চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড এবং একটি রংচটা সাইনবোর্ড

পুরোন ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড

২০১২ সালে ইন্টার্নশিপ শেষ করে ঢাকায় ফিরে আবিষ্কার করলাম একখানা ‘শুধু’ এম.বি.বি.এস ডিগ্রী আসলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বিচারে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় ডিগ্রী। 

এই ডিগ্রিধারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কী করবে বুঝতে না পেরে প্রথম প্রথম মোটামুটি কাছাকাছি গোছের কাজকর্মগুলোই করতে শুরু করে! কেউ হয়তো বাড়ির পাশে প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিস শুরু করে অথবা দূর দূরান্তে ১-২ দিনের চুক্তিভিত্তিক কাজে যায় অথবা মেডিকেল অফিসার হিসেবে অমানুষিক শ্রম দিয়ে বড় বড় হাসপাতালে নাম মাত্র বেতন পায়।

আমি প্রথমটা বেছে নিলাম।

আর এভাবেই আমার নতুন একটা ঠিকানা হয়ে গেল চকবাজারের চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের ঠিক সামনের মঞ্জু ভাই এর ঐতিহ্যবাহী ‘হায়দার মেডিকো’। চকবাজারের মহাব্যস্ত চার রাস্তার মোড়ের এই ফার্মেসিটা এলাকার সবাই এক নামে চেনে। এই এলাকায় তখন মহিলা ডাক্তারের ব্যাপক সংকট। আর সেটাই আমাকে সেসময় মাত্র ৪-৫ মাসে বেশ ভাল জনপ্রিয়তা দিল বলে আমার ধারণা।

পুরোন ঢাকায় অগ্নিকাণ্ড

মঞ্জু ভাই ছিলেন পারফেক্ট ‘চকবাজারি মানুষ’। মানে এক কথা এক জবান এবং বড় সাইজের এক আবেগের ডিপোর পারফেক্ট কম্বো। প্রায় প্রায়ই যার আচার আচরণ, কথার ধরণ হুমায়ুন আহমেদের এক একটি মজার চরিত্রের মত মনে হোত। এই যেমন, তার ভাষ্যমতে– “ম্যাডাম, আমার পরিবার বেসম্ভব রাগী! কিন্তু রাঁধে এক্কেবারে ফাস্ট ক্লাস। মেয়েটার প্রতিভা আছে ম্যাডাম! রাগের জন্যেই শাইন করতে পারতেছে না!”

সেই ‘রাগী পরিবার’ কে সারপ্রাইজ দিতে মঞ্জু ভাই সদা তৎপর। এই যেমন, পরিবারের নতুন জামা খুব পছন্দ কিন্তু রুচি নাকি ভালো না। সে কারণেই কয়দিন পর পর মঞ্জু ভাই আমার সামনে ৮-১০ টা জামা মেলে ধরে আবদার করতেন– “মাইন্ড কইরেন না ম্যাডাম! আপনি একটু বেছে দেন। পরিবার সুন্দরী! যা পরবে মানাবে, কোনো টেনশন নাই।” প্রতি জুম্মার দিনে খুতবা শুনে মঞ্জু ভাই জীবন নিয়ে দোটানায় পড়ে যেতেন– “ম্যাডাম! ইমাম সাহেব তো ঠিকই বলছেন! ভালো হয়ে যাবো! কালকেই ভালো হয়ে যাবো। কয়দিনই বা বাঁচবো। মইরা গেলে তো আমার খবর আছে।”

অল্প ক’দিনেই আমি আবিষ্কার করলাম যে, এলাকার মানুষ মেয়েদেরকে ভয়াবহ সম্মান করে। আর ডাক্তার হলে তো কথাই নাই। আর ‘শুধু এম,বি,বি,এস’ বলে আমাদের ডিকশনারিতে শব্দ থাকলেও এই মানুষগুলোকে দেখতাম শুধু খুঁজতো comfort। Trust। Care।

আস্তে আস্তে একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হল, সেই সাথে নির্ভরতা। মা তার এস.এস.সি পরীক্ষার্থী সন্তানকে দোয়া নেয়ার জন্যেও চেম্বারে আনতেন!আবার উলটোটাও হোতো! এই যেমন, মসজিদের ইমাম সাহেব নিয়মিত তার ‘পরিবার’ কে আনতেন (‘স্ত্রী’ কে পরিবার বলাটা খুব কমনলি পেতাম এখানে)। সেই সাথে উনি মানুষের জন্যে মোটামুটি যতো ভালো ভালো দোয়া করতে জানতেন আমার সামনে সেসবের একটা মহড়া হয়ে যেতো! চেম্বারের ঠিক সামনের ফলের দোকানি দেখতাম দোকান খুলেই আমার জন্যে ভাল দেখে আমগুলো আগে সরিয়ে রাখতো।

ওয়াহিদ ম্যানশনের বাড়িওয়ালারা ‘ডাক্তার ম্যাডাম’ কে কেন এতো শ্রদ্ধা করতো আল্লাহ ভালো বলতে পারবে! মঞ্জু ভাই এর তিন বন্ধু রোদ বৃষ্টি ঝড়ে চেম্বার থেকে বাসা পারলে গার্ড অব অনার দিয়ে নিয়ে যেতেন। পাশের হোটেল থেকে মালাই চা আসতো। টাকা সাধলে এমন মুখ করতো যেন তিতা করল্লা খাওয়ায় দিছি! পাড়ার ছেলেগুলো সামনে পড়লে হাতের সিগারেট লুকাতো! এলাকার মহিলাদের আতিথিয়েতা আর আন্তরিকতার কথা আর নাই বলি! তারা আবেগের ব্যাপারে আরেক কাঠি সরস।

মজার একটা ব্যাপার হল আমি যতটুকু দেখেছি, ৭ বছরে জায়গাটার একটা সূতাও বদলায়নি। এর কারণ হিসেবে আমি আরেকটা জিনিসের মর্ম বুঝেছি সেটা হলো পারিবারিক বন্ধনের প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা। টাকা থাকলেই এরা চলনে বলনে আধুনিক হয়ে যায় না! পুরোনো জিনিস বদলে ফেলে না!

পৈতৃক একটুখানি জায়গা, এক টুকরা ইট, কোনো ব্যবসা, কোনো রীতি এরা চাইলেই বদলাতে পারে না। পুরান ঢাকার নগর ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি হলেও এ ধরনের যেকোনো পরিবর্তন মেনে নেয়ার মত মানসিক অবস্থায় এলাকাবাসীকে নেয়াটাই আমার মতে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এমন না যে কোনো সিন্ডিকেটই শুধু এতে মদদ দিচ্ছে। আমি খুব স্বাভাবিক পর্যবেক্ষণে যা বুঝেছি, নগর পরিকল্পনার দায়িত্বে যারা আছেন তাদেরকে এই পুরো এলাকার এই ইমোশনাল এটাচমেন্ট এর জায়গাটা আগে বুঝতে হবে। নতুবা গায়ের জোরের সমস্ত স্ট্র‍্যাটিজি ফেইল করবে।

গল্পে ফিরি।
চেম্বারটা ছেড়ে দেয়ার সময় এল। মঞ্জু ভাই রীতিমতো শোকাহত। অতি আবেগী মানুষ তিনি। আমাকে বললেন, “ম্যাডাম! আপনি থাকবেন না ঠিক আছে কিন্তু আপনার সাইন বোর্ড আমি এখান থেকে নামাবো না। যতদিন থাকবে থাকুক। আমি চাই রোগীরা আপনাকে মনে করবে। তারা জানবে যে, তাদের ডাক্তার আপা তাদের সাথেই আছে!”

আমি ভাবলাম পাগলের প্রলাপ! পরে অন্য কলিগদের যাদের আশেপাশে চেম্বার ছিল তাদের কাছে শুনতাম ঘটনা সত্য! মঞ্জু ভাই তার পাগলামি বা জবান যাই বলি সেটা শতভাগ বজায় রেখেছিলেন। একটানা ৭ বছর সাইনবোর্ডটা আসলেই সেখানে ঝুলানো ছিল!

মাত্র ১০ দিন আগেই মঞ্জু ভাই হঠাৎ অনেক দিন বাদে ফোন দিলেন। পরিবারের প্রশংসায় বরাবরের মত পঞ্চমুখ। তার নাকি এখন অনেক টাকা হয়েছে। আরও বড় ক্লিনিক হবে। আমি যদি নাও বসি আমার সাইনবোর্ড নাকি থাকবে, প্রয়োজনে ডিগ্রি এড হয়ে সংস্কার করা হবে! আমি নিশ্চিত হলাম, এই সাইনবোর্ডে নির্ঘাৎ জ্বীনের আছর আছে!

আমি গত ৭ বছরে নানা সময়ে এই এলাকার অসংখ্য মানুষের সাথে ফোনে কানেক্ট করেছি! এমন না যে, শুধু প্রেস্ক্রিপশনই চাইতো সবাই! ফোন করতো দোয়া চাইতে, দোয়া দিতে! আমি ভাবতাম মানুষ কীভাবে এতো সহজ সরল হয়। তাও আবার পুরো একটা জনপদের এতোগুলো মানুষ! গত ৩৬ ঘন্টায় একের পর এক সেই সময়কার পরিচিত এসব মানুষদের মৃত্যুর খবর পেয়েছি, নিখোঁজ হবার খবর পেয়েছি। 
আমি খুব শক্ত মনের মানুষ না। প্রত্যেকটা খবর আমাকে হতবিহ্বল করেছে। স্মৃতি রোমন্থন করে সেই ভার হাল্কা করতে যেয়ে বারে বারে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে!

রাত ১০ঃ৩০ টা। চকবাজারের জন্যে প্রাইম টাইম। আমি এখনও চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি, যদি কেউ অন্য কোনো কাজে ঐদিন ওখান থেকে আগেই না সরে থাকে তবে যাদেরকে আমি চিনতাম তাদের কে কে কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি দেখতে পারি দিনশেষে সেই চার বন্ধুর রোজকার আড্ডা! ফলের দোকানি, চাওয়ালা, চটপটি ওয়ালা! পাঞ্জাবির দোকানের সেই বয়স্ক চাচা এবং আরও অনেকে! অবাক হয়ে ভাবি, এতো বছর গেল, মঞ্জু ভাইয়ের সেই আড্ডাটার রুটিনটাও কীনা বদলায় নি! আহারে! আমার পরিচিত কিছু মুখ! আর তাদের নৃশংস ভবিতব্য!

শুনেছি গত পরশু রাতের প্রথম সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়েছিল হায়দার মেডিকোর ঠিক সামনে। এক অর্থে, আমার লাল-নীল-সবুজ সাইনবোর্ডটার ঠিক সামনে!

পুরো এলাকাটাই আগুনে নিঃশেষ হয়ে গেছে! হায়দার মেডিকো পুড়ে ছাড়খার। আমার সেই সাইন বোর্ডটার স্বভাবতই কোনো অস্তিত্ব নেই। ভেতরে পাওয়া গেছে আগুনে পোড়া ৪টা মাথার খুলি! কোনটা কার কেউ তা জানে না। মঞ্জু ভাইয়ের ফোন সেই থেকেই বন্ধ! উনি ফোন ধরলে বলতাম– “আপনি তো কথা রাখলেন না মঞ্জু ভাই! খুব খারাপ কথা! আল্লাহ কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখতে বলছেন!”
মঞ্জু ভাই নিশ্চিত ঘাবড়ে যেতেন। আল্লাহর শাস্তির অসম্ভব ভয় ছিল মানুষটার!

এতো বছর আগে মাত্র ৪-৫ মাস, সপ্তাহের কয়েকটা দিন গিয়েছি ওখানে। এমন কোনো বড় সময় এটা না! এরপরে চেম্বার ছেড়ে ব্যস্ত হয়েছিলাম জীবনের অন্য আয়োজনে। সেখানে এসেও আল্লাহর ইচ্ছায়, মানুষের সম্মান পেয়েছি, ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু আমার পেশাগত জীবনের শুরুতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকার মানুষের ভালোবাসার যে সুনামি আমি পেয়েছি সেটা অনন্য!

একারণে যে, তখন আমার পরিচয় দেবার মতো তেমন কিছুই ছিল না। এই মানুষগুলো আমাকে স্রেফ তাদের উদারতা থেকে ভালবেসেছেন, আপন মনে করেছেন। আমার ফেলনা সাইনবোর্ডটা এতো বছর তারা আগলে রেখেছেন। মানুষগুলো হারিয়ে না গেলে বুঝি এভাবে এর গুরুত্বটা আমি বুঝতাম না!

কোন এক কালের ‘শুধু এম. বি. বি এস ‘ এক ডাক্তারের রং চটা সাইনবোর্ডের পেছনেই যদি এতো মায়ার গল্প থাকে, ধংসস্তুপে চাপা পড়া বাকি গল্পগুলোতে না জানি কত মায়া ছিল! এতো অজানা-অব্যক্ত গল্পগুলো চেপে যেতে পৃথিবীরও কি কষ্ট হয়?

বাম দিকের বিল্ডিংটার দিকে তাকালে কেউ না দেখতে পেলেও আমি সারাজীবন সেই সাইনবোর্ডটা দেখতে পাব। ঠিক সেই একই জায়গায়! একই রং এর! মাত্র ১০ দিন আগে, একজন অতি আবেগী মানুষকে আমি সেই সাইনবোর্ডটা ঝুলিয়ে রাখার আজীবন অনুমতি দিয়েছিলাম।


Shusama Reza Rakhi   সুষমা রেজা পাখি

Head of Early Intervention Wing at Hope Autism Center

Head of Early Childhood Development at LifeSpring

Trainer of Early Childhood Development at Shuchona Foundation

Studied MD Residency at Bangobondhu Sheikh Mujib Medical University-BSMMU

Studied MBBS at Chittagong Medical College