ঘৃণা শব্দটা কঠিন শুনাতে পারে, কিন্তু এটা সহজাত। ভালবাসা যেমন সহজাত, তেমনি ঘৃণা এবং বিদ্বেষও সহজাত। ধর্মের প্রতি, প্রকারন্তরে সম্প্রদায়ের প্রতি কারো ভালোবাসা যেমন থাকতে পারে, আবার কারো বিদ্বেষ বা ঘৃণাও থাকতে পারে, কারণ, ভালাবাসাটা যেহেতু তার কাছে আরো বৃহৎ কিছু। মানুষের সহজাত এই প্রবৃত্তি খুন করা যায় না, মানুষ খুন করা যায় শুধু।
শুনতে খারাপ লাগতে পারে—
“আমাদের দেশের বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের আমি অপছন্দ করি। নিজেকেও এখানে অন্তর্ভুক্ত করে কথাটা বলতে চাই।”
এদেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের বেশিরভাগেরই মানুষের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আমরা এখনো শিল্পের স্বার্থপরতা, বা রোমান্টিসিজমের মধ্যে আটকে আছি, যেটি ইউরোপ ফেলে এসেছে সেই ১৮৫০ সালে।
[শিল্পের স্বার্থপরতা মানেই রোমান্টিসিজম নয়, বা রোমান্টিসিজম মানে শুধু শিল্পের স্বার্থপরতা নয়। আরো বৃহৎ অর্থ আছে রোমান্টিসিজমের। রোমানিটিসিজমে চমৎকার কিছু সৃষ্টি হয়, কিন্তু সেখানে অনেক ভুল নির্দেশনা এবং ‘হুটহাট’ থাকে যা পাঠকের পক্ষে ফিল্টার করে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। পাঠক অসত্যকে সত্য ভেবে বসে। রোমান্টিক যুগের না হলেও ধর্মগুলো এক ধরনের রোমান্টিসিজমেরই (রোমান্টিক আধিপত্যবাদ) ফসল।]
কৃষ্ণকলির বাসায় যে গৃহকর্মী আত্মহত্যা করল তার দায় তাকে নিতে হবে না? একজন শিল্পী— যদি শিল্পস্বত্বা বা মানবিক গুণ তার মধ্যে থেকে থাকে, তাহলে ভালো গান গাওয়ার পাশাপাশি গৃহকর্মীর ভালো-মন্দ দেখাও তার দায়িত্ব। আত্মহত্যা বলে পার পাওয়া যায় না।
দ্বীপ, তুমি কোনো সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাথে নাই কেন? তুমি কোনো কবিতা সঙ্ঘে আসো না কেন? পত্রিকায় লেখ না কেন? —খুব দরদ দিয়েই তিনি প্রশ্নগুলো করেছেন।
তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারিনি। কেউ যখন ভালবেসে এমন প্রশ্ন করে তখন কঠিন কোনো উত্তর দেওয়া যায় না। তবে উত্তর দেওয়াটাও জরুরী।
কবিতা সঙ্ঘে কেন যাব? দেশের কবিদের কাছে আমার প্রশ্ন, কবি-সাহিত্যিকদের ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে পরিষ্কার অবস্থান থাকে, থাকা উচিৎ। এ বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী? একজন সাহিত্যিক কখনো ফেইক হতে পারে না। ফেইক আচরণ করতে পারে না, পারে কি?
কী নির্লজ্জভাবে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক কর্মীরা স্টেজে উঠতে চায়, এটা ওটা পুরস্কার পেতে চায়। এমন কেন হবে? সাংস্কৃতিক কর্মীদের তো আত্মসম্মানের চূড়ায় থাকার কথা। কিন্তু কোথায় কী! স্বাধীনতা পদক ছাড়া তো নির্মলেন্দু গুণ জীবনটা একেবারে বৃথা মনে করে বসলেন! কেন?
মানুষের পাশে দাঁড়ানো একজন কবির অন্যতম দায়িত্ব, এমনকি কবিতা ফেলেও— এটাই উত্তর আধুনিকতাবাদ। কিন্তু কোথায় থাকে কবিকূল? ঘুরঘুর করা কবিত্ব দিয়ে জাতির কী লাভ? মানুষের কী লাভ?
উত্তর আধুনিকতাবাদে একজন কবি হয় বোহেমিয়ান, না হয় আত্মনির্ভরশীল, মধ্যযুগের মতো রাজসভার কবি নয়। কিন্তু আমাদের কবিকূল তো এখনও ‘রাজসভার’ কবি। প্রত্যেকেই একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত থেকে হাত না পাতলে চলে না। কেন তুমি বোহেমিয়ান নও? অথবা কেন তুমি রাস্তার মোড়ে একটা চা-এর দোকান দিয়ে আত্মনির্ভরশীল নও?
আসা যাক চলতি কবিতার কথায়। ব্লাঙ্ক ভার্স বা গদ্য কবিতা ইংরেজি সাহিত্যে অনেক পুরনো। ষোড়ষ শতাব্দী থেকেই তারা এ চর্চা করে আসছে। ইংরেজি ভাষার দুই তৃতীয়াংশ কবিতাই গদ্য কবিতা। এক্ষেত্রে ছন্দ গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমনকি ভাষার (শব্দ চয়ন) চেয়েও ভাব বা তাত্ত্বিক দিকটা বেশি গুরুত্ব পায়, অর্থাৎ মেসেজটা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলা ভাষায় গদ্য কবিতা রবীন্দ্রনাথই শুরু করেছেন। গীতাঞ্জলীর কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল গদ্যে। তার লিপিকা, পুনশ্চ, শেষ সপ্তক, পত্রপুট কাব্যগ্রন্থে গদ্য কবিতা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছেন অবশ্যই বুদ্ধদেব বসু এবং জীবনানন্দ দাস, যদিও জীবনানন্দের অন্তমিলের কবিতাই বেশি।
সমস্যা হচ্ছে বর্তমান সময়ের গদ্য কবিতা নিয়ে। কেন যেন ধরে নেওয়া হয়েছে দুর্বোধ্য হলেই এবং কোনো ছন্দ না থাকলেই সেটি গদ্য কবিতা।
প্রথমত, দশ লাইন ভেঙে যদি দুই পৃষ্ঠা বিশ্লেষণ করা না যায়, তাহলে তো সেটি কোনো কবিতাই নয়। কঠিন হলেই তো আর কবিতা নয়। একটি শিশু যখন ইচ্ছেমত কাগজে দাগ দেয় সেটি তো আর সুরিয়েলিজম (পরাবাস্তব) আর্ট নয়।
উত্তর আধুনিকতাবাদের আরেকটি বৈশিষ্ট আছে। সেটি হচ্ছে— অনাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গী। কোনোকিছুকে চিরায়ত ভাবার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কবিদের নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয় আছে, কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ মার্কসবাদী –এসবও আছে।
উত্তর আধুনিকতাবাদের কোনো মতবাদকে সাপোর্ট করার জন্য একজন কবি কলম তুলে নেন না। প্যাটাফিজিক্স বা ডাডাইজিম হচ্ছে উত্তর আধুনিকতাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট, অন্যদিকে আধুনিকতাবাদের বৈশিষ্ট ছিল রোমান্টিসিজিম।
প্যাটাফিজিক্স: সহজ ভাষায় বললে বলতে হয়— আমি যা দেখছি, যা বুঝছি –এর বাইরেও প্রমাণসাপেক্ষ অনেক কিছু আছে।
বোঝা দরকার, রোমান্টিসিজমের সাথে প্যাটাফিজিক্সের কন্ট্রাডিকশনটা কোথায়? রোমান্টিসিজম হচ্ছে যা মনে আসে তাই লেখা, যুক্তি এবং বিজ্ঞান দিয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ না করে। কিন্তু প্যাটাফিজিক্সে সে সুযোগ নেই। যেহেতু যেকোনো লেখার সামাজিক ইমপ্যাক্ট আছে, তাই যুক্তির নিরিখে যাচাই না করে কোনো ভাবানার লেখ্যরূপ দেওয়া উচিৎ কিনা, এটি প্যাটাফিজিক্স বা উত্তর আধুনিকতাবাদের অন্যতম বিতর্ক। এটা কিন্তু কোপ খাওয়ার ভয় না, যুক্তিতে উত্তীর্ণ হলে কেউ আঘাত করতে চাইলেও লেখক কোনো না কোনোভাবে তা লিখবেই। আবার যুক্তির মানদণ্ডে উতরে না গেলে উত্তর আধুনিক একজন সাহিত্যিক তা লিখবে না।
এখানে ভাবনার বিষয় হচ্ছে, অযৌক্তিক কোনো কিছু যেন মানুষের মাথায় গেঁথে দেওয়া না হয়। অর্থাৎ, শিল্পের স্বার্থ শিল্প নয়, শিল্প প্রাণ এবং প্রকৃতির স্বার্থে।