ছোটগল্প: দ্বন্দ্ব

ভেলা

রায়হান আব্দুল্লাহ এই এলাকার একমাত্র মানুষ যে দ্বিতীয় কোনো বই পড়েছে, ক্লাসের বই ধর্তব্য নয়। চরফ্যাশন উপজেলার চর মাদ্রাজের বাসিন্দা সে। এ এলাকার বেশিরভাগ লোক মাদ্রাসায় পড়েছে, এখন কিছু ছেলেমেয়ে অবশ্য স্কুলে যায়।

রায়হান ভোলা সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাস করে স্থানীয় স্কুলে মাস্টার হিসেবে ঢুকেছে। ওর ইচ্ছে এলাকায় কিছু কাজ করবে। এলাকার কিছু উৎসাহী যুবকদের নিয়ে অনেক চেষ্টা করে একটি ক্রীড়া ক্লাব দাঁড় করিয়েছে মাত্র।

রায়াহানের উদ্দেশ্য ছিল, একটি লাইব্রেরি এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন করা, কিন্তু সেটি শুরুতেই করার সুযোগ এখানে নেই। খেলার ছলে ওগুলোর চর্চা শুরু করতে হবে।

ও দুএকটি করে বই এনে এনে ক্লাবে রাখে মাঝে মাঝে, আবার বাড়ি নিয়ে যায়। অনেকে বইগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দ্যাখে। উৎসাহী হয়ে দুএকজন দুএকটি বই পড়েছেও।

বর্ষাকালে হয়েছে বিপদ। চাইলেই এখন সহজে বের হওয়া যায় না। মাঝে মাঝে রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, তখন নৌকায়ই একমাত্র ভরসা। রায়হানদের বাড়িটা একটু নির্জন জায়গায়। চার পাঁচটি পরিবার মাত্র বাস করে এই পাড়ায়, একটু দূরে সাইজি পাড়াটা আবার বেশ জমজমাট।

নৌকায় ছোট্ট একটি মাঠ পেরিয়ে বর্ষাকালে ঐ পাড়া পর্যন্ত যাওয়া লাগে, এরপর মাদ্রাজ বাজারে অটোতে বা ভ্যানে যাওয়া যায়। ক্লাবটি মাদ্রাজ বাজারে।

রায়হানের একজন প্রতিবেশী আছে নৌকা চালায়, শৌখিন মাঝি তাঁর নাম। নামটা যে কীভাবে শৌখিন তা কেউ জানে না। তবে এই নামেই সবাই ডাকে।

শৌখিন মাঝির সাথে রায়হানের খুব ভালো সম্পর্ক। নৌকায় ঐটুকু পথ যাওয়ার সময় প্রতিদিন কিছু না কিছু কথা হয়। সুখ দুঃখের কথা এমন কিছু হয় না, আউলাঝাউলা কথাই বেশি হয়।

শৌখিন মাঝি বই পড়তে পারে, সে ইতোমধ্যে রায়হানের কাছ থেকে কয়েকটি বই নিয়ে পড়েছে। ঠিকমত বুঝতে পারেনি, মাঝে মাঝে বইয়ের লেখা নিয়ে সে বিভিন্ন প্রশ্ন করে।

দেখা হলেই শৌখিন মাঝিকে বড় একটি সালাম দেয় রায়হান। মাঝিও একগাল হেসে সালামের জবাব দেয়, আবার বলে, মাস্টার আমারে সালাম দেন ক্যানো? সালাম তো আমি দিমু। রায়হান বলে, ছি! ছি! কী যে বলেন, আপনি মুরুব্বি মানুষ।

রায়হানের আরেকজন প্রতিবেশী হচ্ছে, হুনিয়াল সর্দার। হুনিয়ালের জাহাজ আছে, খুব ডাকসাইটে মানুষ, চর মাদ্রাজের সবচে ধনী ব্যক্তি সে। একাই এই ইউনিয়নে পাঁচটি মসজিদ এবং বারোটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছে। এলাকায় দানবীর বলে পরিচিত!

যদিও মসজিদ মাদ্রাসা তার উছিলায় সৌদি টাকায় হয় বলেই জানা যায়, সেখান থেকেও তার ভালো ইনকাম থাকে, কারণ, কন্ট্রাকটারি সে-ই করে। আয় হয় আবার দানশীল হিসেবে তার নামও হয়, তাহলে এরকম সুযোগ ফেলে সে শহরে যাবে কেন?

সে এলকায় থাকে দেখে অনেকেই অবাক হয়, ইচ্ছে করলেই তো সে শহরে গিয়ে থাকতে পারে। গভীরভাবে কিছু তলিয়ে দেখার মত ফুসরত, স্বচ্ছলতা এবং শিক্ষা এখানকার মানুষের নেই।

শহরে অবশ্য হুনিয়ালের বাসা আছে শোনা যায়, কিন্তু গ্রামেই বেশি থাকে। তার রাজনৈতিক সংযুক্তি নিয়েও মতভেদ আছে। সাধারণত সরকারি দলের সাথেই সে মহব্বত রেখে চলে। তবে এটাই সত্য যে তলে তলে সে সৌদি মদদপুষ্ট রাজনীতির সাথে জড়িত।

রায়হান সিনিয়র প্রতিবেশী হিসেবে সর্দারের সাথে দেখা হলেও সালাম দেয়, কিন্তু সে কোনোমতে মাথাটা একটু নাড়ায়, বোঝা যায়, রায়হানকে সে পছন্দ করে না। এখন দেখা হলে অবশ্য রায়হান তাকে পাশ কাটিয়ে যায়।

হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে, হুনিয়ালের দুএকজন লোক ক্লাবে এসে শুধু শুধু ঝামেলা বাধাচ্ছে। ক্লাবটির নাম হচ্ছে, ‘কিছুক্ষণ ক্লাব’। একদিন এসে কয়েকজন ছেলে ক্লাবের নাম নিয়ে সে কী হুলুস্থুল! বলে, ‘কিছুক্ষণ’ ক্লাবে বসে বেশিক্ষণ আড্ডা মেরে যাই।

রায়হান বিষয়টি দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে। একসময় ঐ ছেলেগুলোও ওর ক্লাবের সাথে জড়িয়ে যায়, ওদের একজন তো গোপনে রায়হানের কাছ থেকে বই নিয়ে পড়ে এখন।

আজকে শৌখিন মাঝি নৌকা নিয়ে বের হল না, রায়হান ভেবেছে, কোনো অসুবিধা থাকতেই পারে। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর ও বুঝল, কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে বলতে চায় না, পরে একদিন বলে, ভাইজান, পানিতে থাইকা কুমিরের লগে কি লড়াই চলে?

– চাচা, আমরা তো কারো সাথে লড়াই করছি না!

– বাজান, লড়াই করা লাগে না, লড়াই বাইধা যায় এমনি এমনি।

– চাচা, আমার তো তার সাথে কোনো দেনদরবার নেই! আমার জাহাজ কোনো কাজে লাগে? আমার লাগে পার হতে নৌকা। আমাকেও তো তার কোনো কাজে লাগে না, তাই না? তাহলে দ্বন্দ্বটা কোথায়?

– দ্বন্দ্ব আছে, বাজান, দ্বন্দ্ব আছে। পথে কোথাও মন্দির দ্যাখলে দ্যাখছো না হিন্দুরা একবার হাতজোড় করে যায়, বিষয়টা ঐরকম–তোমার কোনো লাভ নেই তারপরও এইসব ধনীদের সামনে ‘হাতজোড়’ করতে হয়, যতবার দেখা হবে ততবার করতে হয়, মাঝে মাঝে ওদের পিছু নিয়েও ‘হাতজোড়’ কইরা আসতে হয়।  হাইদে গালি খাইয়া মাথা নিচু কইরা অাসতে হয়। দস্যু থেকেই দ্যাবতা হয়, ভয় পায় ওরা, পাছে না কেউ আবার তাদের সব দস্যুতা প্রকাশ কইরা দ্যায়, তাই দমিয়ে রাখতে চায় সবাইরে সবসময়।

– [রায়হান অবাক হয়, ভাবে, কিছু মানুষ আপনাআপনিও জ্ঞানী হয়ে যায়! সবার বই পড়া লাগে না বোধহয়।] তাহলে আপনি আমাকে আর নৌকায় পার করবেন না?

– কীভাবে করব? হ্যায় তো আমারে হিদা নিষেধ করছে।

– কী চায় সে?

– মনে হয় চায়, তুমি হেতারে তোয়াচ কইরা তারপর সবকিছু করো। হেরে ক্লাবের সভাপতি বানায়ে দাও না ক্যানো? ট্যাকা পয়শা কিছু দিব মনে হয়।

ঠিক আছে চাচা, উঠি, চিন্তা করে দেখি কী করা যায়। রায়হান ভাবতে থাকে, ভেবে ভেবে কোনো সহজ সমাধান পায় না।

একটা বুদ্ধি মাথায় আসে–

এতদিনে ও বুঝতে পেরেছে, সিরিয়াস ভালো এবং সিরিয়াস মন্দ -দুটোকেই মানুষ গুরুত্বের সাথে নেয়, কিন্তু পাগলরা শুধু হাসির পাত্র, কৌতুকের বিষয়, তাই পাগলের বেশ ধরতে হবে, উদ্ভট কিছু করতে হবে।

রায়হান কয়েকটি কলাগাছ জড়ো করে একটি ভেলা বানায়, এরপর একটি বাঁশের লগি দিয়ে ভেলা চালিয়ে মাঠটি পার হয়। আবার ভেলায় করে ফিরে আসে। একটি ভেলা নষ্ট হলে আরেকটি বানায়।

ভেলা কাত হয়ে পড়ে একদিন তো মহা হুলুস্থুল অবস্থা, সবাই মাস্টারকে দেখে সে কী হাসাহাসি! হুনিয়াল সেদিন যা মজা পেয়েছিল!!

একদিন তো হুনিয়াল সর্দার বলেই বসে, মাস্টার, এসব কী করতাছেন? একখান নৌকা ভাড়া করলেই তো পারেন!

রায়হান বলে, জ্বী, তা পারি, তবে ভেলা চালানোর শখ হইল কিনা, তাই …

– ঠিকই কইছেন মাস্টার, শুনতাছি শখ করে মানুষ গলায় দড়িও দিচ্ছে আজকাল।

– তাই নাকি? আর বইলেন না, কীসে যে কী হইল দেশটায়, আত্মহত্যা বর্তমানে খুব বেড়ে গেছে সবদিকে, এটা নিয়ে কিছু করা দরকার!

– [এ হালার তো দেহি সবকিছু নিয়েই কিছু করার শখ!] হুনিয়াল ভাবে, এইডা তো দেখছি একটা বেকুব! কোনো কথার মানে বোঝে না। দূর, হের সাথে কথা কইয়ে লাভ নেই কানো।

বুদ্ধিটা ভালোই কাজে দেয়। এখন আর রায়হানকে নিয়ে সমাজের মান্যগণ্যরা কেউ খুব একটা মাথা ঘামায় না। সবাই শুধু মুখ টিপে হাসে।

ছদ্মবেশে বলদামি ভাব বজায় রেখে রায়হান তার কাজ সফলতার সাথে করে চলেছে চরমাদ্রজ ইউনিয়নে।


শেকস্ রাসেল

লন্ডন প্রবাসী লেখক