দিব্যেন্দু দ্বীপ
আমি #মিটু আন্দোলনের ভীষণ পক্ষের একজন, পাশাপাশি এই #মিটু যদি হয় নিজের প্রকাশ এবং খ্যাতি লাভের জন্য তাহলে তার বিরুদ্ধে বিষাদগারও করতে চাই। তার আগে যারা মিটু আন্দোলনকে ব্যক্তিগত ধান্দা হিসেবে দেখতে চান তাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছি। কারণ, এভাবে দেখতে চাওয়া মানুষই দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে বেশি।
আমি বিশ্বাস করি, জানি এবং মানি #মিটু নারীর ভয়ঙ্কর কষ্টের কথা, বেদনার কথা, ক্ষোভের কথা, না বলা কথা। প্রশ্ন করা হচ্ছে, কে কীভাবে বলছে সেই বেদনার কথা। এই প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশ্ন। যে যেভাবে #মিটু বলছে সবই ঠিক আছে, সবাই খুব প্রাজ্ঞ হবে, এবং শুধু সবদিক বিবেচনা করে লিখতে পারলেই সে লিখবে—বিষয়টা এমন হতে পারে না।
ইতোমধ্যে #মিটু আন্দোলনের সমর্থনে নারী সাংবাদিকেরা প্রেসক্লাবে একটি মানব বন্ধন করেছে। খুবই সময়োপযোগী হয়েছে সেটি, কিন্তু এ পর্যন্ত কতজন নারী বা পুরুষ সাংবাদিক অধিকার বঞ্চিত নারীদের #মিটু গুলো খুঁজে বের করতে এবং লিখতে তৎপর হয়েছেন সে প্রশ্নটিও প্রাসঙ্গিকভাবে তাদের প্রতি ছুড়ে দেওয়া যায়, আশা করি তারা ভেবে দেখবেন এবং এরকম বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে তৎপর হবেন। প্রেক্ষিতে বলতে হয়, গার্মেন্টসকর্মী, গৃহকর্মী, গৃহিণীদের কয়টি #মিটু এ পর্যন্ত সামনে এসেছে বা সামনে আসবে বলে ধারণা করা যায়? তারাই যে সর্বাধিক এবং সবসময় নিগৃহীত হচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
এর মানে এই না যে কোনো সুবিধাপ্রাপ্ত নারী তার বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া বিষয় লিখতে পারবে না, অবশ্য পারবে, এবং তা লেখা উচিৎ। উচিৎ কাজের কোনো ‘কেন’ ‘কখন’ ‘কীভাবে’ থাকতে পারে না। যে লিখছে সে সত্য লিখছে এবং তা যেকোনো সময় (যখন তার মন সায় দেয়) সে লিখতে পারে। সমাজের ভালোমন্দ কোনো দিক না ভেবেও কেউ তা লিখতে পারে, কেউ যদি কারও অপরাধের কথা প্রকাশ করতে চায় সেটি করার ক্ষেত্রে তার প্রতি কিছু শর্ত বেঁধে দেওয়া সমীচীন নয়।
তবে একটা প্রশ্ন খুব জোরেসোরে দেখা যাচ্ছে—ঠিক কী হলে, কতটুকু হলে #মিটু হবে? সব নারীর কাছে যৌন নিগৃহের বিষয়টি কি একইভাবে উপস্থিত হয়, সকল নারী কি বিষয়টিকে একইভাবে বিবেচনায় নেয়? এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ব্যক্তি টু ব্যক্তি পার্থক্য আছে, কোনো নারীর কাছে হয়ত পুরুষের যৌন চোখ উপভোগের, কারও কাছে হয়ত সেটিই নিগ্রহের। এরকম সুক্ষ্ম কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু অযাচিতভাবে গায়ে স্পর্শ করা নারী পুরুষ নির্বিশেষে নিগ্রহ মনে করে। কোনো পুরুষকেও যদি আরেকজন পুরুষ স্পর্শ করে—ধরুণ, আপনার সহযাত্রী পুরুষ যদি আপনার উরুতে একটা ছোট্ট চাপ দেয় তাহলে কি একজন পুরুষ হিসেবেও আপনি তা মেনে নেবেন?
তাহলে এটা খুব স্পষ্ট যে #মিটু শুধু ব্যক্তি নারীর বেদনার কথা নয়, এটা সমগ্র নারী সমাজের নিগ্রহের কথা। যেখানে অনাকাঙিক্ষতভাবে শরীর স্পর্শ করাটাই মেনে নেওয়া যায় না, সেখানে যদি কেউ জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়, ইভ টিজিং করে নিশ্চয়ই সেগুলো অনেক বড় ধরনের আক্রমণ এবং নিগ্রহ। তাই যারা বলছেন, “ধর্ষণ তো করে নাই” —তারা আসলে নির্যাতনকারীর পক্ষে ছাপাই গাইছেন এবং একইসাথে নিজের মানসিকতারও পরিচয় দিচ্ছেন।
আবার এটাও সত্য যে নারীর প্রতি আগ্রহ, আর নির্যাতন এক জিনিস নয়। অনেকের প্রশ্ন, আগ্রহের প্রকাশটা তাহলে কীভাবে হবে? আসলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এত বেশি সাহিত্য-সঙ্গীত রচিত হয়েছে যে মানুষের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা নিয়েও ততটা কাজ হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কতজন মানুষ প্রেমের সেই পরিশীলিত জায়গাটিতে পৌঁছাতে পারে বা পৌঁছানোর চেষ্টা করে? একইসাথে প্রশ্ন হচ্ছে, সাহিত্য সংস্কৃতির লোকেদের বিরুদ্ধেও কেন এ ধরনের অভিযোগ আসে?
অর্থাৎ বিষয়টিকে শুধুমাত্র সমাজ বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার সুযোগ নেই, বরং এটিকে শরীর বিজ্ঞান এবং যৌন বিজ্ঞান দিয়ে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টিকে বোঝার প্রয়োজন রয়েছে অর্থনীতি এবং রাজনীতি দিয়ে। এতগুলো জটিল বিজ্ঞান যে বিষয়ের সাথে যুক্ত সেটিকে কোনো সরল সমীকরণ দিয়ে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। আবার বিষয়টিকে কোনো গবেষণাগারে রেখে দেওয়াও যাবে না। #মিটু আন্দোলন জনগণই করবে, কিন্তু তত্ত্বটা আসা দরকার, ন্যারেটিভ তৈরি হওয়া দরকার বিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে আন্দোলন সেটি প্রয়োজনীয়, তবে তা সবসময় সামাজিকভাবে গ্রহণীয় নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের #মিটু আন্দোলন বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশে মূলত শিক্ষিত সুবিধাপ্রাপ্ত পুরুষের প্রতি একই ধরনের নারীদের অভিযোগের কথা। এই একই লোকগুলোর বিরুদ্ধে তাদের থেকে অধঃস্তন এবং অপ্রতিষ্ঠিত লোকেদের অভিযোগের কথা নয়, সেগুলো সামনে আসবে না, যদিও সেগুলোই বেশি পাষবিক, ভযঙ্কর এবং ধংসাত্মক। এখানে সেইসব ব্রুটাল মানুষ—যারা ধর্ষণ করে, ধর্ষণ করে মেরে ফেলে তাদের কথা যেমন থাকবে না, তেমনি সেইসব নারী যারা প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, আবার একজন মা হিসেবে সন্তানের ক্ষুধা মেটাতে সেই নির্যাতনকারীরই দ্বারস্থ হতে হচ্ছে, সেসব নারীদের কথাও আসবে না। সেদিক থেকে এই মুভমেন্ট একটি এলিট মুভমেন্ট, তবে প্রয়োজনীয় এলিট মুভমেন্ট।
আরেকটি বিষয় খুব জোরেসোরে চলে আসছে যে কোনো মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ কেউ করলে সেটা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হয়? উত্তর হচ্ছে, মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ করা যাবে না—সেটি যেমন কেউ বলে দিতে পারে না, পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ কেউ করলে সেটি মেনে নিতেও সবাই পারে না, সেক্ষেত্রে তীরটা অভিযোগকারীর দিকে উল্টে যাওয়ার ভয়ও থাকে। যদি কেউ সেই ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, অভিযোগ করে করতেই পারে—বিবেচনার প্রশ্নে না গিয়ে তাকে আমি সাহসীই বলব।
অন্যদিকে কারও যদি আত্মপক্ষ সমর্থনের অথবা আত্মসমর্পণের সুযোগ না থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনার সুযোগ নেই বলে মনে করাটা কিছুটা মানবিকও বটে। লক্ষ্য ঠিক রাখতে হলে জীবীত শক্তিশালী মানুষের বিরুদ্ধে কয়টা #মিটু হলো সেটিই মূলত আন্দোলনের সারবস্তু হওয়া উচিৎ। #মিটু আন্দোলন কয়টা ধর্ষণের ঘটনা সামনে আনলো সেটি গুরুত্বপূর্ণ, #মিটু আন্দোলন কয়জন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে না পারা নারীদের #মিটু প্রকাশ করতে পারলো সেটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মুশফিকা লাইজু শিমুল নামে যিনি জনপ্রিয় নাট্যকার সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন তিনি বিবেচকের কাজ করেছেন কিনা সেটি আলোচনা করার আগে বলা প্রয়োজন যে মুশফিকা লাইজু শিমুল নির্যাতনের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে একটা লিখিত অভিযোগ করেছিলেন কিনা। হয়ত লিখিত অভিযোগ করতে তিনি সাহস পাননি–অন্তত অনেক বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিশ্চয়ই আলোচনা করেছিলেন, উচিৎ ছিল লেখাটির সাথে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের স্টেটমেন্ট যুক্ত করা, এত বড় একটি অভিযোগ একজন মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তোলার আগে সেটিকে মানুষের সামনে প্রমাণসাপেক্ষভাবে উপস্থাপন করাটা খুব জরুরী। একটু কষ্ট করে, একটু সময় নিয়ে লিখলেই সেটি হয়ে যেত। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথেষ্ট সময় দিয়ে কাজটি না করার মানসিকতা ভালো নয়।
তবে মুশফিকা লাইজু খুব ভালো একটি কাজ করেছেন, তিনি বুঝাতে পেরেছেন যে অপরাধ অপরাধই তাতে ব্যক্তি যেই হোক না কেন, এবং বলার সময়টা যখনই হোক না কেন। ফলে এখন আমরা বলতে চাই, একাত্তর সালে ঘটে যাওয়া শুধু গণহত্যার ঘটনা নয়, প্রতিটি ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের ঘটনারও বিচার হতে হবে, সমাজে সেই পরিস্থিতি সরকারকে সৃষ্টি করতে হবে যাতে বেঁচে থাকা নারীরা তাদের সেই বেদনার কথা, সীমাহীন কষ্টের কথা বলতে পারে, যাতে যুদ্ধ শিশুরা তাদের মায়েদের কথা কষ্ট নিয়ে এবং একইসাথে গর্বের সাথে উপস্থাপন করতে পারে। যাতে করে জীবীত বা মৃত সেইসব নির্যাতনকারী সম্পর্কে দেশের মানুষ জানতে পারে, যাতে আদালত দৃষ্টান্তমূলকভাবে বেঁচে থাকা নির্যাতনকারীদের বিচার হতে হবে।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ সাবেক মিস আয়ারল্যান্ড প্রিয়তির বক্তব্য:
https://youtu.be/u3sNCIjz5Y4?t=6