নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি // দিব্যেন্দু দ্বীপ

নোবেল শান্তি পুরস্কার একটা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আমেরিকা তথা পশ্চিমা বিশ্বের আনুগত্য রক্ষা করে চলে শুধু এমন বিখ্যাত মানুষরাই এখন নোবেল শান্তি পুরস্কার পায় বলে কথিত হয়েছে। একথা অনেকেই বলে থাকেন যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্ব বিভিন্ন দেশে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। কথা পুরোপুরি হয়ত সত্য না, কিন্তু অনেকাংশে যে সত্য তার প্রমাণ আমরা বিজয়ীদের কর্ম এবং ব্যক্তিজীবন পর্যালোচনা করলে বুঝতে পারি।
সেসকল মানবাধিকারকর্মীই বিগত কয়েক বছর ধরে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন যাদের সংগ্রাম এবং কর্ম পশ্চিমা নীতি-আদর্শ বিরোধিতাকারী সরকারের বিরুদ্ধে যায় বা পশ্চিমা আদর্শের সাথে যুগপৎ হয়। মিয়ানমারের অং সান সুকি, ইরানের শিরিন এবাদি, চীনের লিউ জিয়াওবের নোবেল বিজয় আমাদের সেই সাক্ষই দেয়। যে সকল রাষ্ট্র প্রধান নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তারাও পুরোপুরি পশ্চিমাদের অনুগত থেকে কাজ করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে জং এবং ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মারটি আহতিসাআরির নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে।
অন্যদিকে আমেরিকা থেকে শান্তির নোবেল পান স্বয়ং প্রেসিডেন্ট অথবা সরকারের সাথে থেকে কাজ করেন এমন কেউ। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়— বিগত কয়েক বছরে যারা নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তারা প্রায় সকলেই শিক্ষাজীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে আমেরিকা বা পশ্চিমে পড়াশুনা করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের ব্যক্তিগত জীবনের দিকে নজর দিলে বোঝা যায়— শান্তির নোবেল এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি এখন মুদ্রার এপিট আর ওপিট।
২০০০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, গণতন্ত্রপন্থী মানবধিকারকর্মী কিম দ্যায়ে জং কে। ২০০০ সালে জং উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদক্ষেপ নেন। দুই কোরিয়ার মধ্যে শান্তি আলোচনা তখন এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে তখন এ আলোচনার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হিস্টোরিক হ্যান্ডশেক’। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট দ্যায়ে জং তখন অনেক উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। তার সময়ে দুই কোরিয়ার সম্পর্কে অনেক অগ্রগতি হয়েছিল। ঐ বছরের জুন মাসে দুই কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট দেখা করেন এবং এটি ছিল দক্ষিণ এবং উত্তর কোরিয়ার কোনো প্রেসিডেন্টের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ। একই মাসে আমেরিকা উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্য বাধা উঠিয়ে নিয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া বিপুল সংখ্যক বন্দিকে মুক্তি দিয়েছিল, উত্তর কোরিয়া অস্ত্র বিরতিতে সম্মত হয়েছিল, এরকম অনেক খুঁটিনাটি অগ্রগতি তখন হয়েছিল। তবে সবকিছুর পিছন থেকে কলকাটি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র নামক শক্তিশালী দেশটি। পুরো শান্তি প্রক্রিয়াটির সাথে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তাই একথা জোর দিয়ে বলা যায়, ২০০০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
২০০১ সালে শান্তির নোবেল পেয়েছিলেন কফি আনান এবং জাতিসংঘ। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পরে যে মুহূর্তে আফগানিস্তানে হামলার প্রস্তুতি চলছে এমন একটা সময়ে জাতিসংঘ এবং তার মহাসচিবকে পুরোপুরি পক্ষে রাখা ছিল এক জরুরী সিদ্ধান্ত। ঘানায় জন্ম নেওয়া আন্তর্জাতিক এ কূটনীতিকের শিক্ষাজীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে দেশের বাইরে। মি. কফি আনান আমেরিকা থেকে জেনেভা হয়ে আবার আমেরিকাতেই পড়াশুনা করেছেন। শুধু স্কুল এবং কলেজ পর্যায় পর্যস্ত তিনি ঘানাতে পড়াশুনা করেছেন।
২০০২ সালে আন্তর্জাতিক বিরোধ নিরসনের জন্য আমেরিকার ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। মিশর-ইসরাইল শান্তি চুক্তি বা ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির সমন্বয় করেছিলেন জিমি কার্টার। পশ্চিমা বিশ্বের কাছে এটা ছিল জিমি কার্টারের বিশাল এক কূটনৈতিক সাফল্য। এই চুক্তির ফলে ইসরাইলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মেনাছেম বেগিন এবং মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সা’দাত নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য বা আরব বিশ্ব ঐ চুক্তির পক্ষে ছিল না, ফলে আনোয়ার সা’দাত আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তখনই হয়ত আমেরিকার ইচ্ছা ছিল জিমি কার্টারকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া, কিন্তু কূটনৈতিক কারণে তাকে তখন নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০০২ সালে এ পুরস্কার তিনি পান।
২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পান ইরানের শিরিন এবাদি। যুক্তরাষ্ট্রপন্থী একজন মানবাধিকারকর্মী হচ্ছেন শিরিন এবাদি। শিরিন এবাদি সংগ্রাম করেছেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তবে তার সংগ্রামের সাথে তার পেশার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এবাদি তেহরান সিটি আদালতের প্রধান বিচারক হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর নারীদের ওপর নানান ধরনের নিষেধাজ্ঞা আনা হয়। তারই অংশ হিসেবে এবাদিকে অপসারণ করা হয়। বিচারকের আসন থেকে সরিয়ে ক্লারিক্যাল কাজ দেওয়া হয়েছিল তাকে। তিনি খুব্ধ হন এবং সরকারবিরোধী আন্দলনে লিপ্ত হন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আস্থাভাজন হন। মিসেস এবাদি সংগ্রাম করেছেন ঠিকই, তবে সে সংগ্রামের সাথে ব্যক্তিগত লক্ষ্যের বিষয়টি অস্পষ্ট হলেও ইঙ্গিতবহ।
২০০৪ সালে পুরস্কারটি পান কেনিয়ার মানবাধিকারকর্মী ওয়াঙ্গারি মাথাই। এটিকে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ নোবেল শান্তি পুরস্কার মনে হলেও তা আসলে নিরপেক্ষ ছিল না। মাথাই যোগ্য ছিলেন একথা বলতেই হবে, কিন্তু বলয়ের বাইরে গিয়ে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাননি। মাথাই পড়াশুনা করেছেন আমেরিকার পিটার্সবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মিসেস মাথাই হচ্ছেন মধ্য এবং পূর্ব আফ্রিকার প্রথম মহিলা যিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কেনিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন, বনায়ানের কাজে হাত দিয়েছেন। সার্বিক বিবেচনায় আফ্রিকা অঞ্চল থেকে নোবেল শান্তি বিজয়ী তিনি হতেই পারেন, তবে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আবিরাম যোগাযোগ না রেখে তিনি তা প্রাপ্ত হননি। তাছাড়া সমস্যা জর্জরিত পূর্ব আফ্রিকা থেকে কাউকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেওয়ার প্রয়োজনীয় কাজটি মিসের মাথাইকে দিয়ে সেরে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়েছিল।
২০০৫ সালে পুরস্কারটা দেওয়া হয় আন্তর্জাতিক আনবিক শান্তি সংস্থা এবং তার প্রধান জনাব এল বারাদিকে যৌথভাবে। এটি ছিল পুরোপুরিই একটা রাজনৈতিক পুরস্কার। নতুন করে কোনো দেশ যাতে আনবিক শক্তিতে শক্তিশালী হতে না পারে তা দেখার দায়িত্ব জাতিসংঘের এই অঙ্গ সংগঠনটির ওপর, তো তারা যাতে সে কাজটি জনগণকে পক্ষে নিয়ে করতে পারে তার সার্টিফিকেসন ছিল পুরস্কারটি। মি. এল বারাদি পুরস্কারটা পেয়েছিলেন সামরিক বাহিনীতে যাতে আনবিক অস্ত্র ব্যবহার না হয় সে বিষয়ে কাজ করে। মনে রাখতে হবে, এল বারাদিও তার শেষ ডিগ্রিটা নিয়েছেন নিউইয়র্কের এক আইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার পুরস্কারটিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবা যেত যদি শুধু আনবিক শক্তি অর্জনের বিরুদ্ধে কাজ না করে আনবিক শক্তি বর্জনের জন্যও কাজ করে তিনি তা পেতেন।
২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন বাংলাদেশের ড. মো: ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংক। ড. ইউনূস সম্পর্কে ইতোমধ্যে অনেক জল ঘোলা হয়েছে, তাই এ সম্পর্কে বেশি কিছু না বলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তিনি পশ্চিম বিশ্ব তথা আমেরিকার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেই পুরস্কারটি পেয়েছেন। এক্ষেত্রে কৌশলতগত কারণে বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার আগ্রহকে ড. ইউনূস বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগিয়েছেন। প্রসঙ্গত, জনাব ইউনুস পড়াশুনা করেছেন আমেরিকা ভান্দেরবিলত বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০০৭ সালে পুরস্কারটি পায় আইপিসিসি এবং আর্নল্ড আলবার্ট আলগর যৌথভাবে। এটিও কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক নোবেল। আমেরিকা চাইছে জলবায়ু সমস্যাটি তাদের মতো করে প্রচার করতে। এক্ষেত্রে আইপিসিসি এবং আর্নল্ড আলবার্ট অনেক বড় অস্ত্র। তাদের জাতীয় অস্ত্র আরও শক্তিশালী করার জন্য নোবেল প্রাইজ দেওয়ার মাধ্যমে সেটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। জলবায়ু বিষয়ে ক্রমাগতভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বকে আতঙ্কিত করে চলেছে, কিন্তু দেশটি নিজেরা মোটেই সতর্ক হচ্ছে না।
২০০৮ সালে পুরস্কারটি দেওয়া হয় দরকষাকষিতে ওস্তাদ মারটি আহতিসাআরিকে। আহতিসাআরি জন্মলাভ করেছিলেন ফিনল্যান্ড এর ভিবুরগে, যেটি বর্তমানে রাশিয়ার মধ্যে পড়েছে। তিনি ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আহতিসাআরি যখন ছোট ছিলেন তখন ভিরবুগ স্থানটি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়, এবং সেখানকার অধিবাসীরা তখন ফিনল্যান্ডের অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাৎ, ছোটবেলা থেকেই রাশিয়ার প্রতি আহতিসাআরির এক ধরনের ঘৃণা ছিল। এই সুযোগটিই আমেরিকা কাজে লাগিয়েছে। তবে একথা সত্য যে, তিনি অনেক শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতা করেছেন, কিন্তু সেগুলো অবশ্যই শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আর তিনি মূলত শান্তির জন্য কাজ করেছেন জাতিসংঘের একজন প্রতিনিধি হিসেবে, ব্যক্তিগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়। তাই শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজের ত্যাগ-তিতীক্ষা বলতে যা বুঝায় তা তিনি করেছেন এমনটি জানা যায় না। পাশাপাশি যে কথাটি সবচেয়ে বেশি করে মনে রাখতে হবে, তিনি জাতিসংঘের হয়ে কসোভোতে মধ্যস্থতা করতে গিয়েছিলেন, এবং তার মধ্যস্থতার পরেই কসোভো সার্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। যেটি ছিল আমেরিকার অন্যতম একটি চাহিদা। নামিবিয়া, ইন্দোনেশিয়ার আছেহ প্রদেশ এবং ইরাকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করেছেন। বলা যায়, তার পুরো পেশাজীবনে তিনি আমেরিকার প্রতিনিধিত্বই করেছেন। এর আগে ১৯৬০ সালে Young MenÕs Christian Association (YMCA) নিয়ে তিনি পাকিস্তান গিয়েছিলেন এবং মোটামুটি সফলতার সাথে পাকিস্তানের মতো একটি দেশে YMCA-র ভিত্তি এনে দিয়েছিলেন।
২০০৯ সালে পুরস্কারটি দিয়ে দেওয়া হয় আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মুসলিম বিশ্বে বিগত কয়েক বছরে আমেরিকা যে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছিলো তা থেকে উত্তরণ হতেই ওবামা গায়ে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সীল মেরে দেওয়া হয়েছিলো। আসলে মি. ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল তিনি শান্তির জন্য কাজ করছিলেন এজন্য নয়, দেওয়া হয়েছিল তিনি শান্তির জন্য কাজ করবেন এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে। সময় অতিবাহিত হয়েছে, ওবামা আজ আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নয়। ওবামা শান্তির জন্য কতটা কাজ করতে পেরেছেন সেটি নিশ্চয় দীর্ঘ আলোচনার বিষয়।
২০১০ সালে পুরস্কারটি দেওয়া হলো চীন সরকারের বিরধিতাকারী মানবাধিকারকর্মী লিউ জিয়াওবোকে। জিয়াওবা চীনের একদলীয় শাসন ব্যবস্থার একজন কট্টর সমালোচক। ১৯৮৯ সালে তিএনআনমেন স্কয়ারে আন্দোলন করেছেন। সে সময় তিনি দুই বছর জেলও খেটেছিলেন। যেহেতু তিনি চীন সরকারের বিরোধিতা করছেন এবং পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের জন্য লড়ছেন, তাই একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, জিয়াওবো আমেরিকার প্রতিনিধিত্বই করেছেন। প্রসঙ্গত, তিনিও আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন এবং আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতাও করেছেন।
২০১১ সালটি ছিল আরব বসন্তের বছর। আন্দোলন খুব সফল হয়েছে বলা যায় না। তবে ঐ আন্দোলনের সূত্র ধরে নোবেল শান্তি পুরস্কারের অংশীদার হতে পেরেছেন ইয়েমেনের নারী অধিকারকর্মী তায়াক্কুল কারমান। মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালের আরব বসন্ত সংঘটিত হওয়ার আগে আন্তর্জাতিকভাবে তেমন পরিচিতি ছিল না কারমানের, তবে ইয়েমেনে তিনি শক্তিশালী একজন কর্মী। নোবেল পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে তার কাজের আন্তর্জাতিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে আরবে ‘গণতান্ত্রিক’ আন্দোলনের স্বার্থে। কারমান পেশায় সাংবাদিক এবং একজন মানবাধিকারকর্মী, যিনি মূলত নারী অধিকার নিয়ে তার দেশে কাজ করেন। হঠাৎ করে তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়াতে অবশ্যই তার দেশের মানুষ চমকে যায়, যেমন ২০০৬ সালে চমকে গিয়ে খুশি হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। উল্লেখ্য, আমেরিকার ড্রোন হামলায় ইয়েমেন এবং পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। ২০১১ সালে একই সাথে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন লাইবেরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ এবং লেয়মাহ গবওই। লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ সবসময় আমেরিকার অনুগত হয়ে সরকার পরিচালনা করেন। আমেরিকার আদলে এবং পরামর্শেই লাইবেরিয়ায় সরকার পরিচালিত হয়। তবে সারলিফ একজন সফল নারী অধিকারকর্মীও। সারলিফের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় গোট শিক্ষাজীবন কেটেছে আমেরিকায়। লেয়মাহ গবওইও লাইবেরিয়ার একজন নারী অধিকারকর্মী। লেয়মাহ গবওই উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন আমেরিকার ভার্জিনিয়ার এস্তারন মেন্ননিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়েনের শক্তিমত্তা আঁচ করতে পেরে ২০১২ সালের পুরস্কারটা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে পুরস্কারটা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ল রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান Organisation for the Prohibition of Chemical Weapons (OPCW) কে। সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে অপারগ হয়ে আমেরিকা বাধ্য হয়েছে জাতিসংঘ এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিরিয়া সমস্যার সমাধানে তৎপর হতে। তবে তাতে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি। সিরিয়া আন্তর্জাতিক রাজনীতির আগুনে ঠিকই পুড়েছে, পুড়ছে।
২০১৪ পাকিস্তানের আলোচিত স্কুল ছাত্রী মালালা ইউসুফজাইকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। মালালাই সবচেয়ে কম বয়সী নোবেল বিজয়ী। বিষয়টি অনেকটা অনুমিত ছিল। তবে ভারসাম্য আনার জন্য এবং সম্ভবত পুরস্কারের ভার বজায় রাখার জন্যও সাথে জুড়ে দেওয়া হয় ভারতের মধ্য প্রদেশের কৈলাশ সত্যর্থীর নাম। তার সংগঠন ‘বাচপান বাঁচাও আন্দোলন’ শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। ভারতে কৈলাশের কাজ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
২০১১ সালে সংগঠিত আরব বসন্ত থেকে যদি কিছু অর্জন হয়ে থাকে তা তিউনিশিয়াতেই হয়েছে। পশ্চিমা মডেলের বহুদলীয় গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য ২০১৫ সালে শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়েছিল দেশটির ‘ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট’ নামের একটি জোটকে। জোটটি তিউনিশিয়ার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রেখেছে বলে মনে করা হয়।
২০১৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারটি কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসকে (জন্ম ১৯৫১) প্রদান করা হয়েছিল। দেশটিতে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে তার দৃঢ় প্রচেষ্টার জন্য তাকে গুরুত্বপূর্ণ এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। কলম্বিয়ায় দীর্ঘ এ গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে ২২০,০০০ কলম্বিয়ান নিহত এবং বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৬ মিলিয়ন মানুষ। জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মনে রাখতে হবে জনাব সান্তোষও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করা পশ্চিমা ভাবাদর্শের একজন মানুষ। ফলে শান্তির নোবেলটি কোনোভাবেই বৃত্তের বাইরে যাচ্ছে না।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপন (আইসিএএন-এর সংক্ষিপ্ত রূপ) হলো একটি বৈশ্বিক নাগরিক সমাজ জোট যা পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণের চুক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং তা পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে। আইসিএএন-এর প্রচারণা চুক্তিটি (ট্রিটি অন দ্য প্রোহিবিশন অফ নিউক্লিয়ার উইপন) বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখে। আইসিএএন ২০০৭ সালে চালু হয়েছিল এবং ২০২১ সালের মধ্যে ১০৬টি দেশে ৬০৭টি অংশীদার সংস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। তাদের এ প্রচারাভিযানের কারণে তারা ২০১৭ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। মুশকিল হচ্ছে— পরমাণু অস্ত্রে শক্তিধর দেশগুলো চায় যাতে নতুন করে আর কেউ আনবিক শক্তি অর্জন না করে, কিন্তু বিপরীতে তারা তাদের পরমাণু অস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে রাজি হচ্ছে না।
২০১৮ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারটি ডেনিস মুকওয়েগে (জন্ম ১৯৫৫) এবং নাদিয়া মুরাদকে (জন্ম ১৯৯৩) “যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধ এবং সশস্ত্র সংঘাতের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করার প্রচেষ্টার জন্য প্রদান করা হয়েছিল।” অসলো, নরওয়েতে ৫ অক্টোবর ২০১৮-এ ঘোষণা করা হয়। পুরস্কারের উদ্ধৃতি অনুসারে “উভয় বিজয়ী এই ধরনের যুদ্ধাপরাধের প্রতি মানুষের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে এবং তা মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।” এটিকে অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ নোবেল পুরস্কার মনে হলেও, এবং নি:সন্দেহে মুকওয়েগের কর্ম নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য মনে হলেও পশ্চিমে শিক্ষা নেওয়া মুকওয়েগে যেমন পশ্চিমা ভাবাদর্শে লালিত, একইভাবে ইরাকী ইয়াজিদি নারী নাদিয়া মুরাদও সেই গোষ্ঠীর সদস্য যারা একইসাথে নিপীড়িত, নিপীড়ণের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসনের সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। নাদিয়া মুরাদ একজন ইয়াজিদি মানবাধিকার আইনজীবী যিনি ইরাকে ইসলামিক স্টেটের যৌন দাসত্ব থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং সে অগ্নিপরীক্ষার একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ করেছিলেন। ডেনিস মুকওয়েগে এবং নাদিয়া মুরাদ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নয় একথা যেমন কোনোভাবেন বলা যাবে না, আবার একথাও সত্য পশ্চিমা ভাবাদর্শের বাইরে গিয়ে ভালো কাজ করে পুরস্কারটি আর পাওয়া সম্ভবও হচ্ছে না।
২০১৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ (জন্ম ১৯৭৬), “শান্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জনের প্রচেষ্টার জন্য এবং বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ইরিত্রিয়ার সাথে সীমান্ত বিরোধ সমাধানে তার সিদ্ধান্তমূলক উদ্যোগের জন্য” এ পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। ১১ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি এই পুরস্কার ঘোষণা করে। আবি আহমেদ ইথিওপিয়ান পিপলস রেভল্যুশনারি ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইপিআরডিএফ) সভাপতি। আটাশ বছর ধরে এই দলটিই ইথিওপিয়ায় ক্ষমতায় রয়েছে। আবি আহমেদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে ইপিআরডিএফ-এর সাথে আরো দুটি দল মিলিয়ে ‘প্রসপারিটি পার্টি’ নামে নতুন দল গঠন করেন। ইপিআরডিএফ মূলত মার্কিন মদদপুষ্ট একটি বিদ্রোহী গ্রুপের উত্তরসুরী। এদের পূর্বসুরী ‘ডার্গ’ বিদ্রোহী গোষ্টিটি মূলত মার্কসবাদীদের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ডার্গ তাদের ক্যাম্পে হাজার হাজার মার্কসবাদী এবং লেনিনবাদী কম্যুনিস্টকে হত্যা করেছে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৫ ইথিওপিয়ায় যে দুর্ভিক্ষ হয় তাতে কমপক্ষে চার লক্ষ লোক মারা যায়, এর জন্যও বিদ্রোহী গোষ্টী ডার্গকে দায়ী করা হয়। ফলে গণতন্ত্রীপন্থী নেতা হিসেবে আবি আহমেদের নোবেল বিজয় পশ্চিমা রাজনীতির ছকের বাইরের কিছু নয়।
২০২০ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারটি নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি দ্বারা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে (১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত) প্রদান করা হয়েছিল। ৯ অক্টোবর (২০২০) এ ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ক্ষুধা মোকাবেলা, সংঘাত-আক্রান্ত এলাকায় শান্তি প্রচার এবং যুদ্ধ ও সংঘাতের অস্ত্র হিসেবে ক্ষুধার ব্যবহার প্রতিরোধ করার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়। ডব্লিুউএফপি ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এবং এফএও, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডব্লিুউএফপি হলো বিশ্বের বৃহত্তম মানবাধিকার সংস্থা এবং সংস্থাটিতে সরকার, সংস্থা এবং ব্যক্তিগত ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় অবদান দ্বারা অর্থায়ন করা হয়।
২০২১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কারটি ঘোষণা করা হয় ৮ অক্টোবর ২০২১ তারিখে অসলোতে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি দ্বারা। মারিয়া রেসা (জন্ম. ১৯৬৩) এবং দিমিত্রি মুরাটভ (জন্ম. ১৯৬১) ‘বাকস্বাধীনতা’ রক্ষায় তাদের প্রচেষ্টার জন্য পুরস্কারটি পান। মনে করা হয় বাকস্বাধীনতা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং শান্তি-সহাবস্থানের পূর্বশর্ত। মারিয়া রেসা একজন ফিলিপিনো-আমেরিকান সাংবাদিক, যিনি আমেরিকান সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর হয়ে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকায় যারা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান প্রায়শই তারা সরকারবিরোধী অবস্থানের জন্য তা পেয়ে থাকেন, মারিয়া রেসাও সেদিক থেকে ব্যতিক্রম নয়। মারিয়ার সাথে নোবেল বিজয়ী দিমিত্রি আন্দ্রেয়েভিচ মুরাটভের (১৯৬১) অবস্থানও একইভাবে বর্ণনা করা যায়। তিনি একজন রাশিয়ান সাংবাদিক, টেলিভিশন উপস্থাপক এবং রাশিয়ান সংবাদপত্র নোভায়া গাজেতার প্রধান সম্পাদক, যিনি প্রায়শই রাশিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে দমন পীড়ণের অভিযোগ আনেন এবং বাকস্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন।
২০২২ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যৌথভাবে বেলারুশের মানবাধিকারকর্মী আলেস ভিক্টারভিস বিলিয়াটস্কি, রাশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়াল ও ইউক্রেনের মানবাধিকার সংগঠন সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিস (সিজিএস)।
আলেস ভিক্টারভিচ বিলিয়াটস্কি (১৯৬২) হলেন একজন বেলারুশীয় গণতন্ত্রপন্থী কর্মী এবং ভিয়াসনা মানবাধিকার কেন্দ্রের সাথে তার কাজের জন্য ‘প্রিজনার অব কনসিন্স’ হিসেবে পরিচিত। এ্যালেস দেশটির ভিয়াসনা হিউম্যান রাইটস্ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। মানবাধিকার সংগঠনটি ১৯৯৬ সালে বেলারুশের রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ওপর দেশটির কর্তৃত্ববাদী নেতা আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর নৃশংস দমন-পীড়নের প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ্যালেস সম্পর্কে নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি বলেছে, তিনি তার দেশে গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে বেলারুশিয়ান স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য মরিয়া একজন কর্মী বিলিয়াটস্কি বেলারুশিয়ান পপুলার ফ্রন্টেরও একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বেলারুশিয়ান বিরোধী দলের সমন্বয় পরিষদেরও সদস্য। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তাকে “পূর্ব ইউরোপের মানবাধিকার আন্দোলনের একটি স্তম্ভ” বলে অভিহিত করেছে এবং বেলারুশের একজন বিশিষ্ট গণতন্ত্রপন্থী কর্মী হিসেবে স্বীকৃত তিনি।
১৪ জুলাই ২০২১ তারিখে বেলারুশিয়ান পুলিশ সারা দেশে ভিয়াসনার কর্মচারীদের বাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং কেন্দ্রীয় অফিসে অভিযান চালায়। বিলিয়াটস্কি এবং তার সহকর্মী ভ্লাদিমির স্টেফানোভিচ এবং ভ্লাদিমির ল্যাবকোভিচকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ৬ অক্টোবর ২০২১-এ বিলিয়াটস্কিকে কর ফাঁকির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে তিনি কারামুক্তি পান। বেলারুশে কারচুপির নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভের জেরে ২০২০ সালে এ্যালেসকে আবার আটক করা হয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে যান লুকাশেঙ্কো। তিনি এখনও কারাগারে বন্দী আছেন। বেলারুশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো। দেশটির (তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ) এক চতুর্থাংশ লোক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত হয়। এরপর নানান ধরনের সংঘাত এবং চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভ করলেও বেলারুশ ইউক্রেনের মতো সোভিয়েন ইউনিয়নের প্রভাব বলয় থেকে বের হতে পারেনি। বেলারুশের সরকার পরিচালনা পদ্ধতিও অনেকটা রাশিয়ান ধাচের। ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের এ অন্তর্বর্তী সময়ে গণতন্ত্রপন্থী মানবাধিকারকর্মী বিলিয়াটস্কির নোভেল বিজয় নি:সন্দেহে একটি রাজনৈতিক পুরস্কার।
অপরদিকে বিলিয়াটস্কির সাথে সংগঠন হিসেবে পুরস্কার পাওয়া মেমোরিয়াল হলো একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় জোসেফ স্ট্যালিনের শাসনামলে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অন্যান্য অপরাধ অধ্যয়ন ও পরীক্ষা করার জন্য রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এটি। রাশিয়ায় সংগঠনটির বিলুপ্তির আগে এটি দুটি পৃথক আইনী সত্তা নিয়ে পুণর্গঠিত হয়— মেমোরিয়াল ইন্টারন্যাশনাল, যার উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের রেকর্ডিং, বিশেষ করে স্ট্যালিনবাদী যুগে, এবং আরেকটি হলো মেমোরিয়াল হিউম্যান রাইটস সেন্টার। এটির কাজ ছিল— মানবাধিকার সুরক্ষা, বিশেষ করে আধুনিক রাশিয়া এবং এর আশেপাশের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে। একটি কেন্দ্রীভূত সংগঠনের পরিবর্তে এটি আন্দোলন হিসেবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেমোরিয়াল রাশিয়ার ৫০ টিরও বেশি সংস্থা এবং কাজাখস্তান, ইউক্রেন, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্স সহ অন্যান্য দেশে ১১টি সংগঠনকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যদিও অধিভুক্ত গোষ্ঠীগুলির ফোকাস অঞ্চল থেকে অঞ্চলে আলাদা, তদুপরি তারা মানবাধিকার সম্পর্কে একই রকম উদ্বেগ ভাগ করে নেয়, ঘটে যাওয়া সংঘাত নথিভুক্ত করে, তরুণদের ‘শিক্ষিত’ করে এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকারদের জন্য স্মরণ দিবস পালন করে।
২০০৭ সালে সিজিএস প্রতিষ্ঠিত হয়। দখলকৃত ক্রিমিয়ায় রাজনৈতিক নিপীড়ন পর্যবেক্ষণ করে আসছে সিজিএস। সংগঠনটি দনবাস যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নথিভুক্ত করেছে। তারা ক্রেমলিনের রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার চালিয়ে আসছে। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এই হামলার পর থেকে সংগঠনটি ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধ শনাক্ত ও নথিভুক্তের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত রয়েছে। অতএব, দেখা যাচ্ছে ২০২২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারটি সেইসব সংগঠন এবং ব্যক্তি পেয়েছে যারা রাশিয়ার নীতি আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে।
গত দুই দশক ধরে যারা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাচ্ছেন তারা পুরস্কারটি পাওয়ার যোগ্য কিনা সেটি ভিন্ন আলোচনা, তবে উপরিউক্ত যারা নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে যে মিলগুলো চোখে পড়ে তাতে একথা অনস্বীকার্য যে, বিগত দুই দশকে পুরস্কারটি যারা পেয়েছেন তারা পশ্চিমা বিশ্বের বলয়ের মধ্যে থেকেই পেয়েছেন, এবং তাদের মধ্যে অনেকে আমেরিকার প্রতি ভীষণ অনুগত থেকেছেন এবং আছেন। অবশ্য শুধু বিগত দশকে নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই নোবেল শান্তি পুরস্কারটি আর নিরপেক্ষ থাকেনি এবং দেখা যায় সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যই ছিল সবচেয়ে বেশি। খুব বাধ্য না হলে নেলসন মান্দেলার মতো আমেরিকার নীতি বিরোধী কাউকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়নি, বরং সবসময় তাদের পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে, যাদের কাজ রাশিয়া এবং চীনা নীতির বিরুদ্ধে গিয়েছে, বা মুসলিম বিশ্ব তথা আফ্রিকা, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান এবং আমেরিকার আধিপত্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে বলেও অনেকে বিশেষজ্ঞ মনে করেন। বর্তমান বিজয়ীরা আন্তর্জাতিক ঘুড়ি হয়ে পূর্ব-দক্ষিণে উড়লেও নাটাইটা সবসময় উত্তর-পশ্চিমেই থাকছে।


অনলাইন অবলম্বনে দিব্যেন্দু দ্বীপ