ফোকাস ঠিক রাখাটা জরুরী, তবে …

বর্তমান সময়ে সবাই অস্থির। বাইরে থেকে যেমনই দেখেন না কেন ভেতরে ভেতরে সবাই অস্থির। অনেক বড় বড় মানুষ যাদেরকে আমরা শান্ত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিদ্ধহস্ত বলে জানি তাদের গোপন অস্থিরতার কথা জানলে সত্যিই আমরা অবাক হতাম। যুবতীর কাছে বৃদ্ধের আকুতির খবর রাখতে পারলে বিস্ময়ের শেষ থাকত না।
অনেক মানুষ ভেতরে ভেতরে খুবই মেনটালি সিক। ফলে পাগলের প্রকৃত সংখ্যা আমরা যে সংখ্যা দেখি তার চেয়ে অনেক বেশি। মানুষ উদ্ভট কত কী করে সেটি তো কিছু আমরা জানি, সবটা তো জানি না, মানুষের অপ্রকাশিত ব্যক্তি জীবন বলেও তো একটা বিষয় রয়েছে। আসলে শিশুর চেয়েও শিশুসুলভ মানুষ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা সেটি গোপন করতে শিখি শুধু।
এটা একটা সুযোগ, যদি আপনি কোনোভাবে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন, সুস্থ রাখতে পারেন তাহলে অন্যের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন। এই ডিজিটাল যুগে নিজেকে স্থির রাখাটা একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমি ঠিক কতটুকু কাজ করব, কোন কাজটা করব, এটা জানা সত্ত্বেও দেখবেন আপনি বারে বারে ট্রাক থেকে ছিঁটকে পড়ছেন। ফলে যারা নিজেকে ট্রাকে রাখতে পারবে তারা ভালো করবেই। মেধার চেয়েও এটা এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে লেগে থাকবে মেধাবীর কৃতিত্বও এক সময় তার থলিতে জমা পড়বে।
যেমন, বর্তমানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষেরও ফেসবুকের ’লাইক’ গুণতে গুণতে সময় চলে যায়। ফেসবুক বা অন্যান্য স্বস্তা গণমাধ্যমের এ যুগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের যোগ্য মানুষকেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা ঠুংকো এবং ক্ষণস্থায়ী কাজবাজ করছে। জনতার বাহবায় তুষ্ট হলে এবং তিরস্কার ও সমালোচনায় বেশি দুঃখ পেলে এই বিপদটা হয়, সময় নিয়ে বড় কাজ করা যায় না। কেউ যখন সহজে অনেক মানুষের সমর্থন পেয়ে যাবে, তখন সে ঐ সহজ কাজগুলোর প্রতিই মনোনিবেশ করবে, যদিও সেগুলো টেকসই না, জাস্ট দৈনন্দিন আলোচ্য বিষয়। এ জায়গা থেকে সচেতনভাবে নিজেকে সরিয়ে রাখা খুব সহজ কথা নয়। দেখবেন, এরকম অনেককেই খুঁজে পাবেন যারা রোজ খুবই জনপ্রিয়, কিন্তু বিশ বছর পরে কিছুই তার হাতে নেই, এমনকি টাকা পয়শাও নেই, সে ‘জনপ্রিয়তা’ও আর নেই, সমাজে তেমন কোনো কনট্রিবিউটও তিনি করেননি । তাহলে এর মূল্য আসলে কতটুকু?
আমি আমার নিজের জীবনের সমস্যা দিয়ে বিষয়টা আরেকটু বুঝাই। অনেকে ভাবতে পারেন যে, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়া মানে হয়ত সবকিছু বাদ দেওয়া, কোনোদিকে কর্ণপাত না করা। আসলে মোটেও তা নয়। একটা সুসমন্বয় করাটা জরুরী। আমি খুব অস্থির একজন মানুষ। কোনো কাজ লেগে থেকে দীর্ঘক্ষণ করতে পারি না। কিন্তু আমার একটি গুণও আছে— আমি ফিরে আসতে পারি, এটা বুঝতে পারি যে, আমি সবকিছু ঠিকভাবে করতে পারব যদি একটা লক্ষ্যে আমি পৌঁছুতে পারি, তাই দিনশেষে নিজের কাজটি করে যেতে হবে। আমি মূলত লেখালেখি করি, ফলে আমার সবসময় হিসেবটা থাকে এরকম— আজকে আমি গুরুত্বপূর্ণ কী লিখলাম। “আজকে আমি গুরুত্বপূর্ণ কী করলাম? আজকে আমি অন্যের জন্য কী করলাম? আজকে আমি শরীরচর্চা করলাম কিনা?” এই প্রশ্নগুলো দিনশেষে নিজেকে করা খুব খুবই জরুরী। জীবন অর্থপূর্ণ মনে না হলে সুখী হওয়া যায় না, সুখটা শুধু ভোগবাদ থেকে আসে না, সুখের অনুভূতিটা সবচেয়ে বেশি আসে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার মধ্য দিয়ে। “জীবনকে কীভাবে অর্থপূর্ণ করতে হয়” এর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই। সবার জীবন একইভাবে অর্থপূর্ণ হবে না, সবার পছন্দ এবং লক্ষ্য একই রকম হবে না। কিন্তু একটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা জরুরী। লক্ষ্য নির্ধারণ কিন্তু সবসময় সবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট হতে হবে এমন নয়— দৈনিক লক্ষ্য থাকতে পারে, লক্ষ্য মাসিক এবং বাতসরিকও হতে পারে। এগুলোকে টার্গেট বলা যেতে পারে। সবার জীবনের অন্তিম কোনো লক্ষ্য না থাক স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী টার্গেট সেট করাটা খুব জরুরী। 
কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, একজন রিক্সাচালক কীভাবে টার্গেট সেট করবে? অবশ্যই তার জীবনেও টার্গেট সেট করার বিষয় আছে। রিক্সা চালানোটাই যদি তার ভবিতব্য হয়, তাহলে এই পেশা দিয়েই তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। দৈনিক টার্গেট, সাপ্তাহিক টার্গেট, মাসিক টার্গেট থাকতে পারে। সে সারাজীবন রিক্সা চালাতে পারবে না, ফলে সেজন্যও একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। এটা সত্য যে আমাদের দেশের মতো দেশে পেটেভাতে যারা জীবনযাপন করে তাদের জন্য কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করা সত্যিই কঠিন। সামান্য বিপদ এসেও লোকটাকে একেবারে তছনছ করে দিতে পারে, যেহেতু সে খুবই ভঙ্গুর জীবনযাপন করে। বিপরীতে এটা অবশ্যই সত্য— টার্গেট সেট করে, পরিকল্পনা করে, বুঝেশুনে, ধীরস্থিরভাবে জীবনযাপন করলে সমস্যা মোকাবেলা করা এবং ন্যূনতম একটা লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হয়, এবং বিচ্যুতিগুলোও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
এ বইটি যে শ্রেণির জন্য লেখা হচ্ছে তার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণি পড়ে না। ফলে যারা উন্নয়নকামী হবেন, এবং যাদের উন্নয়নকামী হওয়ার সুযোগ রয়েছে, বিশেষ কিছু করার সুযোগ রয়েছে তাদের জন্যই এ বইটি। পৃথিবীর অর্থনীতিতে এবং রাজনীতিতে যে সমস্যা রয়েছে, এখনো সমাজে যে বৈষম্য রয়েছে তাতে অনেকের জীবনই শুধু বেছে থাকার নিমিত্তে, তাদেরকে টার্গেট, উন্নয়ন, লক্ষ্য, সফলতা —এসব গল্প শুনানোর সুযোগ নেই। তাই বলে যাদের সুযোগ আছে তারা যদি সে সুযোগ কাজে না লাগায় তাহলে তো সমাজ স্থবির হয়ে যাবে, সুযোগ যাদের নেই তাদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো লোক পাওয়া যাবে না। সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে না, কর্মসংস্থান হবে না, সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে না, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারিত হবে না, সমাজে নব নব আবিষ্কার হবে না, মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে না, কঠোর পরিশ্রম করে সফল হওয়ার গল্প রচিত হবে না …। এগুলো না হলে মানুষ বাঁচার রসদ পাবে না, সমাজে অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। আমাদের সমাজটা এতটা অস্থির কেন তার একটি বড় কারণ হচ্ছে— বেশিরভাগ মানুষের নিজের কোনো জগত নেই, কোনো আপন বিচরণ ক্ষেত্র নেই, এজন্য এতটা ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি, কামড়া-কামড়ি। জনসংখ্যা বেশি হওয়াতেই এমনিতেই আমাদের সমস্যা অনেক বেশি, এর সাথে ব্যক্তিজীবনে কোনো ইউনিক ইচ্ছা না থাকায় সমস্যাটা হয়ে গিয়েছে পাহাড়সম। ফলে শুধু বৈষয়য়িক সমস্যার সমাধান করে জাতিগঠন সম্ভব হবে না। পাশাপাশি একটা জাতিগত মূল্যবোধের জায়গা তৈরি, বৈষয়িক প্রয়োজনকে যতটা সম্ভব সকলের জন্য একই প্রকার রাখা এবং মানসিক প্রয়োজনের জায়গাটিতে বৈচিত্র সুষ্টির মধ্য দিয়ে একটি সামাজিক আন্দোলন খুবই জরুরী।  
ফোকাস ঠিক রাখা কেন জরুরী— জীবনকে উপভোগ করার জন্য জীবনে একটা আয়োজন প্রয়োজন। এই আয়োজন যতটা সকলের মধ্যে পরিবহন এবং পরিচালনযোগ্য হয় ততটাই তা মানুষের কাছে প্রশংসনীয় হয়। ফোকাস ঠিক রাখা ছাড়া এরক একটি লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আমরা অনেকেই কিছু একটা ‘হয়ে ওঠা’ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারি, কিন্তু এরপরেই এলোমেলো হয়ে যাই। যেমন, একটি ভালো চাকরি পাওয়া মানে হচ্ছে কিছু একটা ‘হয়ে ওঠা’, কিন্তু চাকরিটার সযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের জন্য এবং মানুষের জন্য বিশেষ কিছু করতে পারাটা হচ্ছে আসল কথা। বেশিরভাগই আমরা সেটি পারি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো অনেকেই হয়, কিন্তু একটা ভালো গবেষণা কয়জনে করতে পারে? খুব কম। এর মানে কি এই যে, বেশিরভাগই তাদের সামার্থ নেই? না, সেটি নয়। এর কারণ হচ্ছে— বেশিরভাগ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছে, কিন্তু শিক্ষক হওয়ার মধ্য দিয়ে কী সে করতে চায় সেটি সে ঠিক করেনি। এখানেই কিছু হওয়া এবং কিছু করার মধ্যে পার্থক্য। ফলে ফোকাসও দুই প্রকার— হওযা এবং করা। শুধু হয়ে ওঠা পর্যন্ত ফোকাস ঠিক রাখলে হবে না, কিছু করতে হবে। কিছু করার মধ্য দিয়েই সামষ্টিক মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনা যায়, সেটিই শুধুমাত্র প্রশংসিত হয়, ব্যক্তি সম্মানিত হয়। আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়।