https://www.youtube.com/watch?v=0v1MQdrOxJ8
সিলেটের এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে এসে সরকারি মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে কুপিয়ে জখম করেছে এক ছাত্রলীগ নেতা। ছাত্রটির নাম বদরুল এবং খবরে প্রকাশ সে ছাত্রলীগ নেতা। মেয়েটির অবস্থা সংকটাপন্ন, জানি না সে বাঁচবে কিনা।
এও হয়? হয় তো, হয়েছে তো। আমি জানি যে এসব হয়। আমি এও বিশ্বাস করি, বদরুলের মত এরকম মানুষ রাজনীতির ছদ্মবেশে সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। বদরুলও তো প্রতিষ্ঠিত। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ও শাবি ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সে!
তাকে প্রতিষ্ঠিত না বলার সাহস আমার নেই, আমি তো জানি একজন হল নেতা কীভাবে দাপিয়ে বেড়ায়, আর সে তো বিশ্ববিদ্যালয় নেতা! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বর্বরতম এই ঘটনাটিকে আপনি বা আমি কি ছাত্রলীগ নামক মেটাফোর (সচেতনভাবে মেটাফোর বলছি) দিয়ে ঢেকে দিব, নাকি সামগ্রিকভাবে বিচার করব? ছাত্রলীগের পরিচয় থাকলে তা তো বলতে হবেই, যাতে কর্তাব্যক্তিদের কাছে একটা বার্তা যায়, যদিও আমার সংশয় আছে বার্তার গম্যতা নিয়ে। ছাত্রলীগ পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক এবং মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যাটাও দরকার। যেটি ভীষণভাবে অনুপস্থিত দেখি। সেটি স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকার প্রতিবেদন থাকেব না, কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকার কলামে সে বিশ্লেষণ থাকা উচিৎ। রাজনৈতিক কলামের বাইরে সমাজ নিয়ে অনেক বেশি লেখালেখি হওয়া উচিৎ।
আমি একটু পিছনে ফিরে যাব, ২০০৮ কী ২০০৯ সালের ঘটনা। স্পষ্ট করে আমার মনে নেই। সেদিন ছিল জগন্নাথ হলে স্বরস্বতী পূজো। রাত বারোটার দিকে হঠাৎ দেখি গণ্ডগোল। মুহূর্তের মধ্যে খান বিশেক দা নিয়ে দুই পক্ষ মুখোমুখি। কারা ছিল ওরা? প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
২০০৯ সালেরই ঘটনা, আমার এক আত্মীয় জগন্নাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে গিয়ে থাকত। ও ছিল মানসিক রোগী, তবে ভালো গান করত। ফলে সহজেই অন্য ছাত্রদের সাথে মিশে গিয়েছিল। সাধারণত যা হয়, বেকার পাইলে এই রাজনীতি তাকে টান দেয় দল ভারী করার জন্য, ওকেও টান দিয়েছিল।
সন্ধ্যা নেই, রাত নেই, ও হঠাৎ হঠাৎ বের হয়ে যেত। ওর ব্রেনের সমস্যা একটু বাড়লে আমার কাছে খুলে বলা শুরু করল সব। একদিন একটা দামী মোবাইল এনে আমাকে দিল। ঘটনার হোতারা কয়েকজন আমার পাশের রুমেই থাকত, যা আমি এতদিন জানতাম না। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের কয়েকজন ছাত্র এবং বহিরাগত মিলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সিনতাই করতে যেত। পদ্ধতি ছিল অভিনব। ওরা জুটি টার্গেট করত। গিয়েই কোনো কথা না বলে ছেলেটিকে থাপ্পড় মারত। এরপর ব্লাকমেইল, অতঃপর মোবাইল এবং টাকা পয়সা নিয়ে আসত। বলা বাহুল্য সেই ছেলেগুলোর অনেকেই এখন বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত!
২০০৯ সালে আমার সাথে একটি ঘটনা ঘটে। তখন হলে “অাঠারো” নামে আমি একটি ছোট পত্রিকা চালাই। ঠিক সাহিত্য পত্রিকা ছিল না ওটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যার উপর অলোকপাত করতে চাইতাম। একদিন লিখলাম, ক্যান্টিনের খাবারের মান এবং দাম নিয়ে। তাতে ক্যান্টিন মালিক, রাজনীতি, এবং এমনকি প্রভোস্ট স্যারও রাগ হয়েছিলেন বলে শুনেছিলাম। একথা বলা কঠিন এবং লজ্জাজনক যে হলের প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চলমান শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতি উভয়েরই অন্তর্নিহীত স্বার্থ আছে। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে এটা সবাই শুধু জানবে কিন্তু কেউ বলবে না।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নতুন ক্ষমতায়, জগন্নাথ হলের অবস্থা তখন ভয়াবহ। কমিটি নেই, অনেক গ্রুপ, অনেক নেতা। একটি গ্রুপের নেতা প্রণব কুমার দাস বাবলুর রহস্যজনক মৃত্যু হয়, কিন্তু তার কোনো কুল কিনারা হয়নি কখনো, হয়ত হবেও না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম কোনো হত্যাকাণ্ডের কোনোদিন কোনো বিচার হয়নি।
এরপর আমার ছোট পত্রিকায় জগন্নাথ হল ছাত্রলীগ নিয়ে ছোট্ট একটি লেখা ছিল চিঠি হিসেবে। তাতেই ওরা সুযোগটা পেয়ে যায়। এবং আমার রুমে হামলা হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম, ওরা শুধু কথা বলবে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ছেলে, অবশ্যই আমার অনেক জুনিয়র, আক্রমণ করে বসল। দেখি, পিছনে আরো অনেকে ধেয়ে অাসছে, অবস্থা বেগতিক দেখে ফাঁক গলে দৌঁড় দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সেদিন আমার রুমে এসেছিল আমার দুইজন ছাত্র। আমার পক্ষে স্বপ্নেও ভাবা সম্ভব ছিল না, ওরা আমাকে না পেয়ে ওদের উপর আক্রমণ করে বসবে। ওদের একজনকে খুব মেরেছিল! ছাত্রদের অভিভাবকের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কোনো জবাবদিহিতা অামার ছিল না।
রুমে শুধু কম্পিউটারটা ছিল, বাকী সব জিনিস, ক্যামেরা, মানিব্যাগ, মোবাইল, একটি ভয়েজ রেকর্ডার -সব নিয়ে যায়। পরে ভিসি স্যারের তত্ত্বাবধানে প্রাধ্যক্ষ স্যারের সহায়তায় আমি রুমে ফিরি, কিন্তু হলে থাকা আর সম্ভব ছিল না। পুরো লুটতরাজ ঘটে গেল না? কিন্তু দায় নেওয়ার কেউ নেই? না প্রভোস্ট স্যারের দায়, না প্রক্টর বা অন্য কেউ।
অবশ্য ২০১০ সাল থেকে ছাত্রলীগে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তন আসতে শুরু করে, তবে অবস্থা যে বিশেষ কিছু উন্নত হয়েছে তা বলা যাবে না, তবে ছাত্রত্ব থাকা অবস্থায় নেতৃত্বে আসছে, এটা শুধু ভালো দিক।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম ২০০৩ সালে। তখন ছাত্রদল হলের দখলে। জগন্নাথ হলও তাদের দখলে। প্রথম দুই বর্ষের ছাত্ররাই মূলত ছাত্ররাজনীতির মূল হাতিয়ার। নিয়ম হচ্ছে, দুই বছর বাধ্যতামূলকভাবে ওদের লেজুড় হয়ে ঘুরতে হবে অার ওরা যাচ্ছেতাই করবে। পরোক্ষভাবে এই লেজুড় শিক্ষক রাজনীতিরও।
আমিও যথারীতি একটি গণরুমে উঠেছিলাম। ঘুমোনোর নিয়ম ছিল, যে যেখানে যখন জায়গা পাবে। নিজের বলে কিছু দাবী করা যাবে না, শুধু আন্ডারওয়ার আর মোজা ছাড়া। তখন আমার প্রথম মোবাইলের বয়স মাত্র তিন মাস। টিউশনি করি এবং আরো টিউশনি পাবার আশায় আট হাজার টাকা ধার নিয়ে সিটিসেল মোবাইল কিনেছিলাম। একদিন সকালে আধোঘুমে দেখি, নিচে শোয়া একজন আমার বালিশের নিচ থেকে মোবাইল টেনে বের করতেছে। ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। বালিশের নিচে হাত দিয়ে দেখি মোবাইল নেই। ওকে শোকজ করার সাথে সাথে আমাকে মার শুরু করল, ওরা সাথে আরেকজন। ঐ সাত সকালে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে গেলাম।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনীতিতে এরা কারা? এদের দেখে কি আমরা ধারণা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এরকম? মোটেই তা না। যদিও এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ওদের মত না হলেও “অন্যায় যে সহে…” ক্যাটাগরিতে পড়বে।
তাহলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতিতে শাবিপ্রবির এই বদরুলের মত লোক এত বেশি থাকে কেন?
আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, কিছু মানুষ স্বভাবজাতভাবে হিংস্র এবং বর্বর। যেটা আপনি আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না, তা ওরা নির্দিধায় করতে পারে। রেইপ বা দলবদ্ধভাবে রেইপ -এটা তো কষ্ট কল্পনাও হয় না, কিন্তু তা তো কিছু মানুষ করে, হত্যাও করে! তার মানে সমাজের মানুষের ছোট্ট একটি অংশ এরকম। এদেরকে দমন করে রাখতে পারাটা জরুরী।
বদরুলরা কিন্তু ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল নির্দিষ্ট করে খোঁজে না, ওরা খোঁজে ক্ষমতার বাতাবরণ। যেটির আড়ালে থেকে অপকর্মগুলো করতে পারে, যেগুলো না করলে ওদের জীবন চলে না, এরশাদ সিকদারের যেমন খুন করা ছিল নেশা, একইসাথে পেশাও।
বিনা উস্কানিতে হল-এ আমি কিছু ছাত্রকে দেখেছি গায়ে হাত তুলতে, ক্যান্টিন বয়দের থাপ্পড় মারতে। জুনিয়রকে এরকম শিক্ষা দিতে শুনেছি- ফাস্ট ইয়ার শাসনে রাখার জন্য দুইএকজনকে প্রথম দিকে মারতে হবে যাতে অন্যরা ভয়ে থাকে। এরকম অনেক কলা কৌশল ওদের তৈরি করতে দেখেছি।
ওদের স্বভাব চর্চা করার জন্য দরকার ক্ষমতা। এবং রাজনীতি যেহেতু কলুষিত, তাই দলে ভিড়ে দেখে সেখানে ওদের মত অনেক আছে! এরপর ওদের মজায় পেয়ে বসে, স্বভাব চর্চিত হতে হতে, থাপ্পড় মারতে মারতে ওরা খুন করে। প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ক্ষান্ত থাকে না, জোর করে, ধর্ষণ করে, হত্যা করে।
কারা করে? বর্বর ওরা করে। ছাত্রলীগে ভিড়ে করে, ছাত্রদলে ভিড়ে করে, ছাত্রশিবিরে থেকে করে। এবং ওরা দায়মুক্তিও পেয়ে যায় সহজে। কারণ, এই ওরাই আবার বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করে। বদরুল যেমন খাদিজা আক্তারকে কুপিয়েছে, আবার এই বদরুলই (ভাবার্থে) বিরোধী কাউকে কুপিয়ে বাহবা কুড়িয়েছে হয়ত। শুধু ভাবার্থে কেন, পত্রিকা ঘেটে এরকম একটি খবর পাওয়াও গেল-
শুধু দায়মুক্তি পেয়েছে, তা নয়, পদও পেয়েছে! শিবির তাড়াতে ওদের লাগে, বিএনপি তাড়াতে লাগে। এরকম পারস্পারিক তাড়ানোর বিষয় আছে বলেই এই রাজনীতিতে ওদের আধিপত্য সহজ হয়।
এদেরকে ছাত্রদল বা ছাত্রলীগ হিসেবে সনাক্ত করার বিপদ হচ্ছে, তাতে মূল সমস্যা আড়াল হয়ে যায়। মূল সমস্যা হচ্ছে, এই ছাত্র রাজনীতি সমাজের মানুষের মধ্যে শতকরা হারে থাকা বর্বরতমদেরও জায়গা করে দিচ্ছে! ছাত্ররাজনীতি শুধু নয়, পুরো রাজনীতিতে এমন মেকানিজম দরকার যাতে ওরা জায়গা না পায়। সমাজে সাধারণ, বা অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে যাদের আমরা চিনি, তাদের মধ্যেও বদরুলের মত মানুষ আছে, কিন্তু ক্ষমতা না থাকায় তারা চর্চা করতে পারছে না। বদরুলরা ক্ষমতাসীন বলে এত ভয়ঙ্কর হয়েছে।
এর বাইরে অনেক ব্যাখ্যা থাকে, যেমন, মানসিক রোগী, নেশাগ্রস্থ, সিজফ্রেনিয়া, ইত্যাদি। তবে এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীতে বিরলতম। প্রেমিকাকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অাছে, ক্রমিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আছে, কিন্তু প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করতে উদ্ধত হওয়া যায়, এ নজির বিস্ময়কর, ভয়ঙ্করভাবে উব্দেগজনক। বদরুলকে শুধু ছাত্রলীগ বলার মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
বিচার দিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করা যায়, কিন্তু এ ধরনের অপরাধ সমাজ থেকে দূর করতে হলে সমাজের মর্মমূলে প্রবেশ করে সাামাজিক চিকিৎসার আয়োজন করতে হবে বিভিন্ন চলকের ভিত্তিতে। নইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা (১৪) মারা যাওয়া এবং আমাদের বিচার চাওয়ার মধ্য দিয়ে যেমন এরকম ঘটনার অবসান হয়নি, তেমনি খাদিজা আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়েও এরকম ঘটনা সমাপ্ত হবে না। রাজনীতি এবং সমাজনীতি না বদলালে এরকম ঘটনা চলতেই থাকবে।
#লেখা: সম্পাদক