কী পরিমান ডিসাইডেড ছিলাম আমি, ডিপার্টন্টে পড়াশুনা করতাম না, ক্লাস করতাম না, শুধু একটা চিন্তা থেকে যে, আমি তো বিশ্বাবিদ্যালয়ের শিক্ষক হব না, অনার্স পাশ করেই একটা চাকরি নিয়ে গ্রামে চলে যাব। তাহলে আর ক্লাস পড়াশুনা করে লাভ কী! চিন্তা যে একেবারে ভুল ছিল তা কিন্তু নয়। আমার প্রয়োজন ছিল পারিবারিক দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে শেষ করা। প্রাকৃতিকভাবে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়, সেটি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। শুধু আমি জানি— কতটা বিপর্যস্ত একটি পরিবারকে খাদের কিণারা থেকে আমি টেনে তুলতে সক্ষম হয়েছিলাম শুধু টিউসনি করে এবং কিছু সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে। সেরকম একজন মানুষের কাছ থেকে বড় কোনো ভুল কেউ প্রত্যাশা করতে পারে না।
সবকিছু এলোমিলো হয়ে যায়, একটা বিয়েটার কারণ— আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না, সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম, অতএব, দোষী আমিই। ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু তাই বলে এমন একটা সিদ্ধান্ত আমি এমন সময়ে নিয়েছিলাম, যা কোনোভাবেই আসলে মেনে নেওয়া যায় না। শুধু আমার পরিবার বা আত্মীয় স্বজন নয়, পুরো গ্রামবাসী হতাশ হয়েছে। আমি যে চ্যালেঞ্জ থেকে এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম, তাতে মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল, যারা বিষয়গুলো জানত, কিন্তু সব শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য ঐ একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট ছিল।
এরপরে আমি আর সিদ্ধান্ত বদল করতে চাইনি। কিন্তু এই বিয়েটাকে ঘিরে যে চ্যালেঞ্জগুলো এসেছে সেগুলো নিতে গিয়েই যাবতীয় ছন্দপতন ঘটেছে। আমি স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে একস্ট্রাঅর্ডিনারি কিছু করার দিকে ধাবিত হই। পারিবারিক দায়িত্ব অসমাপ্ত রেখে সে সুযোগ কোনোভাবেই ছিল না। ফলে সবকিছু গুবলেট হয়েছে।
তবে এতসবের মধ্যেও আমি একটি কাজ করেছি— তা হলো কিছু না কিছু কাজ করে গিয়েছি সব সময়, যার উপর এখনো দাড়ানো সম্ভব। কিন্তু এই সম্পর্কটা? এটা তো আসলেই কিছুই বিল্ড করেনি, ফলে এটা বয়ে বেড়ানো কঠিন। সুবর্ণাও বিগড়াইছে ভালোমতো। ওকে তো এখন আমার এডিকটেড মনে হয়, খ্যাপাটে এবং পাগলাটে মনে হয়। সম্ভবত কোনো আশা পূরণ হয়নি।
কিন্তু যাবে কোথায়? ফলে একসাথে থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ঈশপ অটিস্টিক হওয়ার পর আমার মনে হয়েছে, নাহ! শুধু আমি দায়ী নই, অন্য কোনো অনুঘটকও আছে। নইলে একটা সুস্থ সবল বাচ্চা হঠাৎ একটা বয়সের পরে অন্যরকম হয়ে গেল! বিজ্ঞানভিত্তিক, কিন্তু মেনে নেওয়া কঠিন।
এখনও আমি কাজ বন্ধ করি না। লক্ষ্যাভিমুখে ছুটতে থাকাটাই জীবন। কিন্তু কয়টা প্রতিবন্ধকতা পার হওয়া যায় তারও নিশ্চয়ই একটা সীমা আছে। আমি তো আর আলিবাবার সিনবাদ না। ফলে চূড়ান্ত ব্যর্থতার জন্য প্রস্তুত থাকতেই হবে। ঈশপ অটিস্টিক, হয়ত এটাও ম্যানেজ করা গেল, এরপরে যে আরো বড় কোনো প্রতিবন্ধকতা আসবে না— গ্যারান্টি কি? কিন্তু কাজ করে যেতে হবে, পরিকল্পনামাফিক এগোতে হবে, না হলে বেঁচে থাকার কোনো মানে থাকে না।
যে কঠিন পরিশ্রম আমি গত ২২ বছর করেছি! সীমাহীন। এখন যে কী পরিমাণ ক্লান্ত সেটি বলে বুঝানো কঠিন। কিন্তু ক্লান্তি থেকে আবার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। বৈরাগ্য আমার মধ্যে নেই, কিন্তু বাস্তবতার নিরীখে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে মন চায় যে কতবার! পরিবারে আমিই ছিলাম অবলম্বন, এখনো তাই, ফলে আমি যে ভেতরে ভেতরে অনেকখানি ভেঙ্গে গেছি সেটি কাউকে বুঝতে দেওয়ার সুযোগ নেই। ওরা বেঁচে থাক, হয়ত আমি কখনো ধপাস করে পড়ে যেতে পারি।
এখন শুধু ভাবি, ওদের জন্য মিনিমাম কিছু— একটা বাড়ি, কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, এরকম কিছু একটা যদি করে যেতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব কঠিন —এটাও বুঝতে পারি। মাথা বিগড়ানো দুই তিনটা মানুষ একেবারে অথৈ সাগরে পড়ে যাবে। সবকিছুর পরেও এখনো তো ওদের আমিই টেনে রাখি। সুবর্ণা হয়ত ওর পরিবারের সাপোর্টে বেঁচে যাবে। মা-বাবা তো আর দিনশেষে কাউকে ফেলে না। আমি মরে গেলেও ঈশপকে নিশ্চয়ই তার মা ফেলবে না। কিন্তু একজন বেওরিশ বৃদ্ধ মানুষকে কে দেখবে? বাংলাদেশের সমাজে মানসিক রোগীদের এখনো ভালো চোখে দেখা হয় না, শক্ত কোনো অবিভাবক না থাকলে তো আরো সমস্যা। ফলে ওরা আর কোনো সাপোর্ট পাবে না। এখনো আমার মধ্যে শক্তির যোগানটা আসে এসব ভাবনা থেকে। নাহলে আমার আর মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারার কথা নয়।
তুলনামূলক জীবনযাপন করতে আমি চাই না, কখনো চাইনি। কে কোথায় কী করল, তাতে আমার ঈর্ষা বা অনুকরণ কোনোটাই নেই। কিন্তু নিজের বাঁচাটা তো বাঁচতে পারতে হবে। এখন তো পুরো বিশ্ব সংকটে, বাংলাদেশ বিপর্যস্ত, আরো বিপর্যস্ত হবে, আমারো হয়ত দুর্ভোগ বাড়বে। জানি না, জানতে চাই না।
দিনশেষে “আড়ম্বরে বেঁচে থাকাটাই শুধু অর্থপূর্ণ, বাকী সব অর্থহীন” এ ভাবনার জীবন আমার নয়, তবু গড়পড়তা এবং ভীষণ সংখ্যাগরিষ্ঠ এ ধারা থেকে খুব দূরে সরে যাওয়াটাও খুব অন্যায় হয়েছে। দেখি খানিকটা বিনির্মাণ করতে পারি কিনা। আরো কয়েকটা বছর চেষ্টা করে দেখতে চাই, যদি বর্তমানের এ সংকটাকালটা কেটে যায়, এবং আমি বেঁচে থাকি।
চিঠিটি বন্ধু শেখ ফজলুল করিম কে লেখা।