পরিকল্পিত পরিবার গঠন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা ছাড়া উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জিত হবে না

পরিকল্পিত পরিবার গঠন করতে পারলে একজন নারী যেমন তাঁর মাতৃত্বজনিত মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে সক্ষম হবে ঠিক তেমনি তাঁর অনাগত সন্তানকেও সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দিতে পারবে। শুধু তাই নয়, এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে সুস্থ, সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতিগঠনও অনেকাংশে ত্বরান্বিত হবে।
যে কোনো সুন্দর ও সার্থক ঘটনা বা বিষয় বা ফলাফলের পেছনে থাকে একটি পরিকল্পনা। সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়া কোনো বিষয়কে আমরা তুলনা করতে পারি মাঝিবিহীন নৌকার পথচলাকে, মাঝিবিহীন নৌকা যেমন সুষ্ঠুভাবে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না ঠিক তেমনি পরিকল্পনাবিহীন কোনো বিষয়কে সার্থক ও সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা যায় না। এই পরিকল্পনার বিষয়টি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে কোনো সময় যদি আমরা পরিকল্পনা ছাড়া পথ চলতে শুরু করি, তখনই আমাদের বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে, যা আমাদের পরবর্তী জীবনকে বিষময় করে তুলতে পারে। বিবাহ মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমাজ স্বীকৃত ঘটনা। বিবাহের মাধ্যমে একজন তরুণ/তরুণী সংসার জীবনে পদার্পণ করে।
এই সংসার জীবনটা মধুর ও সার্থক হওয়াও একজন মানুষের জীবনে অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। আর এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যারা পরিকল্পিতভাবে সংসার জীবন অতিবাহিত করতে পারে, শুধু তারাই সুখী জীবনের অধিকারী হতে পারে। একটি পারিবারের নববিবাহিত ও সচেতন কোনো সক্ষম দম্পতির স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ে যৌথভাবে তাদের সংসারের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা জন্ম বিরতি করার মাধ্যমে সন্তান সংখ্যা কাক্সিক্ষত মাত্রায় সীমিত রেখে একটি পরিকল্পিত সুখী-সুন্দর পরিবার গঠনের দিকে অগ্রসর হয়।
নিজের পরিবারের আকার কেমন হবে, আমি নিজেকে সমাজে কীভাবে দেখতে চাই- এ সব বিষয় একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং এটি আমার অধিকারও বটে। এ বিষয়টি ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা চুক্তির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতির প্রত্যেক মানুষের সহজাত মর্যাদা, সমতা ও সমান অধিকার রক্ষা করা। এই চুক্তির মাধ্যমে এটি স্পষ্ট করা হয় যে, প্রত্যেক মানুষ তার জীবন ধারণের জন্য উপযোগী সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে সে স্বাধীন এবং এটি তার একটি অধিকারও বটে। পরবর্তীকালে, ১৯৬৮ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নারী ও পুরুষের মানবাধিকার রক্ষার আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসে। এই সম্মেলনে পরিকল্পিত পরিবার গঠনকে সক্ষম দম্পতিদের একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এখানে বলা হয়, দম্পতিদের স্বাধীনতা রয়েছে যে, তারা কখন, কয়টি সন্তান গ্রহণ করবেন এবং এ বিষয়ে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই গ্রহণ করতে পারবেন।
এ ক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্র বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে দম্পতিদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া উচিত হবে না এবং এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত তথ্য প্রাপ্তির অধিকারও দম্পতিদের থাকবে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় জনসংখ্যা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনে ব্যক্তি ও দম্পতিদের অধিকারকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনভাবে ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সমাজ জীবন শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
এখানে দম্পতিদের পরিকল্পিত পরিবার গঠনের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে তাদের জাতীয় উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। যৌন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিকল্পিত পরিবার গঠনে অধিকারভিত্তিক এই স্বীকৃতির বদৌলতে লাখ লাখ নারীকে কম সংখ্যক সন্তান গ্রহণ এবং বিলম্বে দাম্পত্য জীবন শুরু করার লক্ষ্যে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। যার ফলে নারীরা স্কুলের শিক্ষাজীবন শেষ করার সুযোগ পাচ্ছে; উন্নত জীবন ও দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তির পথও তারা দেখতে পাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে সব খাত বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে তার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প অন্যতম। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করে। এই তৈরি পোশাক শিল্পটি যাদের নিরলস পরিশ্রমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁদের অধিকাংশই বাংলার অল্প শিক্ষিত নারী সমাজ। পরিকল্পিত পরিবার গঠনসহ নারীর যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতার কারণেই তারা আজ দেরিতে বিবাহ ও কম সন্তান গ্রহণের বিষয়ে নিজেই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।
এর ফলে কর্মক্ষেত্রে নারীরা আরো বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। এটি নারীর ক্ষমতায়নেও একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। এটি নারীকে তার দাম্পত্য জীবনে স্বাধীন ও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে শিখিয়েছে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতার হারও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে; যা একটি সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে।
২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহের অর্জনের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে তরুণ জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে নারী সমাজের পরিকল্পিত পরিবার গঠন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের অন্যান্য বিষয় যথাযথভাবে কার্যকরের ওপর। পরিকল্পিত পরিবার গঠন করতে পারলে একজন নারী যেমন তার মাতৃত্বজনিত মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে সক্ষম হবে ঠিক তেমনি তার অনাগত সন্তানকেও সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দিতে পারবে। শুধু তাই নয়, এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে সুস্থ, সুন্দর ও সমৃদ্ধ জাতিগঠনও অনেকাংশে ত্বরান্বিত হবে।


প্রবীর কুমার সেন

পপুলেশন কমিউনিকেশন অফিসার, আইইএমইউনিট, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর