আমার আমি // টুকরো গল্প

card

মূলত ২০০০ সালেই আমার ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যায়। ইন্টারমিডিয়েটে ড্রপ দিলাম। ড্রপ দেওয়ার বিলাসিতার কোনো সুযোগই ছিল না। পরিবারের দায়িত্ব তখন নিতেই হবে–এমন অবস্থা। এর মধ্যে আর পড়াশুনা চলে নাকি? তা আবার ইন্টার সায়েন্স!

অথচ ঐ ড্রপআউটই ছিল আমার জীবনের আশীর্বাদ। তখন কোনোমতে পাশ করলে জীবনটা অন্যরকম কিছু হত। মাঝখানের গল্পটুকু কোথাও লিখেছি মনে হয়, তাই বাদ দিয়ে যাই। মূলত ইন্টার পাস করার পর আমি বুঝতে পারলাম যে ছাত্র হিসেবে আমি মন্দ নই।

কোনো ধরনের শিক্ষকের কাছে না পড়ে, ক্লাস না করে, কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ইন্টার সায়েন্সে মোটামুটি একটা রেজাল্ট করা বেশ আত্মবিশ্বাসের ব্যাপার।

এরপরও অবশ্য ভালো কিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না। পরিবারের দায়িত্ব নিতে হত, নিলামও। এখন যখন ইন্টার পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের দেখি, কত ছোট দেখায় ওদের! অথচ আমি তখন পুরো দস্তুর পরিবারের অভিভাবক এই বয়সে! আসলে দায়িত্ব মানুষের বয়স বাড়িয়ে দিতে পারে এক ঝটকায় দশ বছর।

টিউশনি করি, বাড়িতে টাকা পাঠাই, যার যতটুকু দায়িত্ব নেওয়া যায় নিতে থাকি। পড়াশুনা এক রকম বাদ হয়ে যায় আবার। দেখতে দেখতে বছরটা ঠিকই চলে গেল। আমার কোথাও ভর্তি হওয়া হল না! আবার এক বছর গ্যাপ।

ভাগ্য ভালো আমার টনক নড়লো শেষ সময়ে এসে। মনে হোলো, শেষ চেষ্টাটা করে দেখি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম তুললাম। পরীক্ষা দিলাম, চান্স পেলাম। এটাই টার্নিং পয়েন্ট। কিন্তু ইতোমধ্যে অামার মধ্যে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

পারিবারিক মানুষ থেকে ধীরে ধীরে আমি সামাজিক মানুষ হয়ে উঠতে থাকলাম। পড়াশুনায় আবার ভাটা পড়ল। তবে একটা জিনিস শুধু অব্যাহত থাকলো–পারিবারিক দায়িত্বটা পালন করে যাচ্ছিলাম সুচারুরূপে।

নানান উত্থানপতন এর মধ্যে হয়েছে। একে একে ঢাকায় আসে যারা আপনজন, তাদের মধ্যে আমি শুধু ঠিকঠাক উপার্জন করি, ফলে সবার সব টানাপোড়েন আমার উপর এসে পড়ে। সাধ্যমত পালন করি সবই, কিন্তু ওদিকে আমার অজান্তেই পড়াশুনার পাঠটা একেবারে চুকে যায় বলতে গেলে।

অনার্স পাশ করাটাই ছিল আমার জন্য চ্যালেঞ্জ, কারণ, প্রতিবারই পরীক্ষা দিচ্ছি কোনোমতে, কোনো সাবজেক্ট ক্রাস, কোনো সাবজেক্ট কোনোমতে পাস, ক্লাস করি না যথারীতি, ইনকোর্স দিই না, ফলে হিসেব গিয়ে দাঁড়ায় আশি-এর মধ্যে।

চার বছর পরে গিয়ে যখন অনার্স পাশ করলাম এবং সেটি যথেষ্ট হল আমার জন্য, তখন ভাবলাম, এতেই হবে। খুবই ক্লান্ত তখন আমি, আসলে এসএসসি পাস করার পর থেকে একভাবে দৌঁড়াচ্ছি, তাই সবসময় মনে হয় এখন একটু জিরিয়ে নিই। হয় না, এখনো হয়নি।

মাস্টার্স আর করতে চাইলাম না বিভাগ থেকে। এটা ছিল মস্ত বড় একটা ভুল। আসলে ভুল যা আমি করেছি সেটি অনার্স পাশ করার পর, তার আগ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল। অবশ্য জীবনের সবচে বড় ভুলটা করেছি তখন আমি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ি। যদিও এ ভুলটিকে আমার সমাজ পরিবর্তনমূলক কাজের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবেও ভাবা যেতে পারে।

নিজের মধ্যে লেখক সত্তা সবে আবিষ্কার করেছি, তাই লেখালেখির নেশাটা কোনোভাবেই আর ছাড়তি পারি না, ম্যাগাজিন চালাই, সেটিকে পূর্ণাঙ্গ পত্রিকায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি তখন, একটা হিল্লা পেয়ে সে চেষ্টাটা আরো জোরদার হয়েছিলো।

পরে বুঝেছিলাম, ওটি আমার হিল্লা ছিলো না, বরং আমি ছিলাম তার বিলাসিতা বা ছোট একটি ক্ষণিক প্রয়োজনীয় ঢাল, কখনো কখনো বিশাল জাহাজের পাশে যেমন ডিঙ্গি নৌকা প্রয়োজন হয়, অনেকটা সেরকম। ডিঙ্গি ডুবে গেলেও জাহাজের কোনো ক্ষতি হয় না, কিছু যায় এসেও না।

এখানে যা লিখছি আসলে প্রতিটি লাইনেই একটি করে বড় গল্প আছে, বলতে চাই কখনো। ২০০৯ সালে আপাতভাবে পত্রিকা এবং লেখালেখির পাঠ চুকল, চুকল মানে চুকাতে হোলো বাধ্য হয়ে। এর আগে জীবনের সবচে বড় ভুল করে ফেলেছি, সেকথা তো বললাম।

এটাকে শুধু ভুল না, আমি অপরাধ হিসেবে গণ্য করি। এই বিষয়টি না ঘটলে অনেক কিছু অন্যরকম হত। যাইহোক, জীবনে একবার ছন্দপতন হলে ছন্দে ফেরা খুব কঠিন, ছন্দে ফেরা হয়নি আর।

সবকিছুর পরও পরিবারটিকে আমি মোটামুটি ছন্দে রেখেছিলাম, কিন্তু সবকিছু উলোটপালোট হতে গিয়েছে বহুবার, ঠেকিয়েছিও। এখন বলা যায় পরিবারটি একটি স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। তবে আমি আগের মতই টালমাটাল!

স্থায়ীভাবে সবার নির্ভরতা হয়ে ওঠার জন্য দরকার ছিল আমার একটি ‘ভালো’ চাকরি। অনার্স পাশ করার পরই উচিৎ ছিল সেদিকে নজর দেওয়া। তাজা দুই বছর আমি এক অর্থে ‘নষ্ট’ করেছি। যদিও কোনোকিছুই আমি ‘নষ্ট’ হিসেবে দেখি না জীবনে। তারপরেও একটা সামাজিক এবং পারিবারিক বিবেচনা তো আছে–সে বিবেচনার মূল্য তো কম নয়।

পপুলেশস সায়েন্স ভর্তি হওয়া ছিল মস্তবড় একটা ভুল। সে ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে বেশ বাজেভাবে। আসলে আমি আমার সামর্থের সাথে বিট্রে করেছি। পারিবারীক দায়িত্ব সবসময় পালন করেছি বটে, এবং সে তো শুধু দায়িত্ব নয়, রীতিমত যুদ্ধ। এই ঢাকা শহরে আমি যে পরিমাণ মানসিক রোগের চিকিৎসা করিয়েছি এবং মানসিক রোগীদের সাথে বসবাস করেছি, সেটি বিরল।

যে চাকরিটা সবচে বেশি দরকার ছিল সেটিও পেয়েও একবছর পর ছেড়ে দিলাম! এটা আর কেউ মানতে পারল না, আমিও সবার তালে ভুল করে মাঝে মাঝে মানতে পারি না। কিন্তু এটা বুঝি যে চাকরি ছাড়াটা আমার ঠিকই আছে। শুয়োরের লড়াইয়ে যোগ দিয়ে জীবিকার সংগ্রামটা একটু সহজ হোতো হয়তো, কিন্তু জীবন বাঁচত না।

এগুলো সবই ঠিক ছিল, সমস্যা হয়, আমার সামাজিক এবং মানবিক সত্তাই আমাকে ভুগিয়েছে সবচে বেশি। দুর্বল হৃদয় আমাকে বেঁধে রেখেছে সবকিছুর সাথে, ফলে সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারিনি আজও। এখন তো শুধু মনে হয় সীমানা পার হওয়ার চেয়ে সীমানাটা বাড়ানোই বোধহয় আমার দায়িত্ব।


লেখক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক