মেঘ-বিছানো শৈলমালা গহন-ছায়া অরণ্যে।
ক্লান্ত জনে ডাক দিয়ে কয়, ‘কোলে আমার শরণ নে।’
ঝর্না ঝরে কল্কলিয়ে আঁকাবাঁকা ভঙ্গিতে,
বুকের মাঝে কয় কথা যে সোহাগ-ঝরা সংগীতে।
(শিলঙ চিঠি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
রবীন্দ্রনাথ যেন ভর করে বসলো আমাদের উড়াধুরা দলটার ওপর। না কেবল রবীন্দ্রনাথ কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের দলনেতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ,পাঠচক্রে শেষের কবিতা পড়াতে পড়াতে যেন দ্বিতীয়বার পাহাড়ের কোলে ক্লান্তি শেষে আশ্রয় নিতে চাইলেন। যদিও তাঁর দ্বিতীয়বার কিন্তু পুরো দলটার প্রথমবার। শেষের কবিতার লাবণ্যের হেঁটে চলা পাইন বনে যেন হাঁটতে শুরু করলাম আমরা অমিত-লাবণ্যেরা । উকিঁ ঝুঁকি দিয়ে জড়িয়ে পড়লাম শিলং (Scotland of the East) নামক শৈল শহরে, মেঘের আনাচ কানাচে, পাহাড়ের কোল জুড়ে আমরা আসন পেতে বসে পড়লাম গরমের ক্লান্ত শরীরে।
গর্মি যখন ছুটল না আর পাখার হাওয়ায় শরবতে,
ঠাণ্ডা হতে দৌঁড়ে এলুম শিলঙ-নামক পর্বতে।
সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। তপ্ত গরমে ঢাকায় মাছভাজা। এমন সময় কেন্দ্রের ছাদে চাঁদ-হাওয়ার মাঝখানে স্যারের (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) খেয়ালী কথা, চলো শিলং গিয়ে জুড়িয়ে আসি। তবে সবাই না। বাছা্ই করে কেউ কেউ। স্যারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাছাই পর্বে আমার নামটিও চলে এলো। শুরু হলো প্রস্তুতি। কারও পার্সপোর্ট আছে তো কারও নেই। কারও টাকা আছে কারও ধার করতে হবে, কারও যাবার তীব্র ইচ্ছা, কিন্তু অভিবাবক বাঁধা। এমনি নানা প্রতিকুলতায় সময় ঘনিয়ে আসলো। আমারও অফিসিয়াল সরকারি পারমিশন জুটে গেলো। সেদিনের আনন্দ যেন আর কিছুতেই তুলনীয় নয়। পরিকল্পনা হলো ট্রেনে সিলেট, একরাত সিলেট স্টে করে পরদিন ভোরে শিলং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। যথা কথা তথা কাজ।
শুভস্যম শ্রীঘ্রম। মে মাসের ৭ তারিখ দুপুর ২.৩০টায় কমলাপুর থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু। হৃদয়ের কিনার জুড়ে তখন মেঘের রাজ্যে যাবার আনন্দ সবার। টুকিটাকি কেনাকাটাও শেষ। একে একে প্লাটফরমে সবাই উপস্থিত। দল আঠারো জনের। একজন অনুপস্থিত। বার বার ঘড়ি দেখা। আসছে না সে। উঠে পড়া হলো ট্রেনে। সময়মতো চিত্রার হুইসেল। ঘটঘট করে রাজনন্দিনী প্লাটফরম ছেড়ে বেরিয়ে যাবার মুহুর্তে দেখা গেলো আমাদের অতি প্রিয় খুশী হাজির। তখন আর ট্রেন আটকাবার উপায় নেই। ওর চোখের জল দেখে সবার মন কেমন করে উঠল সমাধানও বেরিয়ে গেলো, ফোনে বলা হল বাইরোডে সিলেট চলে যেতে।
পথ ধরে হৈ হৈ। রাতে সিলেটে স্যারের ছাত্রীর বাড়িতে অবস্থান। ভোরে কাঙ্ক্ষিত মুল যাত্রা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছার কথা থাকলেও ভারত থেকে আমদানি করা কয়লা ও পাথরবোঝাই ট্রাকের আনাগোনায় তামাবিলের কাছাকাছি দুই-তিন কিলোমিটার অতিক্রম করতে আরও লাগল বাড়তি আধঘণ্টা। ট্রাকের ফাঁক গলিয়ে, গা বাঁচিয়ে বাংলাদেশের কাস্টমস ও পুলিশ চেকপোস্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভারতীয় প্রান্তে ডাউকি চেকপোস্ট। ডাউকি থেকে শুরু হয় ওপরে ওঠার পালা। ডাউকি বাজার পেরিয়ে শতবর্ষী ঝুলন্ত ব্রিজ। দুটি লোহার তারের দড়ি দুই প্রান্তের পাহাড়ের রহস্যময় সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে গেছে। সেই দড়ির সঙ্গে ঝুলে আছে ব্রিজটি। নিচে নীলচোখা সারি নদী। ডাউকি চেক পোষ্টের কাজ শেষে ট্যাক্সি ধরে ওপরের দিকে উঠতে হবে। গ্রুপের ছেলেরা ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে সিন্ডিকেট বিপত্তিতে পড়ে দেরি হয়ে গেলো আরও খানিকটা। ততক্ষণে প্রায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে গেছে সবার, বিশেষ করে স্যারের। তার প্রবল প্রকাশ ঘটল যখন ডাউকি থেকে পাহাড়ি পথে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত শত শত ট্রাকের ভিড়ে আটকা পড়তে হল। মুক্তি মিলল ঘণ্টা দেড়েক পর। যতো ওপরে ওঠা ততো মেঘের রাশি ঝাপটে ধরলো আলিঙ্গনে। গরম থেকে ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা থেকে আরও ঠাণ্ডা। রাশি রাশি মেঘে ঢেকে আছে সবুজ মাঠ, ধুসর পাহাড়, দুর দিগন্ত। শহর মাঠ বন পাহাড় সব ছেড়ে আকাশের নিচে ঝুলে ছুটে চলা মেঘের দেশে। এ যেন অন্য এক ভুবন, মেঘ রাজ্য, মেঘালয়, মেঘবালিকার রূপকথার কোনো দেশ। প্রকৃতির তুলিতে পেঁজা তুলোর রঙ নিয়ে কে এঁকে দিয়েছে নিখুঁত এ চিত্র পট। ক্ষুধার রাজ্য পৃথিবী পদ্যময় হয়ে উঠলো যেন। তৃষ্ণা ভুলে চেয়ে আছি মেঘের দিকে। আওড়াতে লাগলাম বোদলেয়ার- “আমি ভালোবাসি মেঘ…চলিঞ্চু মেঘ…ঐ উঁচুতে…ঐ উঁচুতে…আমি ভালোবাসি আশ্চর্য মেঘদল।”
গাড়ি ছুটছে আঁকাবাঁকা পথ ধরে ওপর থেকে আরও ওপরে। কখনও আবার ঘুরে ঘুরে নিচে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে ডানে-বাঁয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার ফুট গভীর খাদ। হাড় হিম করা ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। তাকাতে না চাইলেও বারবার চোখ ফিরে যায় সেই অতল গভীরে, যেখানে শুধুই গাঢ় নীল ছায়া। গা গুলানো মোচড় দিয়ে গাড়ি আবার উঠছে ওপরে। ভাসমান মেঘ ছুঁয়ে যায় পাহাড়ের গা। শাল-সেগুনের বদলে একটু পর পর পাইন-ফার-বিচ-বার্চ-সুপারি আর ওক। “গাছগুলো যেন আকাশ থেকে ছুঁয়ে দেওয়া ঈশ্বেরর তীর।” উষ্ণতার জায়গা নিয়েছে শীতল হাওয়া। শীতবস্ত্র গায়ে চাপানো হয়েছে আগেই। চলমান গাড়ির ভেতর তবুও যেন খোঁচা মারছে ঠাণ্ডা বাতাসের তীর। পাহাড়ে দুপুর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে নরম শিশুর মতো মেঘের কোলে । কে জানে, কোথায় কোন পাহাড়ের আড়ালে সূর্যটা ঢাকা পড়ে ভর দুপুরে অন্ধকার এনে দিতে চাইলো। ঘণ্টাখানেক পরই শিলং। দূর থেকে শিলং শহর দেখা যাচ্ছে যেন আকাশের নিচে আরেকটি আকাশ।
স্বাগতম এর বদলে শহরে ঢোকার রাস্তায় কুবলাই (খাসিয়াভাষা)। শিলং যে গগনচারী দূরের বিদেশ নয় মোটেই তা পৌঁছে বুঝতে পারলাম। রাজ্যের নাম মেঘালয়। নামেই যার পরিচয়–মেঘের বসতি যেথা। একদিকে সুরমা অববাহিকা, অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র। মাঝখানে এই খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় নিয়ে ক্ষুদ্র রাজ্য মেঘালয়। সিলেটের তামাবিল থেকে মাত্র ঘন্টা দুই আড়াইয়ের রাস্তা। ডাউকি থেকে শিলং ৮০ কিমি। তামাবিলের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৫০ কি.মি.। আর শিলং ৫ হাজার থেকে ৬৫০০ কি.মি. (শিলং পিক)। যাবতীয় রহস্য আর রোমাঞ্চ সেখানেই। সমতল থেকে আকাশ যাত্রা। ছোট একটি লোকবসতি থেকে ইংরেজদের হাতে শিলং শহরের গোড়াপত্তন ১৮৬৪ সালে। খাসি অ্যান্ড জৈন্তা হিলসের জেলা সদর হিসেবে।
খাসিয়াদের নিজ রাজ্য মেঘালয়। তবে জয়ন্তিয়া, গারো, কোচ, হাজং ও কুকিদেরও বাস এ রাজ্যে। একসময় শিলং শহরে বাঙালিদের আধিক্য ছিল। এখন তেমনটি না হলেও লাবান, রিলবং, জেল রোড, লাইমুখড়া, রেঞ্জা প্রভৃতি এলাকায় সিলেটি বাঙালিদের প্রাধান্য। ক্যাথলিক, চার্চ, চ্যাপেল, কনভেন্ট স্কুলের পাশাপাশি ভাষার ক্ষেত্রে খাসিয়া, অহমীয়, হিন্দি, নেপালী, বাংলা (কিছু ক্ষেত্রে, সিলেটের আঞ্চলিক) ইংরেজী। অফিসিয়াল ভাষা যদিও ইংরেজী।
স্যার থাকার নিবাস খুঁজে বের করলেন। হিল স্টার হোটেল। শিলং পৌঁছে সাইফুল ভা্ইয়ের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় দুশ্চিন্তা বাড়লেও জুলকার নাইনের কৌতুকে তা মিইয়ে গেলো নিমিষেই। আজ আর কোথাও না। টাটা সমু গাড়ী ও জিপ ঠিক করা হয়ে গেলো সন্ধ্যার আগেই। জিপ ড্রাইভার বাহাদুর থাপাই থাকবে আমাদের টুরিষ্ট গাইড। ছেলে মেয়েদের সীমানার মাঝখানের কমন রুম আমাদের ‘পরিকল্পনা ঘর’ এ প্রথম দিনের সফরসূচী ঠিক করা হলো এভাবে- ক্রিনোলাইন ফলস, মলিংটং গ্রাম, লেডি হাইডি পার্ক, হায়দারী পার্ক, ওয়ার্ডাস লেক, ক্যাথিড্রাল (ডন বসকো), এ্যালিফ্যান্ট ফলস, পুলিশ বাজার, লায়লংকট, বিলিয়াম, পাইনর্সুলা। দ্বিতীয় দিন- মগটক (ডেম্প শোয়েরা), চেরাপুঞ্জী, ইকো পার্ক, মসমাই ফলস, মসমাই ক্যাব, চেরা বাজার, মসমাই গুহা, সেভেন সিষ্টার, নোহকালিকাই ফলস, রামকৃষ্ঞ মিশন, থেঙ্গখারাঙ্গ পার্ক। তৃতীয় দিন- শিলং পিক, বড় পানি (বড়া উমিয়াম), হয়ে গৌহাটি। পাইনবন তো আছেই।
পুলিশ বাজার @ শিলং
আমাদের গাড়ি ছেড়েছিল সাড়ে দশটায় আর আমরা শিলং পৌঁছলাম দেড়টার একটু পরে । শিলং শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে পুলিশবাজার–এখানে প্রচুর হোটেল আছে। ব্যাংক, বাজার, ট্রাডিশনাল বাড়ী, সব ধরনের খাবারের হোটেল এমনকি একটু পর পর বার, হ্যান্ডক্রাফটের বিশাল সমাহার। পুলিশ বাজার নয় কেবল, শিলং সবচেয়ে যে বড় বৈশিষ্ট্য চোখে পড়লো তা হলো সব দোকান, ব্যবসা বানিজ্য এমনকি তেলের পাম্পগুলি চালাচ্ছে নারীরা। দল বেঁধে হাত হাত ধরে তারা চলেন পাহাড়ী পথে। তাদের সহোযোগিতা করেন পুরুষ বন্ধুরা।
চেরাপুঞ্জী
বৃষ্টিখ্যাত চেরাপুঞ্জীর নাম তো ছোটবেলায় বইএ পড়েছি। এই প্রথম তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে এসেছি। নিরাশ তো করেনি বরং ভরিয়ে দিলো চেরাপুঞ্জী। শিলং থেকে যে রোড ডাউকির দিকে চলে এসেছে সেই রোড ধরে চেরাপুঞ্জী আসতে হয়। চেরার দিকে আসার পথে একটা ব্রিজে আমাদের গাড়ী থামানো হলো, দৃষ্টি নন্দন উপত্যকা! নিচে বড় খাদের মতো জায়গার দুকুল জুড়ে উচুঁ হয়ে ওঠা সবুজ প্রান্তর। স্যার বললেন, তোমরা নামো, আমি আর আঁখি এখানেই থাকি। নামা হয়তো সহজ হবে, ওঠাটা নয়। দাঁড়িয়ে পড়লাম, কিন্তু মন উসুখুস। স্যার অন্যদিকে তাকাতেই নেমে পড়লাম, মাঝ বরাবর নামতেই স্যার দেখে ফেলে বললেন, কিহে, আমি ইশারায় স্যারকে নামতে বলে নেমে গেছি অনেক দূরে। সবাই ছবিতে বন্দী হচ্ছে। আমি এক কোণায় দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম, দুকুলের সবুজ উচুঁ হয়ে মিলেছে একই প্রান্তে। চোখ ফেটে জল এলো, এতো সুন্দর হয় প্রকৃতি! সবুজ এতো সবুজ হয়! সবাই ভেবেছিলো আমার কষ্ট হয়েছে নামতে তাই কাঁদছি, স্যার বললেন ওকে কাঁদতে দাও, ও শুদ্ধতা লাভ করেছে। শুধু মনে হচ্ছিলো কত পূন্য আমার, আমি এর সৌন্দর্যের কাছে কত নগন্য! ফেরার পথে চেরার এই ব্রিজের পারে দাঁড়িয়ে বর্ষায় ভেজা যেন ছিলো বাড়তি পাওনা।
মাওকডক ভ্যালি
এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা নামতে হয় । নিচে নেমে রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা চওড়া প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখান থেকে দুপাশের পাহাড়ের মাঝের জায়গাটা খুব সুন্দর। এছাড়া সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ী নদী দেখতে পাওয়া যায় । পুরোটা নামতে প্রায় পঞ্চাশটার মতো সিঁড়ি ভাঙতে হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেটা পুষিয়ে দেয় ।
ইকো পার্ক
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ১৫/-
এখানেও কিছুটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়, তবে সিঁড়ির সংখ্যা বড়জোর ১৫ টা। নিচে নেমে একটা বিরাট সমতল জায়গা, সেখান দিয়ে একটা জলের ধারা গড়িয়ে পাহাড় থেকে বহুনীচে পড়ে যাচ্ছে । জায়গাটায় বেশ মেঘ ছিল, আর দৃশ্য খুবই সুন্দর । ভালো করে দেখতে গেলে এই জায়গাটা কিছুতেই ২০ মিনিটে দেখে ফেলা সম্ভব নয়, কিছুটা বেশি সময় লাগবেই ।
মাওসমাই কেভ
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ১৫/-
চেরাপুঞ্জির সাইট সিয়িং-এর সবচেয়ে সুন্দর আর আকর্ষণীয় জায়গা ! যদি শরীর আর মনের জোর থাকে, তাহলে এই জায়গাটা দেখা অবশ্য কর্তব্য। পাহাড়ের মধ্যে একটা অসাধারণ সুন্দর প্রাকৃতিক গুহা যার ভেতরে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইট । ভেতরে পুরোটাই বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা আছে, কাজেই অন্ধকারে হাতড়ানোর কোনও ব্যাপার নেই । ভেতরের পথ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও মাথা সোজা করে হাঁটতে হয়, কোথাও মাথা নিচু করে আবার কোথাও একেবারে হামাগুড়ি দিয়ে । একটা বিশেষ জায়গা আছে যেখান দিয়ে গলার পথটা এতটাই ছোট যে মনে হয় বোধহয় মোটা মানুষ গলতে পারবে না। কিন্তু শরীর ভাঁজ করে, মাথা আর পা আগুপিছু করে ঠিকই গলে যাওয়া যায়। ভেতরে জুতো খুলে যাওয়াই ভালো, কারণ, অনেক জায়গাতেই গোড়ালিডোবা জল আছে । তাছাড়া জুতো পরে ভিজে পাথরের মধ্যে হাঁটতে গেলে পা হড়কানোর সম্ভাবনাও থাকবে। গুহাটা সবমিলিয়ে ১৫০ মিটার মোতো লম্বা । পাথরের ওপর পা ফেলে, মাথায় পাথরের গুঁতো খেয়ে আর ভেতরের অসাধারণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এই পথচলাটা আমার লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স !
সেভেন সিস্টার ফলস্
নসঙ্গিথিয়াং ফল্স (সেভেন সিস্টার ফলস্ )
টিকিটঃ লাগে না
পাহাড়ের ধারে একটা রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গা যেখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ের পাশাপাশি সাতটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় । গুনলে সাতের বেশিই হবে, আর কোন সাতটা একই মায়ের সন্তান সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই । অপূর্ব ঝর্ণাধারা ।
মাও ট্রপ
টিকিটঃ লাগে না
বাংলাদেশ !
আরে আমার দেশ দেখা যায় যে। এটা চেরাপুঞ্জির আরেকটা আকর্ষণীয় জায়গা। এখানে পাহাড়ের ওপরে একটা রেলিং ঘেরা জায়গা থেকে নিচে বাংলাদেশ দেখা যায় । দৃশ্যটা যে খুব স্পষ্ট তা নয়, কারণ জায়গাটা কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন, আর সোজাসুজি দেখা গেলেও দূরত্বটা নেহাৎ কম নয়। আমরা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি, নিচে যতদূর চোখ যায় নদীনালা ঘেরা সমতলভূমি- বাংলাদেশ–“আমার সোনার বাংলা।”
থাঙ্খারাং পার্ক
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১০/-
এটা একটা বটানিক্যাল গার্ডেন ধরনের জায়গা । অনেকরকম গাছ আছে, তবে ফুলের সংখ্যাই বেশি । এখান থেকে অন্য একটা পাহাড়ের গায়ে একটা ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায় আর তার সঙ্গে দেখা যায় বাংলাদেশ ।
রামকৃষ্ণ মিশন
টিকিটঃ লাগে না
রামকৃষ্ণ মিশনের ভেতরে একটা মিউজিয়াম আছে যেটায় মেঘালয়ের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের কিছু মডেল রাখা আছে । এছাড়া এখানকার পাহাড়ী অধিবাসী গারো, খাসী, জয়ন্তিয়াদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটা সংগ্রহশালা গোছেরও আছে ।
মেঘে ঢাকা নোহকালিকাই ফলস্
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ২০/-
এক কথায় অপূর্ব। উচ্চতায় পৃথিবীর ৪র্থ। ভারতে দ্বিতীয়। বর্ষাকালে এর জলরাশি ১৮০০ ফুট খাদে গিয়ে নামে। এখানে গিয়ে বিস্মিত হয়েছিলাম অনেক সময়।
স্প্রেড ঈগল ফলস্
এই নাম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আগের নাম নোহকালিয়ার ফলস। লিয়ার নামে এক কুমারী পা পিছলে পড়ে যাওয়ায় এর নাম হয়েছিল এমনটা। ঈগলের মতো ডানা মেলা প্রপাতের নাম এখন স্প্রেড ঈগল ফলস্।
লেডী হায়দারি পার্ক
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১৫/-
রোডোডেড্রনগুচ্ছের দেখা পেলাম। রবির ক্যামেলিয়া যেন হাসছে চারপাশ জুড়ে। নানান জাতের হাজারও ফুল, অর্কিড, ফার্ন দিগন্ত জুড়ে গোলাপ। শিলং এর এই বুঝি সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গা! একটি পূর্ণাঙ্গ বাগানের পাশে মিনি চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানার জলাশয়ে প্যালিক্যান ভেসে বেড়াচ্ছে।
ক্যাথিড্রাল চার্চ
এই চার্চের বৈশিষ্ট্য হল এটা শিলং-এর সবথেকে বড় চার্চ। চার্চটা রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা উপরে, একটা অর্ধ-চন্দ্রাকার সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরের প্রার্থনাগৃহে যেতে হয় ।
এলিফ্যান্ট ফলস্
টিকিটঃ মাথাপিছু ১০/-, ক্যামেরা ২০/-
মাওসমাই কেভ যেমন চেরাপুঞ্জির সবথেকে বড় আকর্ষণ ঠিক তেমনই শিলং-এর সবথেকে বড় আকর্ষণ হল এলিফ্যান্ট ফলস্। এটি না দেখলে শিলং ভ্রমণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পাহাড়ের গা বেয়ে একটা ঝর্ণা নেমে আসছে, পাহাড়ের ধাপে ধাপে তিনটে জায়গা থেকে সেটি ভালোভাবে দেখা যায় । এগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট ফলস্, সেকেন্ড ফলস্ আর থার্ড ফলস্ । অদ্ভুত সুন্দর ! থার্ড ফলস্ পর্যন্ত পৌঁছতে ৫০ টার মোতো সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তবে ভাঙাটা সার্থক। একেবারে নিচে দাঁড়িয়ে এলিফ্যান্ট ফলসের যা সৌন্দর্য, তা নিজের চোখে না দেখলে জীবনে কিছু অদেখা থেকে যায়। “ঝর্ণা ঝরঝরিয়ে জল ছড়িয়ে যেন নেচে নেচে যায়।” এলিফ্যান্ট ফলস্ এর কাছে একটা লোক্যাল পোষাক পরে ছবি তোলার ব্যবস্থা আছে । এখানে চা-টা খেয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে । আর আছে কিছু জিনিসপত্রের দোকান । চাইলে একটু আধটু শপিং।
মেঘে ঢাকা তারার মেঘালয় শিলং পীক
টিকিটঃ মাথাপিছু ২০/-, ক্যামেরা ২০/-
শিলং শহর থেকে ১০ কি.মি. দুরে রোডোড্রন আর ঘন পাইনের বনাবৃত শিলং পীক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫০০ ফিট উপরে রহস্যঘেরা রূপকথার দেশ যেন। শীতল। কুয়াশাচ্ছন্ন। হাসানের বাইনোকুলার কাড়াকাড়ি করে নিশ্চিদ্র মেঘ থেকে ছিনিয়ে এনে যা দেখছি তা কেবল গিয়ে দেখে আসতে হবে। এখানে আরেকটু না বলে পারছি না, শিলং পীক-এর পাশেই খাসিয়াদের পোশাক পরে ছবি তোলা বিরাট আকর্ষণীয়। মেয়েদের বর্ণাঢ্য পোশাক ভীষন রঙিন। ওপরে কা-জিমপিন (ব্লাউজ), নিচে কা–জৈনসেম (লুঙ্গি), বুকের উপর আড়াআড়ি আরেকটা লুঙির পাড়। সেই আড়াআড়ি পারে অনায়াসে বাচ্চা ঝুলিয়ে রাখা যায়। আর ঠোঁট রাঙানো শিলং এর বিখ্যাত পান মেয়েদের আরেকটি অলঙ্কার।
বড়াপানি (উমিয়াম লেক)
টিকিটঃ মাথাপিছু ২০/-, ক্যামেরা ৬০/-
এখানে আসার পর বুঝলাম কেন অমিত লাবণ্য এখান থেকে উদগত হলো। সবাই যেন এলিয়ে পড়েছিলাম আমরা। দূরে দেখতে পাচ্ছিলাম ছবির মতো নারী ও পুরুষের আলিঙ্গন আর জলের সাথে মাখামাখি। কথিত আছে এটি নাকি এক বোন হারিয়ে যাওয়ায় অন্য বোনের কান্নার জলে সৃষ্ট লেক ।
লেকের একদিকে বাঁধ দিয়ে এই জল (উম) ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে । বিরাট বড় লেকের মাঝে একটা পাহাড়ও আছে । এটার নাম লাংপেংডং । লেকের পাশ ঘেঁষে আবারও বাগান।নেহেরু গার্ডেন, লেক রিসোর্ট।এখান থেকে যেন কেউ উঠতে চাইছিলাম না।
এখানে বোটিং এর ব্যবস্থাও রয়েছে, স্পিডবোটে করে পুরো লেকটা ঘোরানো হয়। এখানে একটা ছোট খাবারের দোকান আছে, সেখানে চা কফি বা সামান্য স্ন্যাক্স খেয়ে নেওয়া যেতে পারে ।
গলফ্ কোর্স
একটা সাধারণ গলফ্ কোর্স । বিরাট একটা সবুজ ঘাসে মোড়া উঁচুনিচু মাঠ ।
স্টেট মিউজিয়াম
টিকিটঃ মাথাপিছু ৫/-, ক্যামেরা ১০/-
রামকৃষ্ণ মিশনের মিউজিয়ামটার একটা বড় ভার্শান হল এই স্টেট মিউজিয়াম । ভেতরে সবকিছুরই ছবি তোলা যেতে পারে। গারো, খাসী, জয়ন্তিয়া মানুষের জীবনযাত্রার মডেল, অস্ত্রশস্ত্র, গয়নাগাটি, রান্নার উপকরণ, পোষাক-পরিচ্ছদের একটা সংগ্রহশালা হল স্টেট মিউজিয়াম ।
পুলিশ বাজারের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড
হোটেল থেকে বেরোনোর সময়ে পেলাম সেই জিনিস, মেঘালয় যার জন্য বিখ্যাত–বৃষ্টি । আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল এবং টানা এক ঘন্টা চলল। পাহাড়ে বৃষ্টির একটা সুবিধে হচ্ছে, এখানে জল দাঁড়ায় না, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব জল সরে গেল । আমরা হোটেলে ফিরলাম । এটা আমাদের শিলং-এর শেষ রাত্রি, পরেরদিন সকালেই আমরা গুয়াহাটী চলে যাব । সেজন্য সন্ধ্যেবেলা বেরিয়ে কিছু কেনাকাটা করে নেওয়া হল। শিলং থেকে কেনার জন্য সবথেকে ভালো জিনিস হল এখানকার বেত ও বাঁশের কাজের জিনিসপত্র আর ছাতা । পুলিশবাজারে এসব জিনিসের বেশ কিছু দোকান আছে, এরা ট্যুরিস্টদের জন্য দাম সেই অর্থে কিছু বাড়িয়ে রাখে না ।
সারসংক্ষেপঃ
১. শিলং যাওয়ার সবথেকে ভালো সময় হচ্ছে বর্ষার শুরু–যে সময়ে আমরা গেছিলাম। এই সময়ে এখানে প্রকৃতি সবথেকে বেশি ঝকঝকে থাকে ।
৩. যদিও আমরা শিলং-এ খুব একটা বৃষ্টি পাইনি, তবুও শিলং গেলে প্রত্যেকেরই সঙ্গে একটা করে ছাতা নিয়ে যাওয়া উচিৎ ।
৪. শিলং-এ তিনটে গোটা দিন থাকাই ভালো, চেরাপুঞ্জি, নারটিয়াং আর লোকাল সাইট সিয়িং এর জন্য । যদি হাতে দুদিন থাকে তাহলে নারটিয়াং-টা বাদ দেওয়া উচিৎ ।
৬. চেরাপুঞ্জির জায়গাটা খুব সুন্দর, তবে এখানে থাকার কোনও মানে হয় না । চেরাপুঞ্জি ঘুরতে মোটামুটি ৫-৬ ঘন্টা লাগে যার মধ্যে ‘মাওসমাই কেভ’ মাস্ট ওয়াচ।
৭. শিলং-এর লোকাল সাইট সিয়িং-এর মধ্যে এলিফ্যান্ট ফলস্ ও বড়াপানি মাস্ট ওয়াচ। শরীর অনুমতি দিলে এলিফ্যান্ট ফলসের তিনটে ফলসই দেখা উচিৎ ।
৮. শিলং-এর প্রাণকেন্দ্র হল পুলিশবাজার–এখানে সবই পাওয়া যায় । এখানে অনেক হোটেলও আছে । ঢাকা থেকে হোটেল বুক করে গেলে পুলিশবাজারের কোনও হোটেলে চেষ্টা করা উচিৎ ।
৯. শিলং-এর খুব কাছে আসাম হওয়া সত্ত্বেও এখানে চায়ের দাম খুব বেশি (১০- ৫/- প্রতি কাপ), তাই চা-প্রেমীদের টী-ব্যাগ বা নিজস্ব চায়ের সরঞ্জাম বহন করাই শ্রেয় ।
১০. শিলং কিছুটা গন্ডগোলের জায়গা, তাই সন্ধ্যের পর রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেলে হোটেলে ফিরে আসাই শ্রেয় ।
১১. গুয়াহাটীতে কামাখ্যা মন্দির একটা দেখার জায়গা । সেটা ছাড়া বালাজী মন্দিরও দেখতে যাওয়া যেতে পারে ।
১২. আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার যিনি আমাদের ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করেছিলেন, তাঁর নাম বাহাদুর থাপা, ফো নং-০৯৮৬২৯৯৪০৭৫ (শিলং কোড-০৩৬৪), ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করেন আরেকজন, যিনি নারী, নাম ব্যাংকেরী লালা, ফোন নং-০৯৮৬২১৯৭৪৯৪। চাইলে যোগাযোগ করে যেতে পারেন।
কম খরচে ৪-৫ দিনের বেড়ানোর প্ল্যান করলে শিলং-এর মতো জায়গা কমই আছে। মাথাপিছু মাত্র ৬০০০/- টাকায় আমাদের পুরো ঘোরা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে । ভারতবর্ষের নর্থ-ইস্টের এই ‘প্যারাডাইজ আনএক্সপ্লোর্ড’ কে এক্সপ্লোর জীবনে একবার অবশ্যই করা উচিৎ !
“মেঘ পিয়ানোর ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা
মন খারাপ হলে কুয়াশা হয় ব্যকুল হলে তিস্তা”
ঘরে ফেরার পালা! ফেরার পথে আঁচল ভরে মেঘ নিয়ে ফিরছি, কিন্তু মনটা কেমন ভিজে যাচ্ছে! শিলং এর শেষ গেটে লেখা ছিল ‘কুবলাই, কুবলাই খি লীত বাম’ (বিদায়, বিদায় চলে যাও)।