহাসি করার আগে তাই তিনি সমস্ত দিক কোনোভাবে সামলে ছেলের বিয়ে দিলেন ওই মেয়ের সাথেই। মেয়ের বাড়ি থেকেও তখনও পর্যন্ত তাঁর ছেলেকে মেনে নেয়নি কেউ। গুণ্ডা পাঠিয়ে ভয় দেখানো পর্যন্ত হয়েছে তাঁর ছেলেকে। পরিত্রাতা রাম। দায়িত্ব নিয়ে সব দিক সামলে নেবে কথা দিলো। ছেলের বিয়ে উৎরে গেল। নতুন বউকে ওই একান্নবর্তী পরিবারে থেকেই যতোটা সম্ভব যত্নে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবুও এর মধ্যেই খাওয়াদাওয়া নিয়ে ‘বড়ো মাছের খানি, মুড়ো… হাড় ছাড়া মাংসের পিস…’ এসব নিয়ে রেষারেষি চলতোই। বিষিয়ে উঠছিল আবহাওয়া। ঠিক হলো অশান্তি ভোগ করার থেকে ভালো পাশের ফাঁকা জমি কিনে নিজেদের থাকার মতো বাড়ি করে নেওয়া হবে। সেই মতো জমি কেনা হলো, বাড়িও উঠলো ধীরে ধীরে, আর ঈর্ষার চোখ দেখতে পেলেন সেই সময়, আদরের ছোট জায়েরও। ঠারেঠোরে নানা বাঁকা কথা সে শুনিয়ে দিতো, অথচ তিনি কিছুই বলতেন না। রামের ছেলেমেয়েদের ভালোবাসতেন নিজের সন্তানের মতোই, মনে মনে আপসোস করতেন এই ভেবে, ওই বাড়ীর কোনো ছেলেমেয়েই পড়াশোনা শিখলো না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেন উনি, ওদের মাঝে থেকেই তিনি দুই ছেলেকেই পড়াশোনা শিখিয়ে নিতে পেরেছেন। বড়ো ছেলে গ্র্যাজুয়েট, ছোট ছেলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। চাকরিও পেয়ে গেছে বেশ বড়ো মাপের। বাড়ি হতেই বড়ো ছেলে, ছেলের বউ আর ছোট ছেলে সেই বাড়িতেই রাত্রে থাকা শুরু করলো, সারাদিন তারা থাকে পুরনো বাড়িতেই, সেখানেই একসাথেই তখনও খাওয়াদাওয়া হয়। এরপর নাতি হলো, ছোট ছেলের বিয়ে দেবার বন্দোবস্ত হলো। মনের মতো মেয়েও পাওয়া গেল। একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হওয়া উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে। অসামান্য রূপ না থাকলেও বেশ একটা শ্রী আছে চেহারায়। এই মেয়ের ছবি দেখেই নারায়ণ বাবু সম্মতি দিয়েছেন, নাতিকে ডেকে দেখিয়েওছেন, “এই দেখ, কাকিমনিকে পছন্দ তো?” নাতিও ঢকঢক করে ঘাড় নেড়ে কাকিমনিকে পছন্দের কথা জানিয়েছে। সেই মতো সব কথা হলো, ছোট ছেলের বিয়েও হলো ধুমধাম করে, আর ছোট বউমা প্রথম পা দিলো তাঁদের এই নতুন বাড়িতেই।

সরল সোজা মেয়েটাকে দেখতেন শাড়ি গুছিয়ে পরতে পারে না, রান্নাবান্না জানে না, কিন্তু শেখার চেষ্টা আছে। রোগা রোগা কাঠামোয় ছোট বউমাকে এদিক সেদিক নেমন্তন্ন রক্ষা করতে হতো প্রায় রোজই ছোট ছেলের সাথে… বিয়ের পর যেমন হয়ে থাকে, আর এবার হিংসের চোখ দেখতে পেলেন তিনি তাঁর বড়ো বউমার। এমনিতেই এই বাড়িতে ওবাড়ির কেউ আসুক, বাথরুম ব্যবহার করুক, তাদের কাপড় কেচে ছাদে মেলুক, বাইরের কলে জল নিক, এসব কিছুই পছন্দ হতো না তার, এবার তাতে যোগ হলো ছোট বউমার প্রতি বিদ্বেষ। অকারণ বিদ্বেষ। আবার সেই ছোট বউমার কানেও শুরু হলো বিষ দেওয়া… ওই বাড়ির সকলে ঠিক কতোটা খারাপ, কতোটা হিংসুটে, এসব বর্ণনা দেওয়া। চোখের সামনে দেখতে লাগলেন মেয়েটা বিষ পেতে পেতে কেমন পালটে যেতে লাগলো। তবুও, মেয়েটার মন অতো নিচু ছিলো না কখনো, এই রক্ষে। মেয়েটাকে দেখতেন, ছেলের জন্য যেসব বড়ো বড়ো জায়গা থেকে ফোন আসতো, কেমন ফরফর করে ইংরেজিতে তাদের সাথে হেসে কথা বলতো, টুকে রাখতো জরুরি কথা। ধীরে ধীরে এই মেয়েকে রান্না শেখাতে লাগলেন, ওবাড়ি থেকে কেউ এলে তাকে চা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতো মেয়েটা, কিন্তু নিজের বড়ো জায়ের তাতেও অসন্তোষ বুঝতো… “চা চিনি কিনতে পয়সা লাগে না? দানছত্র করতে বসেছে যেন।” একদিন সেই মেয়েও মুখ খুললো, তবে রমা দেবীর কাছে, সবার মাঝে নয়… “সংসারে কি তোমার ছোট ছেলে কিছু দেয় না? এই বাড়ি যে তৈরি হয়েছে, তারও তো বেশির ভাগ খরচ তোমার ছোটই করেছে। এ বাড়ীর পাম্পটা পর্যন্ত তার কেনা। তাহলে সারাক্ষণ কিসের কথা শোনায় দিদি?” সে যাত্রা শান্ত করেছিলেন তিনি ছোট বউমাকে। ছোট বউমা বিশেষ এসব নিয়ে মুখ খুলতো না, বড়ো বউমার নানা ধরনের মানসিক অত্যাচারও মুখ বন্ধ করে সহ্য করতো শুধু শাশুড়ির কথা ভেবে, তিনি বোঝেন। তবে ওই মেয়ে অন্যায় সইতে শেখেনি কখনো। চুপ করে সরে আসতো, তিনি দেখতেন। কিন্তু ভয়ে ভয়েও থাকতেন, কখন আবার কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে বসে!

রুমার নামে পাড়ায় প্রচুর বদনাম রটাত সবাই, স্বামী ভালো রোজগার করতো না বলেই তাকে নামতে হয়েছিলো চাকরির বাজারে। গড়িয়াহাটের কোনো দোকানে কাজ পেয়েছিলো সে সেলস গার্লের। সেখানে তাকে যেতে হতো শার্ট প্যান্ট পরে, উগ্র সাজ, চুলের বাহারি কায়দায় তখন তাকে চেনা রুমা মনে হতো না। দরকারে তার কাছে সবাই ফ্রিতে বা কম দামে নানা ধরনের সাজের জিনিষ নিতো, আর পেছনে ওরই নামে বলতো, ‘খদ্দের খুশি করে আসছে… সেলসের কাজ আসলে ওপরে, আসল কাজ শুয়ে পড়া!” এসব শুনতে শুনতে একদিন ছোট বউমা পাড়ার অয়নের মাকে বলেই ফেলেছিলো, “এতোই খারাপ চরিত্র যদি ছোড়দির, তোমরা ওর সাথে কথা বলো কেন? ওর কাছে দিব্যি সুবিধাগুলো তো নাও!” অয়নের মা বেশ আমতা আমতা করেছিলো তারপর। বড়ো বউমা যখন একটু ভালো মেজাজে থাকতো, ছোট বউমার কাছে রুমার সম্পর্কে নানা কথা বলতো, আর তখন তিনি ভয় পেতেন, মেয়ে ঝাঁঝিয়ে প্রতিবাদ না করে ওঠে। অথচ সেসব কিছুই সে করতো না, বরং চোখ গোল গোল করে এমন ভাবে শুনত, যেন কতোই না অবাক হচ্ছে। রোজ সকালে রুমা যখন বাইরের কলে আসতো, সেখানেই দাঁড়িয়ে শ্যাম্পুও করতো প্রায়ই, গা ভিজিয়ে চানটাও সেরে নিতো, একমাত্র তখন রেগে যেতো মেয়েটা। হিসহিস করে একদিন বলে উঠেছিলো… “লাজ লজ্জা কিচ্ছু নেই! একটা হাত কাটা রঙ জ্বলা ফিনফিনে নাইটি, ভেতরে ব্রা প্যান্টি কিচ্ছু পরে না, সেই অবস্থায় রাস্তা ধরে এবাড়ি ওবাড়ি করতে লজ্জা করে না নাকি ছোড়দির? এই জন্যই সবাই এতো কথা বলে ওর নামে! ঠিক করে। অসভ্যের মতো সর্বস্ব দেখাতে দেখাতে আসে যায়! এমন তো নয় যে জামাকাপড় নেই, এদিকে রোজ ছেলের হাতে বিরিয়ানি খাবার পয়সা দিচ্ছে বায়না করলেই! আবার ওই বাইরের কলে ভেজা নাইটিতে চান করতে থাকে। ভেতরে বাথরুমে এসে করলেই তো পারে!” সেদিন উনি প্রমাদ গুনেছিলেন। রেগে গিয়ে এসব যদি রুমাকেই বলে দেয়, তাহলে তো অশান্তির চূড়ান্ত! সেসব আর হয়নি।

ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর আগের মতো হাঁটাচলা করেন না নারায়ণ বাবু। বাড়ীর বাইরের গ্রিল ঘেরা বারান্দায় চেয়ারে তাঁকে বসিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকেই উনি পরিচিতদের সাথে কথাবার্তা বলেন। ভদ্র সজ্জন অমায়িক বলে প্রত্যেকের খুব প্রিয় তিনি। খাওয়াদাওয়ার প্রচুর বাধানিষেধ হয়েছে ইদানীং। এককালে খাইয়ে মানুষ ছিলেন। প্রচুর অনিয়মও হয়েছে এককালে, ব্যবসার কাজ সামলাতে গিয়ে। এখন তারই মাসুল দিচ্ছেন। তাঁর পছন্দের খাবারের মধ্যে কিছু খাবার এখনো তাঁকে দেওয়া যাবে বলে ডাক্তার বলেছেন, কিন্তু সে সব রোজ দিতে হলে ছেলেদেরই বলতে হবে। বড়ো বউমার যা স্বভাব, তাতে হয়তো এসব নিয়েও অশান্তি করবে, খরচের কথা তুলে। তাঁর দুই ছেলেই মা বাবাকে কখনো কোনো অভাব হতে দেয়নি, তাঁদের দরকারের সমস্ত কিছু দুই ভাই এনে দেয়… তাদের মনে সমান সমান ভাগ কেন হবে না, এই ধরনের কথা কখনোই আসে না। কিন্তু বড়ো বউমার কথাগুলোর ওই একই মানে দাঁড়ায়, ছোট বউমা তর্ক করে না অকারণ, চুপ থাকাই ভালো বোঝে। কিন্তু ভেতরে যে তার এসব কথায় রাগ হচ্ছে, তা ভালোই বুঝতে পারেন রমা দেবী, সইতে সইতে এ মেয়ে কোন দিন না ফেটে পড়ে, এই চিন্তা সারাক্ষণ তাঁর মাথায় কুরেকুরে খায়।

“গরম রসগোল্লা খাবেন, সেজকাকা?” রুমার গলা পেলেন রান্নাঘর থেকে। এই রে, সর্বনাশ! বড়ো বউমা ছেলে সমেত বাপের বাড়ি গেছে। থাকলেও এই সময় তাকে নিয়ে কোনো ভয় ছিলো না। ভয় যাকে নিয়ে, সেই মূর্তিমতী বাড়িতেই। এই মেয়ের খুব অপছন্দ কারুর কাছে অকারণে হাত পেতে কিছু নেওয়া। একবার ওঁকে রুমা বলেছিলো কি একটা ভালো ক্রিম এনে দেবে, দাম লাগবে না… জাঁক করে যেই না সেই গল্প করেছেন বাড়িতে, ছোট বউমা কেবল গম্ভীর হয়ে বলেছিলো, “কেন মা? তোমার দুই ছেলে কি তোমাকে কিছু দেয় না?” আর সেই কথায় তাঁর দুই ছেলেই সমর্থন করলো… উনি বাধ্য হয়েছিলেন রুমাকে ক্রিম আনতে নিষেধ করতে। বলেছিলেন, ছোট ছেলে নতুন ক্রিম এনে দিয়েছিলো, সেইই শেষ হয়নি, আরও ক্রিম নিলে সেটা তো পড়েই থাকবে; তার চেয়ে ভালো, লাগলে উনি চেয়ে নেবেন। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন, রুমা সেই জঘন্য নাইটি পরেই গেটের ভেতর চলে এসেছে। পড়িমরি ছুটলেন তিনি রান্নাবান্না ফেলে। যেভাবেই হোক, এই মুহূর্তে আটকাতে হবে সব। ছোট বউমা দেখলে আবার নাহলে এক কেলেঙ্কারি। মেয়েটার চুপ করে সরে যাওয়াকে উনি খুব ভয় পান। সামনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছোবার আগেই উনি দেখলেন, যার ভয় পাচ্ছিলেন, সে নিজে দরজার পাল্লার কাছে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে, দৃষ্টি বাইরের বারান্দায়। ধীরে ধীরে উনি সেদিকে এগোলেন। এবার সামলাতে হবে সব। মেয়ে হয়তো বলে বসবে, ছেলেরা কি গরম রসগোল্লার কথা বললে, এনে দিতো না? দরজার কাছে এসে বাইরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছেন, তাঁকে হাত ধরে আটকে নিলো মেয়েটা। আতঙ্কে তার দিকে চোখ তুললেন… মেয়ে মাথা নেড়ে তাঁকে বারান্দায় যেতে বারণ করছে, মুখে হাসি। মেয়েটা হাসলে চোখ দুটোও হাসে মেয়েটার। আহ, শান্তি! বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, রুমা পরম যত্নে ছোট্ট একটা মাটির ভাঁড় থেকে গরম রসগোল্লা ভেঙে ভেঙে খাইয়ে দিচ্ছে তার সেজো খুড়শ্বশুরকে, ঠোঁটের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়া রস মুছে দিচ্ছে হাতের কোণা দিয়ে। সুখের শ্বাস বুক থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। এইসব মেয়েগুলোই ভাঙ্গা টুকরো কুড়িয়ে গড়ে নেবে আবার সেই একান্নবর্তী।


পৃথা রায় চৌধুরী   পৃথা রায় চৌধুরি

Next Post

শহীদুল আলমের চুলওয়ালা মাথা এবং পাঁচজন টেকো জেলে

শহীদুল আলম একজন কিংবদন্তী ফটোগ্রাফার। আমার এই ‘কিংবদন্তী’ বিষয়টাতে ঘোরতর আপত্তি আছে। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি ভারসাম্যপূর্ণ একটি সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য কী কী করেছেন বা আদৌ কিছু করেছেন কিনা। বর্তমান পৃথিবীতে সবকিছু সিন্ডিকেট, কার জন্য কে বিবৃতি দেবে, কেন দেবে বা আদৌ দেবে কিনা এগুলো সিন্ডিকেট অনুযায়ী চলে। […]
পেকুয়ায় ৭ জেলে