আরনেসট হেমিংওয়ে ‘এ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস’ উপন্যাসে লিখেছেন, “All thinking men are atheists.” এটি নাস্তিকতার অতি সহজিকরণ এবং আস্তিকতাকে এক ঝটকায় অজ্ঞতার দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা। আমি নিজে হেমিংওয়ের এ মতের সাথে একমত নই। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস উভয় ক্ষেত্রেই সন্দেহের একটা দোলাচল থাকে। অনেকে বলেন, যা নেই বা আছে কিনা জানা নেই তা কল্পনায় এনে কবিতা লেখা যায়, কিন্তু মৃত্যুর পরে পাওয়ার লোভে ভাগাড়ের কাক হওয়ার কোনো মানে হয় না।
যা কাল্পনিক তাতো নাস্তিকতারই অপর নাম, তাই কাল্পনিক ‘ঈশ্বর তত্ত্ব’ আস্তিকতার পক্ষে ছাপাই সারটিফিকেট হয় না। যদি বলেন, ঈশ্বর আছেন, তাহলে নাস্তিকেরা বলবে, ঠিক আছে, ঈশ্বর দেখান। আপনি হয়ত বলেবেন, দেখান যে ঈশ্বর নেই। আপনার এ যুক্তি কুট যুক্তি বলে নাস্তিকেরা বরাবরই উড়িয়ে দিয়ে এসেছে। তাদের দাবি, “যা নেই তা দেখানোর কিছু নেই? আপনি শূন্যস্থান দেখাতে বলতে পারেন না।“ আস্তিকেরা যুক্তিতে হেরে গিয়ে অবশেষে বলেছে, “বিশ্বাস নিয়ে বিতর্ক চলে না।“
তাই বলে নাস্তিকতা আবার এমন কিছুও নয় যা ঈশ্বর তত্ত্বর একেবারে বিপরীতে অবস্থান নেয়। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ফরাসি দার্শনিক আল্বেয়ার কামু এক্ষেত্রে চমৎকারভাবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “I do not believe in God and I am not an atheist.” আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না, তাই বলে আমি নাস্তিকও নই।
অনেকেই নাস্তিকতাবাদ বলতে মানবতাবাদ বুঝিয়ে থাকেন। নাস্তিকতাবাদের ব্যবহারিক গুরুত্ব চিন্তা করলে তেমন অর্থ অপ্রসাঙ্গিক হয় না। আমেরিকান ঔপন্যাসিক কুট ভনেগাট এক্ষেত্রে বলেছেন, “মানবিক হওয়ার অর্থ হচ্ছে, মৃত্যুর পরে কোনো পুরস্কার আশা না করা। “অর্থাৎ ঈশ্বর তত্ত্বকে উড়িয়ে না দিয়ে নাস্তিকতাবাদকে তিনি মানবতাবাদের আলোকে দেখাতে চেয়েছেন। ঈশ্বর থাকে থাকুক, তাই বলে সে যেন মহাজনের মতো হাতে সব ধন সম্পদ নিয়ে বসে না থাকে, আমি যেন বিশ্বাস করতে গিয়ে সবকিছু চেয়ে না বসি। ভনেগাটের বক্তব্যর মূলভাবটি এমনই।
ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে নাস্তিকতাবাদের সম্পর্ক যারা খুঁজতে চান (যদিও ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং নাস্তিকতা এক জিনিস নয়) তাদের জন্য আমেরিকান দার্শনিক থমাস জেফারসনের দারুণ একটি বক্তব্য রয়েছে। তিনি বলেছেন, “আমার প্রতিবেশি যদি বলে ঈশ্বর নেই বা বিশটা ঈশ্বর আছে তাতে আমার পকেট মার হয়ে যায় না, বা তাতে আমার হাত পাও ভাঙ্গে না।” জেফারসন এক্ষেত্রে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসকে বিভক্ত করে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি বলতে চেয়েছেন, আস্তিকতা বা নাস্তিকতা ব্যক্তির নিজস্ব বিষয় এতে অপরের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
মৃত্যুর সাথে ঈশ্বর তত্ত্বের যতটা সম্পর্ক রয়েছে, নাস্তিকতার সাথে মৃত্যুর সম্পর্ক ততটা প্রবল নয়। অনেক দার্শনিক নাস্তিকতাবাদকে একটি স্বাধীন চলক হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু ‘ঈশ্বর তত্ত্ব’ একটি নির্ভরশীল চালক, যা মৃত্যু নামক স্বাধীন চলকের ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ মৃত্যু ঈশ্বরের চেয়েও শক্তিশালী। বলা যায়— মৃত্যুই ঈশ্বর। তবে মৃত্যুর বিপরীতে মানুষের চিরন্তন অস্তিত্বের ঘোষণাও আছে। ষোড়শ শতকের ইংরেজি কবি John Donne তার ‘মৃত্যু তুমি গর্বিত হইয়ো না’ নামক কবিতায় ‘মৃত্যুকে’ personify করে বলেছেন, “তুমি আমাকে মারতে পারো না, বরং তুমি নিজেই মরে যাও।“ তিনি বলতে চেয়েছেন, একজন ভালো খ্রিস্টান (মানুষ) আবার জেগে উঠবে এবং চিরন্তনভাবে বাঁচবে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন কবিতাটিতে পুনর্জন্মের ইঙ্গিত রয়েছে, অনেকে বলেন, তিনি খ্রিষ্টধর্মের চূড়ান্ত তত্ত্ব কবিতাটিতে তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ মৃত্যুকে ঘিরে মানুষের মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, যে বেদনা তৈরি হয় সেখান থেকে মানুষকে বের করে আনার চেষ্টা কবিতাটি রয়েছে। যেটা মনে হয়, ঈশ্বর তত্ত্ব মেনে নিয়েই তিনি সেটি করতে চেয়েছেন।
অনেক দার্শনিক রয়েছেন, যারা এতটা নরম ভাষায় বিষয়টির সুরুহা করতে চাননি। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, আস্তিকতা অসভ্যতা এবং বর্বরতাকে উস্কে দেয় কিনা। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার সরাসরি বলেছেন, যে তোমাকে অযৌক্তিক কিছু বিশ্বাস করাতে পারে, সে তোমাকে দিয়ে অসভ্য কোনো কাজ করাতেও পারে। নিতসে খুব মারাত্মকভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন, “After coming into contact with a religious man I always feel I must wash my hands.” তিনি প্রচলিত ধর্ম এবং আস্তিকতার সাথে বর্বরতার এবং ঘৃণা-বিদ্বেষের সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন।
দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি এবং সাহিত্যকদের এত এত অকাট্য যুক্তির পরও ‘ঈশ্বর তত্ত্ব’ পুরোপুরি খারিজ হয়ে যায় না। ধর্ম ব্যবসায়ী এবং স্বর্গ লোভীদের ঈশ্বর মৃত ঈশ্বর। নাস্তিকতা নয়, ধর্ম ব্যবসায়ী এবং লোভী শয়তানের ঈশ্বরই আস্তিকতার সবচেয়ে বড় শত্রু। নাস্তিকতের সাথে আস্তিকের কোনো সংঘাত নেই, ঈশ্বরের শত্রু আরেক ঈশ্বর, যে ঈশ্বরের দখল নিয়েছে ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিকেরা। এত কিছুর পরেও স্বান্তনার এক ঈশ্বর বেঁচে আছেন আর্ত-পীড়িতজনের জীবন এবং জীবিকার সংগ্রামে দৈনিক তৈরি হওয়া ক্ষতে প্রলেপ বুলাতে। ঈশ্বর বেঁচে আছেন দার্শনিকের চিন্তার অসীমতার মাঝে একটি সীমা রেখা টেনে দিতে। রবীন্দ্র দর্শনের বিপরীতে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করে বলতে পারি, ঈশ্বর সীমার মাঝে অসীম নয়; মানব জীবনের ঈশ্বর বিশাল এক শূন্যতার মাঝে একটি বৃত্ত বৈ কিছু নয়।
ঈশ্বর বৃত্তের মাঝে না গিয়ে শূন্যতার মাঝে ভেসে বেড়ানোর ঝুঁকি যদি কেউ নেয় তার দিকে অবাক বিস্ময়ে আমি তাকাতে পারি, কিন্তু নাস্তিক আখ্যা দিয়ে আমার চেয়ে সাহসী, আমার চেয়ে নিঃস্বার্থ একজন মানুষকে ঘৃণা করতে চাইব আমি কীসের বলে?