কিছুদিন আগেই তো গেল ২৪ এপ্রিল, মাত্র এক বছর আগে, অর্থাৎ গত বছর সারা বিশ্বের আর্মেনীয় জনগোষ্ঠী তাঁদের স্বজনদের গণহত্যার শতবর্ষপূর্তি পালন করেছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান তুর্কিদের হাতে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ আর্মেনীয় নিহত হয়। এটাই আর্মেনীয় গণহত্যা। অবশ্য হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছিল আরো অনেক আগে থেকে। ১৮৯৪ সালে ওটোমান সম্রাজ্য আর্মেনীয়দের উপর অত্যন্ত অবমাননাকর এক শাস্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। ‘বক্স অন দ্যা ইয়ার’ বা ‘কানের উপর থাপ্পড়’ নামে কথিত অসদাচরণের জন্য ঐ শাস্তির বিরুদ্ধে আর্মেনীয়রা প্রতিবাদ করলে তখনই কয়েক হাজার আর্মেনীয়কে মেরে ফেলা হয়।
১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম আর্মেনীয় রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৪র্থ থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত আর্মেনিয়া বিভিন্ন বড় শক্তির শাসনাধীনে আসে। এদের মধ্যে পারসিক, বাইজেন্টীয়, আরব, মোঙ্গল এবং তুর্কি জাতি উল্লেখযোগ্য। কয়েক শতাব্দীর পারস্য ও বাইজানটাইনের শাসনের পরে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রুশ ও তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যে বাস করছিল আর্মেনীয়রা।
অটোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ২০ থেকে ২৩ লাখ আর্মেনীয় বাস করত। ১৯ শতকের শেষের দিকে আর্মেনীয়রা স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করে। এ কারণে এবং আগে থেকেই অটোমান কর্তৃপক্ষ আনুগত্যের প্রশ্নে আর্মেনীয়দের সন্দেহের চোখে দেখত।
অটোমান শাসক সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের রাজত্বকালে অন্তত তিন লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়। এরপর ১৯০৫ সালে আর্মেনীয়রা হত্যাকারী সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে হত্যার চেষ্টা করে। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তুর্কি অটোমান সম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পক্ষ নেয়। যুদ্ধ চলাকালে অটোমানরা আর্মেনীয়দের ‘ঘরের শত্রু’ বলে প্রচারণা চালাত। ১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল অটোমান সরকার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে আর্মেনীয়দের কয়েকশো নেতা ও বুদ্ধিজীবীকে কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বন্দী করে। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বেশির ভাগকেই হত্যা ও নির্বাসিত করা হয়। আর্মেনীয়রা এই ২৪ এপ্রিল দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দুটি আইনের মাধ্যমে আর্মেনীয়দের নির্বাসিত করা হয় ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন হাজার হাজার আর্মেনীয়কে মরুভূমির দিকে (বর্তমান সিরিয়া এবং নিকটবর্তী অঞ্চল) পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে যায়, তাদের ২৫টি বন্দিশিবিরে নেওয়া হয়। তখনকার বিদেশি কূটনীতিক ও গোয়েন্দা সংস্থার মতে, আগুনে পোড়ানো, পানিতে ডোবানো, বিষপ্রয়োগ এবং টাইফয়েড সংক্রমিত করাসহ বিভিন্ন নৃশংস পদ্ধতিতে আর্মেনীয়দের হত্যা করা হয়। ১৯১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অটোমান সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নির্বাসিত আর্মেনীয়দের তাদের বাড়িতে ফিরে আসার ব্যবস্থা রাখা হয়।
১৯১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কনস্টান্টিনোপলের সামরিক আদালত আর্মেনীয়দের হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অটোমান সাম্রাজ্যের কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। আদালত তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেন। তবে যাঁরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বিচার করা যায়নি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে আর্মেনীয়দের ১৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। এর আগেও বহু মানুষকে হত্যা করা হয়।
২০০০ সালে নোবেল বিজয়ী, ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানীসহ ১২৬ জন বিশেষজ্ঞ এক বিবৃতিতে বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর্মেনীয় গণহত্যা একটি অকাট্য ঐতিহাসিক ঘটনা। ২০০৫ সালে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছে এক খোলা চিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্স বলেছিল, তথ্য-প্রমাণে এটা প্রমাণিত যে অটোমান সরকার ‘তাদের আর্মেনীয় নাগরিকদের ওপর পরিকল্পিত গণহত্যা’ চালায়।
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গত বছর প্রথমবারের মতো এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এটা আর্মেনিয়া ও তুরস্কের অভিন্ন ব্যথা। তবে আর্মেনিয়া শুধু দুঃখ প্রকাশ নাকচ করে দেয়।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়, কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পুরোপুরি বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়, তা-ই গণহত্যা।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে তুরস্ক প্রমাণ করেছে যে তারা শুধু ইতিহাসের জঘন্য গণহত্যাকারী নয়, গণহত্যার সমর্থনকারীও।
#সম্পাদনা: দিব্যেন্দু দ্বীপ
তথ্যসূত্র: দ্যা গার্ডিয়ান, প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া, history.com