বিষয়টিকে কে কীভাবে নিবেন জানি না, তবে আমার মতো অনেকের কাছেই বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য এবং অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে যখন কোনো অপরাধ ঘটে তার নানাবিধ কারণ থাকে, সবকিছু ছাপিয়ে নিষ্ঠুরতার দিকটিই আমাদের কাছে ধরা দেয় বলে আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তিটিকে ঘিরেই মেতে থাকি, সে মাতামাতি সংগত কারণে এক সময় থেমেও যায়, যতক্ষণ না দৃশ্যপটে নতুন কোনো ব্যক্তি এসে হাজির হয়।
ষোলো কোটি মানুষের দেশে ষোলো কোটি মনস্তত্ত্ব। প্রতিটি মানুষের মনই তো এক একটি সম্রাজ্য, যে খবর সে নিজে ছাড়া কেউ জানে না। মন আবেগি হয়, মন ভালবাসে, মন ভুল করে, মুন অসুস্থ হয়, মন নিষ্ঠুর হয়, আরো কত কী হয়। খুব জটিল বিষয়টা। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে অসুস্থ অবস্থা বিরাজমান থাকায় মনের জটিলতা-অসুস্থতা-অস্থিরতা আরো বাড়ে।
এই ষোলো কোটির মধ্য থেকে ভালো মানুষ, দক্ষ মানুষ বেরোনোর কথা অসংখ্য; অবার মন্দ মানুষ, ভয়ঙ্কর মানুষও তো বেরোবে, নাকি? ভালো কিছু করার জন্য সঙ্গবদ্ধ কাঠামো লাগে, কিন্তু মন্দ কিছু নিষ্ঠুর কিছু বিচ্ছিন্নভাবেও হয়, কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি তো সামাজিক সূত্র বিহীন নয়।
বদরুল যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা যেমন নিষ্ঠুর, একইসাথে এটাও নিষ্ঠুর দৃশ্যপটে থেকেও যারা চিৎকার করে এগিয়ে যাওয়ার মতো সাহস বুকে ধারণ করতে পারেনি।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, নার্গিসকে কোপানোর শুরুতে সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জন লোক ছিলো, যারা ডান দিক থেকে দৌঁড় দিয়ে সরে আসছে, বাম দিকে একটু অদূরেই একজন দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে আরো কয়েকজন। অতগুলো লোক যখন দৌঁড়ে সরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশটাই যেন দৌঁড়ে পালাচ্ছে!
খুব নিকটে নিশ্চয়ই আরো অনেক মানুষ রয়েছে। কোপানোর দৃশ্যটি দেখা গেছে প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড ধরে। ভিডিওটিতে কিছু চিৎকার শোনা যাচ্ছে, হুড়োহুড়ি, পাশাপাশি কেউ একজন বলছে, “ও মাই গড, ও মাই গড়”।
আমাদের একটি চিরচারিত চিৎকার হচ্ছে, “ধর ধর…”
ঢাকার শহরে গনপিটুনির হাত থেকে এ পর্যন্ত তিনজনকে রক্ষা করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, তিনটি ক্ষেত্রেই দেখেছি- সাধারণ জনতা ‘ধর ধর’ বলে ঝাপিয়ে পড়ে। যাচ্ছেতাইভাবে, নিষ্ঠুর-নির্দয়ভাবে মারেতে দেখেছি। ধৃত-নিরস্ত্র একজন মানুষকে মারার সে কী মহোৎসব!
নিরস্ত্র মানুষের ওপর এরকম সঙ্গবদ্ধভাবে হামলে পড়ার দৃশ্য এ দেশে বিরল নয়, সেই একই জনতা একখানা চাপাতির ভয়ে ওভাবে সরে আসল! কেন সরে আসবে? কেন ‘ধর ধর’ বলে এগিয়ে যাবে না?
এগিয়ে যেতে না পারুক, “ধর ধর” চিৎকারটুকুও কি করতে পারলো না? এগিয়ে যেতে পারবেই বা না কেন, কেউ একজন অন্তত বুকে সাহস করে এগিয়ে যাবে না কেন? আমাদের পূর্বসুরীরাই তো যুদ্ধে করেছে ভারী অস্ত্রের সামনে লাঠিসোটা নিয়ে, তাদের উত্তরসুরী আমরা একখানা চাপাতির ভয়ে ওরকম পালিয়ে গেলাম! কোনো সমীকরণেই মেলানো যায় না।
খুব স্বাভাবিক যে আমরা বিচার চাইবো। তবে সে বিচার চাওয়ার ধরণ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেউ বলছে, এমনকি অনেক দায়িত্বশীল মানুষকেও বলতে শুনেছি, বদরুলকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হোক! আবেগেও এমন কথা বলা যায় না। তাহলে একথা বলার আবেগ শুধু থাকবে, খাদিজাকে বাঁচানোর আবেগ থাকবে না? মানুষকে হত্যা করার আবেগ থাকবে, বাঁচানোর আবেগ থাকবে না?
এ ধরনের ঘটনার বিচার হয়। বিচার না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিচার হলেই কি এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়? দিনদুপুরে জনতার মধ্য থেকে যখন কেউ কাউকে কুপিয়ে হত্যা করতে উদ্ধত হয় সে কি আসলে বিচারের তোয়াক্কা করে, সে কি আসলে নিজের জীবনেরও মায়া করে, তার কি কিছু ভাবার ক্ষমতা আসলে থাকে?
এটি কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়, ব্যক্তিগত নৃশংসতা-অসুস্থতার ফসল, যেখানে ইন্ধন আছে সামাজিক বিভিন্ন চলকের, সেখানে রাজনীতি একটা দিক মাত্র। সম্ভবত বড় একটা দিক। তবে রাজনীতির বাইরেও এমন ঘটনা বিরল নয়, লিটল ফ্লাওয়ারস স্কুলের ছাত্রী রিশাকে যে দর্জি ছুরি মেরে হত্যা করেছিলো সে কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত বলে শুনিনি।
রাজনীতির কথা বলাই যায়, সমাজের ভালো চাইতে হলে রাজনীতির ভালো চাওয়ার বিকল্প নেই, আবার রাজনীতির ভালোর জন্য পরিবার এবং সমাজের মুখ্য ভূমিকা আছে নিশ্চয়ই।
বদরুল বা এরকম কাউকে কোনো নির্দিষ্ট দলের অন্তর্ভুক্ত ভাবার এবং তা চাউর করার বিপদ আছে, এতে ব্যক্তির অপরাধ গৌণ হয়ে যায়, অপরাধের সামাজিক কারণগুলো গৌণ হয়ে যায়, রাজনৈতিক রেষারেষির প্রশ্ন চলে আসে, ফলে বিষয়টিকে ঘিরে যে সামগ্রিক বিশ্লেষণ তৈরি হওয়ার কথা, তা আর হয় না। তাই মূল ফোকাসটা ধরে রাখা উচিৎ অপরাধ কর্ম, তার ব্যপ্তি, কারণ এবং সম্ভাব্য সামাজিক উপকরণগুলোর দিকে।
‘বামাসাস’ যে ঘৃণা স্তম্ভ বানিয়েছে বদরুলের ছবি দিয়ে তাতে অপরাধের চেয়ে জনৈক বদরুল মূখ্য হয়ে পড়েছে। বদরুল তো মূখ্য নয়, বা রিশার হত্যাকারী ওবায়দুলও নয়, মূল বিষয়- এ ধরনের ঘটনা।
এদেশে ঘৃণা স্তম্ভ বানানোর রেওয়াজ মূলত ‘৭১-এর ঘৃণ্য-নজিরবিহীন অপরাধ এবং অপরাধীর প্রতি ঘৃণা জানানোর প্রতিকী রূপ হিসেবে। সেখানেও কাউকে উল্লেখ করা হয় না, অপরাধের প্রতি মূল ইঙ্গিতটা রাখা হয়, রাজাকার, আল বদরদের ঘৃণা জানানো হয়।
মানবাধিকার সাংবাদিক কমিশন (বামাসাক) নামে সংগঠনটি বদরুলের ছবি দিয়ে ঘৃণা স্তম্ভ বানিয়ে শুধু শুধু বিষয়টিকে খেলো করেছে, অপরাধীর চেয়ে বদরুলকে বড় করে তুলেছে। হয় হুজুগে করেছে, অথবা বিষয়টি রাজনৈতিক।
বিচার তো আমরা চাইবোই, পাশাপাশি বিষয়টিকে সামনে এনে নারীর প্রতি সহীংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যায়। এখান থেকে অনেক আন্দোলনই শুরু হতে পারে। কিন্তু তাই বলে সবকিছু তালগোল করে ফেললে তো হয় না।
ব্যক্তি বদরুলকে দলের খোলসে তুলে ধরে বাংলাদেশের খল নায়ক বানিয়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই, তাতে মূল সমস্যা আড়াল হয়ে যায়। মূল কথা হচ্ছে, এ ধরনের মানুষ সমাজে আছে, কিছু থাকে, তারা যেন রাজনীতিতে ঢুকতে না পারে, তারা যেন ক্ষমতা হাতে না পায়, তা সে যে দলে বা যেভাবেই হোক।
বদরুল ভয়ঙ্কর অপরাধী, তার বিচার চাইতে হবে, বদরুলকে ঘিরে এর বেশি কিছু হওয়ার আর কী করার থাকতে পারে? বরং বেশি বেশি আলোচনা-আন্দোলন হওয়া উচিৎ যাতে এরকম ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য।
আমাদের সমস্বরে শপথ নেওয়া উচিৎ, “এরকম ঘটনা দেখে আমরা যেন না পালাই।” আর কোনো খাদিজা যেন এভাবে আক্রান্ত না হয়। আর কোনো বদরুল যেন সমাজে তৈরি না হয়।