জবেদ আলী মুরগীর ব্যবসায়ী হলেও জীবন সম্পর্কে তার অনুভূতি খুবই তীক্ষ্ণ। একুশ বছর আগে চব্বিশ বছর বয়সে যখন সে বিয়ে করে তখন সে মুরগীর ব্যবসায়ী ছিলো না। সে তখন বিএ পাস বেকার। বেকার হলেও বাপের একমাত্র সন্তান হিসেবে খাওয়া পরার সমস্যা ছিলো না। জায়গাজমির আয় উপার্জন দিয়ে ভালোই চলছিলো। পিতা তখনও বেঁচে ছিলেন। হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় চিকিৎসা করতে গিয়ে জবেদরা সর্বস্বান্ত হয়। অবশ্য বাপ মরণব্যধীতে আক্রান্ত হবার দুই বছর আগেই জবেদের বিয়েটা হয়ে যায়। নাসরিনের বয়স তখন মাত্র ষোলো বছর।
অল্প বয়সে সব নারীর রূপযৌবন উন্মুক্ত হয় না। নাসরিনেরও সেরকম ছিলো। পনেরো ষোলো বছর বয়সে সে এমনকিছু সুন্দরী নয়। একুশ বছর পরে সাইত্রিশ বছর বয়সে এখন সে যেন একটি তরঙ্গসঁপিত নদী।
বিয়ের পর পরই জবেদের জীবনে একটি ঝড় বয়ে যায়। পিতা ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ছয় মাসের মধ্যে মারা যান, পিতার মৃত্যুর এক বছর না ঘুরতেই মা স্ট্রোক করেন। প্যারালাইজড্ হয়ে কয়েক মাস বিছানায় পড়েছিলেন, এরপর আবার স্ট্রোক করে মারা যান। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই পিতা-মাতার চিকিৎসায় জবেদ সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়। কিছুদিন সে বাড়িতে এদিক ওদিক করে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে পারে যে, সবদিক থেকে শুধু অপমানই ধেয়ে আসছে, কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। এখনো বাংলাদেশের গ্রামগুলো অদ্ভুত— সবাই সেখানে ছোট, এজন্য সবাইকে একে অপরকে সবসময় ছোট করতে চায়।
জবেদ একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছে না— সব মেয়েরাই কি এমন হয়, নাকি নাসরিনই শুধু এরকম! বিয়ের পরে মাত্র একবার তাদের সহবাস হয়েছে। গায়ে হাত দিলেই নাসরিন খুব অস্বস্তি প্রকাশ করে। জবেদও অপমানিত হয়ে চট করে সরে যায়। আজকে নাসরিন কিছু কথা খুলে বলে। “আপনেরে কিছু কথা কতি চাই, কিন্তু আমার খুব ডর লাগছে।” জবেদ সম্মতি বুঝাতে এবং ভালোবাসা প্রকাশে নাসরিনের কাছ থেকে আরো এক হাত দূরে সরে যায়, এতক্ষণ তবু কিছুটা গাঁ ঘেষে ছিলো। নাসরিন বলে, “আপনে আমার স্বামী, আমি সব বুঝি, কিন্তু আমার যে এসব ভালা ঠেয়ে না! আমি তাহলে কী করবো?” জবেদ বউয়ের জন্য খুব দুঃখ অনুভব করে। বউকে সে একটু বেশিই ভালোবাসে। খুব হন্তদন্ত হয়ে বউয়ের হাত ধরে বলে, “আমি এসব কিছু চাই না, বিশ্বাস করো আমি এসব কিছু চাই না, আমরা শুধু একসাথে থাকবো।” নাসরিন কোনো কথা বলে না, শুধু অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
জবেদ একটা সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়ে ফেলে, তারপরও নাসরিনকে না বলে সিদ্ধান্ত পাকা করতে চায় না। নাসরিনকে খুলে বলে। নাসরিন কান্না থামিয়ে স্বামীর চুলে বিলি কাটতে থাকে। জবেদ আর গ্রামে থাকতে চায় না। চার বিঘা থেকে ফসলের জমি এখন অবশিষ্ট আছে কাটা দশেক। বাড়িতে জায়গা খুব বেশি নয়। জবেদ বাড়িটুকু রেখে মাঠের ঐ দশ কাটা জমি বিক্রি করে দিয়ে ঢাকায় চলে যেতে চায়। ভাই-বোন না থাকায় সুবিধা হয়েছে। শুধু বউয়ের সাথে আলোচনা করেই পাকা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। নাসরিন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। সারাজীবন টিভিতে ঢাকা শহর দেখে বড় হয়েছে, এখন সেখানে গিয়ে থাকবে! চিন্তা করার আর কী আছে? সব কথা বাদ রেখে নাসরিন বলা শুরু করে— কোথায় বাসা নিবা, কী কিনবা ইত্যাদি? খাট কী বাড়ি থেকে নিয়ে যাবা, না ঢাকার তন কিনবা? জবেদ হাসতে হাসতে বলে, “শোনো, আগে জমিটা বিক্রি করি, তারপর এসব নিয়ে দু’জনে মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।”
জমি বিক্রি করে চার লাখ টাকা হাতে আসে। এই মাস বাদেই জবেদ বউ নিয়ে ঢাকায় বসত গড়তে চায়। ঢাকায় এক বন্ধুর সাথে কথা বলে কোনো এলাকায় কী থাকবে তার মোটামুটি একটা পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলে। যদিও এটা একটা খসড়া পরিকল্পনা। বউকে সে বুঝে ফেলেছে— বউয়ের কোনো বিষয়ে মত দ্বিমত নেই, শুধু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে জানে নাসরিন। অবশ্য শারীরিক সম্পর্কে কেন তার এত অনাগ্রহ এ বিষয়ে জবেদ কোনো কুলকিনারা করতে পারে না, অথচ জবেদের প্রতি নাসরিনের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। সংসারের কাজেকর্মে সে খুব পাকা, রান্নাটাও খুব সুন্দর। জবেদও বউকে খুব ভালোবাসে।
নাসরিনকে এক সপ্তাহের জন্য বাপেরবাড়ি পাঠিয়ে জবেদ ঢাকা যেতে চায়। জবেদের এক স্কুল ফ্রেন্ড নয়ন বাংলামটরে একটি হাসপাতালে চাকরি করে। নয়ন থাকে শহরতলীতে— বসিলায়। জবেদ কী কাজ করবে জানে না, তাই কোথায় বাসা নেবে তাও এখনো নিশ্চিত জানে না। নয়ন ওকে হাসপাতালে চাকরি নেবার কথা বলে, কিন্তু নয়নের বেতন শুনে জবেদ নিরুৎসাহিত হয়। দুই তিনদিন ঢাকা শহরময় ঘুরেফিরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে অবশেষে বাড়ি ফিরবে যখন ভাবছে তখন তার কারওয়ান বাজারে নিজ জেলা শরিয়তপুরের এক মুরগী ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হয়। আক্কাস আলী কোনো রাগঢাকা না করে জবেদকে মুরগীর ব্যবসায় আসতে বলে। প্রথমে কিছু বিনিয়োগ করে আক্কাস আলী তার সহকারী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। আক্কাস আলী বয়সে জবেদের চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের বড়— অভিভাবকের সুরে সে বলে, “শোনো ভাইডি, শিক্ষিত হইয়া কামডা ভালা করো নাই, অহন আর শিক্ষিত মাইনসের খাওন নাই। এত চিন্তা কইরো না, জলদি এই লাইনে আইসা পড়ো। টেকা অইবো, এই বড় ভাইয়ের ওপর আস্থা রাখো, কইলাম তো— টেকা অইবো।” মনে মনে অবশ্য আক্কাস আলী জবেদের মতো একজন শিক্ষিত লোক পেয়ে খুব খুশি হয়।
নিজেরে একটু জাতে উঠাইতে জবেদকে নিয়ে কাওরান বাজার না খেয়ে দুপুরে ফার্মগেটের দামী হোটেলে খায়। কড়কড় করে এক হাজার টাকার নোট বের করে বিল দেয়। জবেদ শেষ পর্যন্ত আক্কাস আলীর সাথে ব্যবসা করতে রাজি হয়। আক্কাস আলী কথা বলেই যাচ্ছে। আক্কাস আলী কথা বেশি বলে, কথা বেশি বলা মানুষ হয় ভালো হয়, না হয় খারাপ হয়, মাঝামাঝি রকমের হয় না। জবেদকে চিন্তা করতে দেখে সে বলে, “শোনো, তোমারে এট্টা পাকা প্লান দিই— অহনই বউ ঢাকায় আইনো না, দুই মাস আমার লগে কামডা করো, হের পর বউ নিয়ে আইসো।” জবেদ কোনো কথা বলে না, হাওয়ার ওপর এক দিনের পরিচিত আক্কাস আলীকে এক লক্ষ টাকার চেক লিখে দেয়।
আক্কাস আলী জবেদের কাছে চেকটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “আরে মিঞা এত ব্যস্ত হইও না, ঢাকা শহরে এত জলদি জলদি কাউরে বিশ্বাস কইরো না। আমার বাসায় যাবা, দু’একদিন আমার লগে থাকবা, সবকিছু ঠাওর কইরা তারপর টেকা দিবা। এত তাড়া কীসের?”
কয়েকদিন আক্কাস আলীর বাসায় যাতায়াত করতে করতে জবেদের সাথে আক্কাস আলীর একটা পারিবারীক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আক্কাস আলীর বাসায় গেলে বোঝার উপায় নেই যে, সে মুরগীর ব্যবসায়ী। অত্যন্ত সুন্দর সাজানো গোছানো বাসা, আক্কাস আলীর স্ত্রীও খুব পরিপাটি। ওদের তিন ছেলেমেয়ে। মেয়েটা সবার ছোট। তিন ছেলেমেয়েই পড়াশুনা করে। সকাল সন্ধ্যে বাসায় তিনজন শিক্ষক এসে পড়িয়ে যায়। ঢাকা কলেজের দু’জন ছাত্র এবং ইডেন কলেজের একজন ছাত্রী ওদের পড়ায়। যদিও আক্কাস আলী এবং তার স্ত্রী জানে গৃহশিক্ষকত্রয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যেহেতু অভিভাবকরা সবাই গৃহশিক্ষক হিসেবে বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খুঁজতে চায়, তাই ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে পরিচয় গোপন করে টিউশনি করে। আক্কাস আলীর মতো টাকাওয়ালা অশিক্ষিতরা এই খপ্পরে বেশি পড়ে। এতে অভিভাবকেরা যে সবসময় ঠকে তা নয়, তবে মিথ্যা তো মিথ্যাই। যাইহোক, কথায় কথায় জবেদের সাথে আক্কাস আলীর ছেলেমেয়েরাও এই কয়েকদিনে ভালো পরিচিত হয়ে উঠেছে। বাইরে আক্কাস আলী প্রচুর কথা বললেও ঘরে খুব কম কথা বলে। জবেদ যখন তার ছেলেমেয়েদের সাথে বিভিন্ন কথা বলছে, আক্কাস তখন সোফায় বসে চায়ের মগ হাতে নিয়ে পত্রিকা পড়ছে। এখন কে বলবে তাকে কাওরানবাজারের মুরগীর ব্যবসায়ী?
ছেলেমেয়েরা চলে যাওয়ার পর আক্কাস আলী স্ত্রীকে ডেকে দুপুরে রান্নার পদ নিয়ে আলোচনা করে নেয়। আজ শুক্রবার, জুম্মার নামাজ পড়ে এসে জম্পেস এক খানাপিনার আয়োজন সেরে নেয়। জবেদ আক্কাস আলীর সংসার দেখে সত্যিই ভেতরে ভেতরে আপ্লুত হয়। দুই চারদিনের দেখায় এ ধরনের পরিবারের বাহিরের আনন্দ এবং অহংকারটুকুই শুধু চোখে পড়ে, যন্ত্রণাগুলো চাপা পড়ে থাকে। ফলে জবেদের মুরগীর ব্যবসায় যোগ দেওয়া এবং ঢাকায় আসার ব্যাপারে আর কোনো দ্বিধা থাকে না। আক্কাস আলীর হাতে চেকটা ধরিয়ে দিয়ে আজকেই সে শরিয়তপুর রওনা হয়ে যেতে চায়। সরাসরি সে গোসাইরহাট শশুরবাড়ীতে চলে যাবে। বউয়ের সাথে পুরো বিষয়টি আলোচনা না করা পর্যন্ত তার অস্থিরতা কাটছে না।
শশুরবাড়িতে জবেদের খুব খাতির। এমন ভদ্র সভ্য জামাই পেলে খাতির করবেই বা না কেন? বাঙালি জামাই মাত্রেই শশুর বাড়িতে গিয়ে সবকিছু নিয়ে অভিযোগ করে, জবেদ সেরকম নয়, যা খেতে দেয়, যেভাবে আপ্যায়ন করে, তাতেই খুশি। জবেদ অপেক্ষা করছে কখন রাত্রী নামে, স্ত্রীকে সবকিছু খুলে না বলা পর্যন্ত সে শান্ত হতে পারছে না। নাসরিনও জবেদকে একাকী চায়, একইসাথে তার ভয়— স্বামীকে সে ভালোবাসলেও শরীরে হাত দিলে যে সহ্য করতে পারে না! এটা সে কিছুতেই বুঝে পায় না, ঢাকায় গিয়ে এজন্য ডাক্তার দেখাতে চায়।
ঘরে লাইট জ্বলছে, জবেদ শুয়ে আছে, দেয়াল বেয়ে একটা টিকটিকি পিছন থেকে আরেকটা টিকটিকিকে ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছে। জবেদের ইচ্ছে বউকে খুব দেখতে। আধা ঘণ্টার মধ্যে নাসরিন ঘুমোতে আসে। আসার সময় নিজেদের বাড়ির গরুর এক কাপ দুধ নিয়ে আসে। বউয়ের এসব আপ্যায়ন জবেদের খুব ভালো লাগে। কিন্তু আজ যেন কিছুতেই মন ভরছে না, বারে বারে বউয়ের শরীরের দিকে নজর পড়ছে— আটোসাঁটো ভরাট শরীর, বিশ বছর বয়সে এখন সে ভরা ভাদরের এক উন্মত্ত নদী যেন। নাসরিন একটু মোটা কিন্তু শরীরের ভাজে ভাজে যৌনতার বাহার।
জবেদ বউকে কাছে ডাকে। নাসরিন বিভিন্ন কথা বলে জবেদের মন অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করো। এই কয়দিনে সে যে সুন্দর একটা কাঁথা বানিয়েছে, সেটি বের করে জবেদকে দেখায়। কিন্তু জবেদের আজ আর কোনোদিকে মন ঘুরছে না। সে নাসরিনের গা থেকে শাড়ী এক টান দিয়ে খুলে ফেলে। শাড়ীতেই নারীর শরীরটা ফুঁটে ওঠে, ব্লাউজ-পেটিকোটে তেমনটি নয়। অবশ্য জবেদ দেরী করেনি। একটু জোর করেই পেটিকোটটাও খুলে দেয়। এ যেন সাক্ষাৎ কামদেবি! ব্লাউজটা খোলার সাথে সাথে জবেদ ভিরমি খায়— কোনোদিন বউকে তার এভাবে দেখা হয়নি। নাসরিন অবশ্য এ বিষয়ে অজ্ঞাত নয়। বাইরে গেলে ডজন ডজন পুরুষের চোখ তাকে সামলাতে হয়। আজকে নাসরিন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে চায়। স্বামীর তো একটা প্রাপ্য আছে, নইলে সে বিয়ে করেছে কেন? শুকনো খটখটে যৌনাঙ্গ, কোনোভাবেই নাসরিন তৈরি হতে পারে না। খুব ব্যথা লাগে, কিন্তু জবেদ কিছুতেই আজকে তাকে ছাড়ে না। নাসরিন শেষ পর্যন্ত সহ্য করে, কিন্তু কোনো আনন্দ সে লাভ করেনি। উভয়পাক্ষিক না হলে সভ্য মানুষ এ সম্পদ নিতে পারে না, জবেদেরও তাই মন ভরেনি।
দু’জনেই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। নাসরিন কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না, সে তার নিজের শরীরটাকে বুঝতে পারে না। সবাই তাকে চায়, কিন্তু সে কেন কারো প্রতি শারীরিকভাবে কোনো আকর্ষণ অনুভব করে না! কাপড় চোপড় ঠিকঠাক করে এখন সে কাঁদতে বসেছে। জবেদ তাকে বুকে টেনে স্বান্তনা দেয়। এই আদরটুকু অবশ্য নাসরিন খুব উপভোগ করে। তার যত ভয় যৌনতায়।