Headlines

ধারাবাহিক উপন্যাস: বিচারক // দিব্যেন্দু দ্বীপ

উপন্যাস

এক ভিক্ষুক মা তার পাঁচ বছরের সন্তান নিয়ে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে। মায়ের একটা হাত নেই। মেয়েরও একটা হাত নেই। পাষণ্ড বাবা মা মেয়ের হাত কেটে ফেলে এখন পলাতক আছে। মায়ের বাম হাত নেই, মেয়ের নেই ডান হাত। মেয়ের বয়স ছয় বছর, এই বয়সেই একটা গাট্টি তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। মায়ের পিঠেও একটি বোঝা বিশেষ কায়দায় ঝোলানো, কাটা হাত দিয়ে ওটি সামলায়, ডান হাত দিয়ে ভিক্ষা করে। বছর খানেক আগে ঢাকার এক বস্তিতে থাকতো মা মেয়ে, কিন্তু সেখানে মা-মেয়ে দু’জনকেই নাজেহাল হতে হয়। সুমি দেখতে সুন্দর, যুবতী, এক হাত না থাকাতে অসভ্যদের আরও সুবিধা হয়েছে। কোনোভাবেই পেরে না উঠে সুমী মেয়েকে নিয়ে এই যাযাবর জীবন বেছে নিয়েছে।

স্বাভাবিকভাবে কেউ ভাবতে পারবে— একটা মানুষ সচেতনভাবে না খেয়ে জীর্ণশীর্ণ হতে চেষ্টা করছে? কালিঝুলি মেখে কুৎসিত হয়ে থাকে সুমী, যাতে কোনো পুরুষের চোখ না পড়ে। মেয়েটাকে ইচ্ছে করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে। তাহলে যে ভিক্ষুক মনে হবে না, এজন্য মেয়েটাকে একটা ছেঁড়া জামা পরিয়ে দেয়। হাঁটার সময় কেয়া কাটা হাতটা ইচ্ছে করেই বেশি করে নাড়ায়, এটা যেন ওর কাছে একটা খেলা। তাকালে খুবই মায়াবী লাগে ওকে। ওরা আজকে আছে যশোর রেল স্টেশনে। সুমী চায় মেয়েটাকে লেখাপড়া করাতে, নিজের যেহেতু কিছুটা শিক্ষা আছে, সেটুকু সম্বল করে রোজ নিয়ম করে মেয়েকে নিয়ে পড়তে বসে। আজকেও স্টেশনে একটা কোণায় গিয়ে একটা ল্যামপোস্টের আলোর নিচে পড়তে বসেছে। মেয়েকে পড়াতে পড়াতে সুমীর নিজেরও পড়াশুনা করতে ইচ্ছে করে। স্টেশনের ফুটপাতে বইয়ের দোকান আছে, সুমীর কয়েকটা বই কিনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজকে হবে না, হাতে মাত্র রাতে খাওয়ার টাকাটা আছে। খাবার খায় মা-মেয়ে খুব হিসেব করে, এতটুকু মেয়েও বুঝে নিয়েছে তাদের জীবন। কোনো অভিযোগ নেই, কান্নাকাটি বা বায়না নেই! শৈশব ওর শুধু বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

নয়টার ট্রেন এসে পড়েছে। দ্রুত মা মেয়ে পোটলা পুঁটলি গুছিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। পোটলা দু’টো দুই বগির মাঝখানে রেখে মা মেয়ে আলাদা হয়ে দুই দিকে চলে যায় ভিক্ষা করতে, কিছুক্ষণ পরে আবার তারা মাঝখানে এসে একত্রিত হয়। সুমী মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে রাখে অনেকক্ষণ। এরপর মেয়ের কাছ থেকে টাকাগুলো বুঝে নেয়। কেয়া ভিক্ষা করে যা পায় সেগুলো সুমি জমিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু কার কাছে জমাবে? এ জীবন কাকেই বা জানাবে? কিছুদিন আগে একটা দোকানের পাশে বসেছিলো তখন মোবাইলে টাকা রাখার বুদ্ধিটি মাথায় এসেছে। এজন্য প্রথমে একটি মোবাইল কিনতে হবে।

ওরা সারাক্ষণ ভিক্ষা করে না। সুমি মেয়ের সাথে গল্প করে, পুরনো পত্রিকা থেকে মেয়েকে ছবি দেখায়। পড়াশুনা করে কত বড় হওয়া যায়, মেয়েকে এটা বোঝাতে চায়। মা-মেয়ে বাদাম খেতে খেতে পৌঁছে যায় খুলনা স্টেশনে। কোথাও গিয়েই ওরা আরও ভাসমান মানুষ কোথায় আছে খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। তারপর তাদের কাছাকাছি তাবুটা খাটায়। ওদের সংগামের সবটুকু না দেখলে বোঝা কঠিন। এইটুকু মেয়ে বাথরুম চেপে রাখে, এক হাত দিয়ে সবকিছু করতে চেষ্টা করে। মায়ের কারণে মেয়েটারও একটা রুচিবোধ তৈরি হচ্ছে দিনদিন।

কলা পাউরুটি দিয়ে ওরা রাতের খাওয়াটা সারে। মেয়েকে একটা সেদ্ধ ডিম কিনে খাওয়ায়। কাটা হাত আর ছেড়া জামার কারণেই মেয়েটাকে যা একটু ভিক্ষুক মনে হয়, খুবই মিষ্টি চেহারা ওর। ভিক্ষায় বের হলে কেয়াই বেশি পায় মায়ের চাইতে। শিশুটিকে দেখলেই যে কারো মায়া তৈরি হয় মনে।

খুলনা রেল স্টেশনটা অনেক বড়, কিন্তু তাঁবু খাটানোর মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না সুমী। অবশেষে একটা দাঁড়িয়ে থাকা মাল গাড়ির আড়ালে তাঁবু খাটায়। তাঁবুটা অনেকটা ট্যুরিস্টদের তাঁবুর মতো। কমলাপুর রেলস্টেশনে থাকতে একটা দাতব্য গ্রুপ তাঁবুটা তৈরি করে দিয়েছিলো। এটা যে কতটা কাজের হয়েছে!

আজকের মতো ভরসা হচ্ছে— পাশেই আরেকটা দম্পতি আশ্রয় নিয়েছে, কিন্তু রাত যত বাড়ছে পুরুষটার ওপর সুমীর সন্দেহ তত বাড়ছে। মহিলাটা মরার মতো পড়ে আছে, আর পুরুষটা বারে বারে সুমীদের তাবুর পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করছে। একবার এসে একটা ম্যাচ খোঁজ করে গেছে। কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে, সুমীর খুব ভয় করছে।

তাবুর জানালা থেকে উঁকি দিয়ে দেখে কয়েকটা ছেলে মাল গাড়ীর ওপর বসে গাজা টানছে। সুমী এ ধরনের ছেলেদের আগে থেকেই চেনে, এরা বেশিরভাগ খারাপ হয় না, বরং হেল্প করে। সুমী বেরিয়ে গিয়ে ওদের কাছে গাজা খেতে চায়। ছেলেগুলো প্রথমে একটু অবাক হয়, একটু ধাতস্থ হয়ে একটা স্টিক ধরিয়ে সুমীর হাতে দেয়। সুমী লোকটাকে বুঝাতে চেয়েছে যে, ছেলেগুলো তার পরিচিত। এরপর তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে লোকটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে গাজা টানতে থাকে। লোকটা সত্যিই ভয় পেয়ে যায়, এবং সারারাতে আর কোনো ডিস্টার্ব করে না।

মা মেয়েকে খুব সকালে উঠতে হয়, পানির উৎস খুঁজে বের করে প্রাতকর্ম সারতে হয়। কখনো কখনো স্টেশনের টয়লেট ব্যবহার করতে পারে ওরা। কঠিন সংগ্রামের জীবন, তবু কোথায় যেন স্বস্তি, স্বাধীনতা। সুমী মেয়েটাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে, মেয়েটাকে পড়াতে চায়। নিজেও সে পড়তে শুরু করেছে। একটা বই কেউ হয়ত ফেলে গিয়েছে ভুলে, বইটার নাম— ‘ছোটদের হেলেন কেলার’, কাল রাতে বইটা পেয়ে সুমী পরম যত্নে পোটলা বন্দী করে রেখেছে।

ওরা সাধারণত খুব সকালে খেয়ে নেয়। স্টেশনের আশেপাশেই ছাপড়া ঘরে নিম্নমানের অনেক রেস্টুরেন্ট থাকে, যেখানে সাধারণত রিক্সালা এবং শ্রমজীবী মানুষেরা খায়। এরকম কোনো জায়গায় মা-মেয়ে ডিম ভাজি, ডাল এবং আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খায়, বলতে গেলে এটা তাদের রুটিন খাবার। খাওয়ার পর ওরা আবার তাঁবুতে ফিরে যায়। বইটা বের করে সুমী জোরে জোরে মেয়েকে দুই পৃষ্ঠা পড়ে শোনায়। নিজেও চমকিত হয়। কিন্তু এখন আর হাতে বেশি সময় নেই। স্টেশন জমজমাট হতে শুরু করেছে, এখনই ভিক্ষা করতে বের হতে হবে।

সুমী মেয়েকে বলে, মা, আজকে আর আমরা ট্রেনে উঠবো না, সারারাত স্টেশনেই ভিক্ষা করবো। কেয়া মাথা নেড়ে সায় দেয়। কেয়া খুব উৎসাহ নিয়ে ভিক্ষা করে— কাটা হাতটা নাড়াতে থাকে, এবং মুখে কোনো কথা না বলে বাম হাতটা তুলে ধরে লোকেদের সামনে। আগে শুধু ও পরিপাটি ভদ্রলোক দেখে হাত পাততো, কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে যে, কে ভিক্ষা দেবে, এটা একেবারেই অনিশ্চিত। এখন তাই ও সবার কাছে হাত পাতে।

খুব শোরগোল করে হীরার নেতৃত্বে স্টেশনে একটা ট্যুর গ্রুপ ঢুকছিলো, কেয়া ওদের পথ আগলে হাত পাতে। কেয়ার কাটা হাতটার দিকে তাকিয়ে হীরার খুব মায়া হয়। কেয়া একজনের হাতে থাকা তাঁবুটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে তোমরাও তাঁবুতে থাকো? তাঁবুতে লেখা ‘হোন্ডা’ শব্দটি বানান করে পড়ে ও। কীভেবে হীরা খুব বিগলিত হয়, এবং পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে শিশুটির হাতে গুঁজে দেয়। কেয়া আর দাঁড়ায় না, দিগ্বিদিক হয়ে ওর মাকে খুঁজতে থাকে। খুঁজে পেয়ে মাকে বলে, দেখো মা, এক আঙ্কেল আমাকে কত বড় একটা টাকা দিয়েছে! সুমীও খুব বিস্মিত হয়। এক হাজার টাকার কল্যাণে সারাদিন শেষে মা-মেয়ের উপার্জণ দাঁড়িয়েছে প্রায় চব্বিশ শো টাকা।

অনেকদিন ধরে সুমী একটা মোবাইল কেনার কথা ভাবছে, কালকে কিনতে চায়। আজকে একই জায়গাতেই রাত কাটাবে কিনা সুমী বুঝতে পারছে না। পাথর ভরা মালগাড়ীটা এখনো আছে। তাঁবুটাও কালকে থেকে সেভাবে খাটানো। কালকের সেই ধামড়া লোকটা এবং মহিলাটা আজকে আর নেই। লোকটা ডিস্টার্ব করলেও একইসাথে ওদের জন্য একটা নিরাপত্তাবোধও তৈরি হয়েছিলো। মেয়েকে খাইয়ে নিয়ে সুমী তাঁবুতে ফেরে, রাত বাড়ার সাথে সাথে ভয়ও বাড়তে থাকে। কালকের ঐ গাঞ্জুটে ছেলেগুলো আজ আসবে কিনা কে জানে। সুমী অবচেতনে ওদের জন্যই অপেক্ষা করতে থাকে। নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পঁচিশ বছর বয়সে নিজের ওপর শতভাগ অত্যাচার অবহেলা করেও খেয়ালী যৌবনটুকু সম্পূর্ণ বিদায় দিতে পারেনি, মন থেকে পারলেও শরীর মাঝে মাঝে জেগে ওঠে।

সময় দেখে চলার সুযোগ নেই, স্টেশনের ঘড়িতে দেখে এসেছে এগারোটা বাজে। ছেলেগুলো আজকে বোধহয় আর আসবে না। ক্লান্ত শরীরে কেয়া দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে। ভয়ে ভয়ে সুমী তাঁবুর ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। সত্যিই ছেলেগুলো আজও এসেছে। সুমী আলতো করে তাঁবুটা তুলে বের হয়ে আসে। ওদের কাছে এসেই সুমী জড়তাহীনভাবে বলে, আমি তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ছেলেগুলো রূপশা নদীর পাড়ে একটা স মিলে কাজ করে। ওদের একজনের নাম দবির, বয়স উনিশ-বিশ হবে। দবির সুমীকে আপা সম্মোধন করে বলে, আপনি আজকে আমাদের সাথে বসে খান। সুমী কোনো দ্বিধা না করে বসে পড়ে। গাজার স্টিক হাত ঘুরে ঘুরে আসছে সুমীর হাতে। সুমী অনেকদিন অনভ্যস্ত হলেও একেবারে নয়, ডাকাত স্বামী ঘরে বসেই বানিয়ে খেত, সুমীকেও খেতে বলতো, তখন সুমী টানতে শিখেছিলো। কিন্তু সবসময় নেশা দ্রব্য ও ঘৃণা করে এসেছে। স্বামীর কারণেই যারা নেশা করে তাদের মন্দ লোক মনে হত সবসময়। কিন্তু এক বছরের এই ভিখারি জীবনে দেখেছে যে, ভালোমন্দের বিচার এভাবে হয় না। নেশা নেশাই, ভালো লোকেও নেশা করে। নেশার সাথে ভালোমন্দের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং নেশার জগতে মন খোলা মানুষই বোধহয় বেশি।

সুমীর মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে, কেমন যেন একটু এলোমেলো লাগছে। দবির সবাইকে বলে, আমরা না হয় আজকে এখানেই থেকে যাই, আপা একা একা থাকবে! সাব্বির টিপ্পনী কেটে বলে, বেশি মায়া লাগলে তুই থাক। ইতোমধ্যে সুমীর সাথে দবিরের কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছে। ওরা সবাই চলে গেলে সুমী তাঁবুতে ফেরে না, ঐ মালগাড়ীর ওপর বসে থাকে। কিছুক্ষণ পরেই দবির ফিরে আসে। কোনো কথা না বলে সুমীর সামনে দাঁড়ায়। দবির কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। সুমী একটা গালি দিয়ে বলে, নারীকে বুঝতে পারিস না, কোনোদিন যাসনি কারো কাছে? দবির বরফের স্তুপ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতে সঁপে দেয় নিজেকে।

সুমী হাত-পা ছেড়ে শুয়ে থাকে, কোনো কথা বলে না। হঠাৎ সুমীর কাটা হাতটা দবিরের চোখে পড়ে। দবির খুব ভয় পেয়ে যায়। সুমীকে কিছু না বলে চলে যায় ওখান থেকে। সুমী চোখ মেলে দবিরকে খোঁজে না, কাটা হাতটা সামলে দৌঁড়ে যায় মেয়ের কাছে। কেয়া তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে।

আনোয়ার বছর তিনেক আগে বেপরোয়াভাবে স্ত্রী এবং সন্তানের হাত কেটে নেওয়ার পর প্রথমে পালিয়ে যায় কক্সবাজারের রামু। ওখানে কিছুদিন পালিয়ে থাকার পর রাঙ্গামাটির সুবলং-এ একটি কাঠ পাচার চক্রের সাথে ভীড়ে যায়। এদিকে সুমীর পক্ষ থেকে মামলার কোনো তদবির না হওয়ায় পুলিশ এক সময় হাল ছেড়ে দেয়।

সদ্য সুবলং-এ আনোয়ার একটা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি। কাঠ পাচারকারী দলের এক সদস্যকে পাহাড়ের ওপর থেকে ঠেলে ফেলে দেয়। সবাই জানে সাইফুল কাঠ সরাতে গিয়ে পড়ে মারা গিয়েছে। কাঠ পাচার বনবিভাগের সদস্যদের সাথে যোগশাযোশে হয়, তাই এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আর উচ্চবাচ্চ করে না। ঘটনাটা একেবারে চাপা পড়ে যায়।

সাইফুলকে হত্যা করার নৈপথ্যে রয়েছে সাইফুলের স্ত্রী বিথি আক্তারও। বিথি আনোয়ারের চেয়ে কমপক্ষে পনেরো বছরের ছোট, কিন্তু আনোয়ারের আসুরিক শক্তি এবং বাটপাড়ির ফাঁদে পড়ে স্বামীকে মেরে আনোয়ারের সাথে থাকার ফন্দি করে। আনোয়ারও সেইমতো সাইফুলকে পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দেয়। হত্যার কৌশলটা বের করে আনোয়ার বিথিকে প্রস্তাব দিয়েছিলো। বিথি সেদিন অনেক কান্না করে, কিন্তু আনোয়ারকে হত্যা করতে নিষেধ করে না। আনোয়ার বিথির কাছে আরেকবার সেদিন শক্তির পরিচয় দিয়ে হত্যার নীরব অনুমতি আদায় করে নেয়।

কিছুদিন না যেতেই আনোয়ারের সাথে বিথির কলহ শুরু হয়ে যায়। ব্যাংকে সাইফুলের কিছু টাকার খোঁজ পায় আনোয়ার, বিথি একাউন্টের নমিনি। এটা জানতে পেরে বিথিকে টাকা তুলে দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। মারধর শুরু করে। এর মধ্যে দুই মাস না যেতেই বিথি গর্ভবতী। আনোয়ার এই নিয়ে বিথিকে নানান কথা শোনায়। আনোয়ারের কথা এই বাচ্চা তার না। এক রাত্রে বিথি আনোয়ারের দিকে বটি ছুড়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে, তুই আমার স্বামীকে মেরেছিস, এখন সন্তানও মারতে চাস! মুহূর্তেই বিথি এবং তার পেটের সন্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। আনোয়ার ঐ বটি দিয়ে বিথিকে জবাই করে হত্যা করে। প্রথমে লাশ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে লাশ গুম করে।
আনোয়ার শুভলংএ মফিজুল নাম নিয়ে কাজ করছিলো এতদিন। এলাকার সবাই তাকে এই নামেই চেনে, এবং খুব মিশুক এবং সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জানে। আনোয়ার এলাকায় একটি খবর ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তার এক বন্ধুর সাহায্য নেয়। মনিরকে বলে, সে আজ খুব ভোরে বিথিকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি ভোলায় চলে যাবে। বিথি গর্ভবতী, এখানে তাকে দেখার কেউ নেই। বিথি ছিলো মূলত রোহিঙ্গা, এখানে তার কোনো ঠিকুজি ছিলো না। সাইফুল তাকে বিয়ে করে ঠিকানা দিয়েছিলে। ভালোবেসে অনেক কষ্ট করে ভোটার আইডি কার্ডও বানিয়ে দিয়েছিলো। আলামত নষ্ট করার জন্য বিথির সবকিছু দুইদিন ধরে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় মাটি খুড়ে পুঁতে ফেলে আনোয়ার।
আজকে গভীর রাতে আনোয়ার রওনা হয়ে যাবে মহেশখালীর উদ্দেশ্যে। যাওয়ার সময় একটি ব্যাগে নিজের জিনিসপত্রগুলো শুধু নিয়ে যায়, খাট এবং একটি আলনা খুপড়ি ঘরে পড়ে থাকে। পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গা দখল করে রাঙ্গামাটির এক নেতা এরকম অনেক খুপড়ি বানিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বাঙ্গালীদের কাছে ভাড়া দিয়েছে। যদিও ভাড়ার বিষয়টি অজ্ঞাত। যারা ভাড়া থাকে তারা এটি বলে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সব জেনেও না জানার মতো থাকে। “মানবিক কারণে উঠিয়ে দেওয়া যায় না” এরকম একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙ্গালীদের পাহাড় দখলের বিষয়টা এখন।
একটা খুপড়ি থেকে আরেকটা খুপড়ির দূরত্ব অনেক। রইসুল সাহেব ভাড়া নিতে আসে না, টাকা তোলা এবং তাকে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য লোক ঠিক করা আছে। হাসানের কাছে আনোয়ার রাতেই এক মাসের ভাড়া দিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার ঘটনা খুলে বলে। হাসান টাকা পেয়ে খুশি, খাট এবং একটি আলনা রেখে যাচ্ছে জেনে আরো খুশি। বিথিকে বিয়ে করার পর থেকে আনোয়ার পর্দা করায়। পর্দাণশীন গর্ভবতী স্ত্রীকে কেউ আর দেখতে চায় না। অবশেষে আনোয়ার ওরফে মফিজুল নিরাপদে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এলাকায় খবরটি জানাজানি হলে মানুষ ‘মফিজুলের জন্য শুধু চোখের পানি ফেলতে বাকী রাখে।’ বিথির জন্য কারো কোনো সমবেদনা নেই, বিথিকে সবাই চরিত্রহীন, ঘরহীন রোহিঙ্গা হিসেবে জানে। মফিজুল সাইফুলের বিধবা স্ত্রী বিথিকে বিয়ে করেছিলো বলে মফিজুলের প্রতি সবার সিমপ্যাথি। মফিজুল ধার্মিকও ছিলো খুব। নামাজের ওয়াক্ত কখনো মিস করে নাই। বিথিকে নিয়ে বের হলে বোরখার পাশাপাশি হাতে পায়ে মোজা পরিয়ে নিয়ে বের হত। এলাকার লোক এখন হায়! হায়! করে— কত পরহেজগার লোক ছিলো, হঠাৎ করে লোকটা চলে গেলো!

পথে পথে জীবন, আনন্দ, বেদনা এবং অভিজ্ঞতার এক মহাকাব্য। সুমী আজকেই রওনা হতে চায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। রেল স্টেশনের অদূরে একটি মজা পুকুরে মা মেয়ে দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে গোসল সেরে নেয়। এরকম সুযোগ পেলে সুমী কেয়াকে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করে। কেয়া পুকুরের সিঁড়ির আশপাশ দিয়ে ভয়ে ভয়ে সাঁতার কাটছে। সুমী তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। চারপাশে লোকজন, কাপড় বদলাতে একটু সংকোচ হলেও কিছু করার নেই, এটাই তাদের জীবন। অভ্যাস এবং বাধ্যবাধকতায় মানুষের একসময় সবকিছু সয়ে যায়, যার সয় না তার জন্য টিকে থাকা কঠিন। তাঁবুতে ফিরে দ্রুত গোছগাছ করে রওনা হতে হবে।
ঢাকার উদ্দেশ্যে খুলনা থেকে ট্রেন ছেড়ে যাবে ///// টায়। ভিখিরি ওরা, তাই টিকিট কাটার কোনো বিষয় নেই, মা-মেয়ে কাটা হাত দোলাতে দোলাতে উঠে পড়ে ট্রেনে। পোটলা দু’টো দুই বগির মাঝখানে রেখে ওরা ভিক্ষা করতে বের হয়। মাঝে মাঝে ফিরে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। মা-মেয়ে হাসাহাসি এবং খুনসুটিতে মেতে ওঠে। সুমী সবসময় ট্রেনের মাঝখানের কোনো একটা বগিতে আশ্রয় নেয়, যাতে মা-মেয়ে দুইদিকে গিয়ে সমানভাবে ভিক্ষা করতে পারে।
ভিক্ষা করতে গিয়ে এ অভিজ্ঞতা সুমীর আগেও হয়েছে। কিছু পণ্ডিত আছে একটু কম বয়সী ভিক্ষুক পেলে যারা খুব ভাব নিয়ে বলে, কাজ দিলে কাজ করবা? আজও এরকম একজন ভদ্রলোক সুমীর কপালে পড়েছে। সুমী একবাক্যে কাজ করতে রাজি হয়ে যায়, যদিও ছোট বাচ্চা এবং কাটা হাত নিয়ে বাসায় কাজ করার এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা তার আগেই হয়েছে। লোকটির এতক্ষণ হয়ত সুমীর কাটা হাতটা চোখে পড়েনি। সুমী কাটা হাতটা সামনে এনে বলে, আমার একটা হাত কাটা এবং আমার একটি সাত বছরের মেয়ে আছে, এই অবস্থায় কেউ কাজে নিলে আমি করব। লোকটি একটু থতমত খায়। একটু ধাতস্থ হয়ে বলে, না, আমার তো লোক লাগবে না, কারো প্রয়োজন হলে আমি তোমাকে জানাবো। তোমার মোবাইল নম্বর আছে? সুমী মাথা নেড়ে ‘না’ সূচক জবাব দিয়ে ভিক্ষায় মন দেয়। লোকটা এতক্ষণ ফাও কথা বলে সময় নষ্ট করলেও ভিক্ষা কিছু দেয় না। অন্যদিকে ফিরে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্যুটপ্যান্ট পরা এ লোকটির পাশে বসা ছিলো জমির নামের এক বাউল শিল্পী। সামার্থ না থাকলেও এই লোকটিকে একটা পরোক্ষ জবাব দিতে সুমীকে ডেকে ওর হাতে বিশটা টাকা দেয়। ভদ্রলোকটি আড়চোখে দেখে একটু মোচড় খেয়ে আবার মোবাইলে মনোযোগী হয়।
দুই ঘণ্টা এক নাগাড়ে বগিতে বগিতে ভিক্ষা করে সুমী এখন বেশ ক্লান্ত। ফিরে এসে পুটলির উপর হেলান দিয়ে বসে পড়ে। কেয়া এখনো ফেরেনি। ওরা ক্লান্তি নেই, সব বগি শেষ না করে ফিরবে বলে মনে হয় না।
ঘণ্টা খানেক পরে কেয়া ফিরে আসে। খুব উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে ওকে। উৎসাহের সাথে ভিক্ষার থলিটা খুলতে গেলে মা ওকে বাঁধা দিয়ে থলিটা পুটলি বন্দী করে। কেয়া দ্রুতই বুঝতে পারে যে, ওর ভুল হচ্ছিলো। এভাবে শিশুটি প্রতিদিন শিখছে, বেপরোয়া একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের সাথে খাপ খাওয়াচ্ছে। পুটলির উপর বসে ওরা যখন বিশ্রাম নেয় তখন এমনভাবে হেলান দিয়ে থাকে যাতে মা-মেয়ের কাটা হাত দুটি সামনে পড়ে। ফলে ট্রেনের টিটিরা আর জেরা করে না, ভিক্ষুক ভেবে চলে যায়। ওদের পরতেও হয় খুব মলিন এবং ছেঁড়া পোশাক। একজন ভিক্ষুকও যে পরিপাটি হয়ে থাকতে পারে এটা এ সমাজের মানুষ মেনে নেবে না। এখানে ভালো থাকার অধিকার শুধু তথাকথিত ভদ্রলোকদের। গরীবেরা এদেশে এখনো নিপিড়ীত, সদা বঞ্চিত। মর্যাদা দূরে থাক শ্রমের বিনিময়ে ন্যায্য পাওনাটুকুও তারা পায় না।
ভিক্ষাবৃত্তিতে আসার আগে সুমী চেষ্টা করেছিলো একটা বাসায় কাজ করে মা-মেয়ে চলতে। সম্ভব হয়নি, একটা হাত কাটা, এবং একটি কাটা হাতের শিশু সন্তান আছে দেখেও গৃহকর্তা বা কর্তী একটুও ছাড় দিতে রাজি হয়নি। বরং সুমীকে ছেড়ে দেওয়ার আগে এই বলে শাঁসিয়েছে যে, সুমীর যে একটি কাটা হাতের সন্তানও আছে তা কেন আগে থেকেই গৃহকর্তীকে জানানো হয়নি। বাইশ দিনের বেতন দিয়ে বিদায় করেছে। সুমী তখন থাকত মহাখালী সাততলা বস্তিতে। ওখান থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে বনানী গিয়ে ঘর ঝাড় দেওয়া এবং মোছার কাজটি নিয়েছিলো। কাটা হাত বলে তার বেতনও ছিল কম, আর একটু এমন তেমন হলেই চোখ রাঙ্গানি। একদিন সাথে করে মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়াতে বাধে বিপত্তি। সেদিনই কাজ থেকে সুমীকে বিদায় করে দেয় গৃহকর্তী, অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত সরোয়ার আলীর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষিকা নূরজাহান বেগম। তাদের সন্তানেরা সবাই দেশের বাইরে, হয়ত বছরে একবার আসে। সংসারে লোক সর্বসাকুল্যে তারা দু’জন, বাড়ির কেয়ারটেকার আর স্থায়ী একজন গৃহকর্মী, যার কাজ মূলত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রীর খেদমত করা। একটা তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে রাখা আছে বাইরে গিয়ে এটা-ওটা কিনে আনবার জন্য। বেশি আনতে হয় ওষুধ। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই ডায়াবেটিস সহ বিভিন্ন রোগে জর্জরিত। গ্রামের বাড়ি ফেনিতে তিনতলা বাড়ি, বনানীতে ছয়তলা বাড়ি, বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন নামে গুচ্ছিত অর্থ, আফতাবনগরে দু’টি প্লট, আরো অনেক কিছু। এতকিছু সম্পদ করেও শেষ জীবনে তারা এক ভীষণ অসুখী দম্পতি। স্বামী-স্ত্রীর বেশিরভাগ সময় কাটে কাজের লোকেদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে, নিয়ম করে ওষুধ খেতে, বিদেশে অবস্থানরত ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলাটাও তাদের একটি বড় কাজ। ছেলেমেয়েরা ফোনে ‘আব্বু আম্মু বলে গালভরা একটা ডাক দিয়ে, কোনোমতে শরীরের খোঁজখবর নিয়ে ফোনটা ধরিয়ে দেয় নাতিনাতনিদের হাতে। ছেলেমেয়েদের অত সময় নেই।
ট্রেনের ভদ্রলোকটি বাসায় কাজ করার কথা বলায় সুমীর মনে পড়ছে দুই মাসের সেই হৃদয়বিদারক দিনগুলোর কথা। হাত কাটা ছোট্ট শিশুটিকে বাসায় একা রেখে যেতে হত। প্রচণ্ড উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে সাধ্যমতো কাজ করেও মনিবের মন রক্ষা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত অপমানজনকভাবে কাজটি ছাড়তে হয়েছিলো। বাধ্য হয়ে তাকে বেছে নিতে হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তির এ যাযাবর জীবন।

-চলবে