একটা শিশু যখন মায়ের গর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসে, তখন তাকে ঘিরে গড়ে ওঠে অনেক স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষ-ভালোবাসা। এই শিশুটি বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন দেখা যায় যে সে অন্যদের থেকে আলাদা, তার বিকাশ ঠিকমত হচ্ছে না, তখন তৈরি হয় ভয়ানক দুশ্চিন্তা-হতাশা।
সমাজে এজন্য মাকে দোষারোপ করা হয়। পরিবারকে দোষারোপ করা হয়। ভাগ্যকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু এগুলো সবই ভুল ধারণা। আর এ সময় অভিভাবকরা ঠিক বুঝে উঠেন না তখন কী করা দরকার, কোথায় যাওয়া দরকার। আর এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধের উপায়ই বা কী। এসব বিষয়সহ আরো কিছু বিষয় নিয়ে সম্প্রতি ফলোআপনিউজের সাথে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) পরিচালক, প্রথিতযশা চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহীন আখতার। এখানে অধ্যাপক ডা. শাহীন আক্তার ‘র বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।
মূলত অটিজম ঠিক কেন হয় বা এর সুনির্দিষ্ট কারণ কী -এখনো এটা উদঘাটিত হয়নি। তবে এটা বলতে পারি যে, জেনেটিক কারণেই হয়। এখানে অনেকগুলো জিন কারণ হিসেবে থাকতে পারে। এছাড়া পরিবেশগত কারণেও অটিজম হতে পারে। এসব কিছু মিলিয়েই হয়। তাই ঠিক একটা কারণে অটিজম হয় এমনটা বলা কঠিন। আর এটার কারণ বের করতে এখনো অনেক গবেষণামূলক কাজ চলছে।
যদিও অটিজমের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায়নি, তবে কিছু বিষয় আমলে নেওয়া হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে, সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হলে, অটিজমের আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই বলা যায় যে, অটিজম প্রতিরোধে শিশুর জন্মের আগ থেকে জন্মের পর পর্যন্ত অনেক কিছু করার আছে ।
শিশুর বিকাশ কেমন হচ্ছে তা লক্ষ্য রাখা দরকার। এটা বাবা মা সচেতন হলে সম্ভব। মনে রাখতে হবে যত দ্রুত শিশুর বিকাশজনিত সমস্যা শনাক্ত করা যায় ততই মঙ্গল। অটিজম আক্রান্ত শিশুকে অনেক সময় দিতে হবে, তাদের সাথে কথা বলতে হবে। সময় দেয়ার অর্থ পাশে বসে থাকা নয় বরং তার সাথে অনেক বেশি ইন্টারঅ্যাকটিভ হতে হবে।
অটিজম এমন একটা সমস্যা যেটা ছয়মাস-নয়মাস ধরে ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যাবে এমনটা নয়। এ বিষয়গুলো পরিবারকে ভালো করে জানাতে হবে। শুধু মা বাবা না, পরিবারের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। পরিবারের আরো যারা থাকে -ভাই বোন দাদী নানী সবাই মিলে একসাথে সময় নিয়ে কাজগুলো করতে হবে। শিশু কেন কথা বলছে না, কেন আমার দিকে তাকাচ্ছে না, এগুলা শুরুতেই শনাক্ত করে ডাক্তার দেখাতে হবে।
গ্রামাঞ্চলে সাধারণত মনে করা হয়, শিশু এখনো কথা বলছে না, হয়তো বড় হয়ে কথা বলবে। যখন একটা শিশুর নিউমোনিয়া বা জ্বর হয় তখন কিন্তু আমরা দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যাই। অথচ যখন একটা শিশু কথা বলে না, কারো দিকে তাকায় না, কোন কিছুতে আগ্রহ দেখায় না তখন কিন্তু পরিবারের লোকেরা তেমন খেয়াল করেন না। তাই তাদের সচেতন হতে হবে এবং কারো উপর দোষ না চাপিয়ে শিশুটার চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
এছাড়া সাধারণ মানুষের সচেতনতার প্রয়োজন আছে। সাধারণ মানুষকে আরো সচেতন করা দরকার। অটিজম এমন একটা সমস্যা যেটা সহজে বোঝা যায় না, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় ভালোই তো আছে। তাই অটিজম শনাক্ত ও চিকিৎসা করতে সাধারণ মানুষের সচেতনতা জরুরি।
অটিজম একটা আচরণগত সমস্যা। অটিজমের বিরুদ্ধে কোন জাদুকরি ওষুধ নেই। এটার জন্য ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করতে হয়, বাবা মায়ের সাথে বারবার বসতে হয়। সাধারণ মানুষকে এগুলো বুঝাতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডিজঅ্যাবিলিটির ওপর দুটি অধ্যাদেশ জারি করেছেন। তবে আরো অনেক কিছু করার আছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে অটিজম নিয়ে কিছু স্কুল আছে। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে অটিজম নিয়ে আরো উদ্যোগ নিতে হবে। অটিজম ডায়াগনোসিস করা কঠিন। তাই যেসব স্কুলে অটিজম বিষয়ে প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই সেখানে প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার। কারণ, অনেক শিক্ষকই জানেন না কিভাবে অটিজম অ্যাড্রেস করবেন।
অধ্যাপক ডা. শাহীন আক্তার
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) পরিচালক।