নিজেকে হারাই: কানামো কাহিনী (পঞ্চম-সপ্তম এবং শেষ পর্ব)

মনে হচ্ছিল, কানামো আমাকে এখান থেকে যেতে দেবে না। আমি যত দ্রুত সম্ভব পা চালাচ্ছিলাম কানামোর আড়ালে যাবার জন্য। মনে হচ্ছিল, যেন-যদি এক ছুটে, এক নিমিষে কানামোর আড়ালে চলে যেতে পারতাম আমি। আমার এই ট্রমা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই ডানে মোড় নিয়ে কানামোর আড়ালে চলে গেলাম। অস্তমিত সূর্যের লাল আভায় চারদিক তখন রঞ্জিত। আভায় আবছা মত দেখতে পারলাম আমাদের বেস ক্যাম্প। খুব ভালো লাগছিল,  সূর্যের অবস্থান দেখে বেসক্যাম্পে যাবার জন্য যে হিসেব করেছিলাম সেটি ঠিক ছিল বলে।

পূর্ব প্রকাশের পর

%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%8b-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%80

কাযার সকালটা ছিল রৌদ্রজ্জ্বল। ঘুম থেকে উঠে গরম পানি দিয়ে গোসল করার পরে পুরোপুরি সুস্থ বোধ করা শুরু করলাম। হোটেলেই সকালের নাস্তা খেয়ে ঘুরতে বের হলাম। ছোট্ট একটা লোকালয়। প্রয়োজনীয় দোকানপাট সবই আছে। অনেক পর্যটক দেখতে পেলাম। মনে হল পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে অনেকেই এসেছে কাযাতে।

সনি ভাই ছোট্ট একটা হাইকিং ট্রায়াল করালেন পাশেই এক পাহাড়ে। প্রায় ৪৫ ডিগ্রি কোণে খাড়া উঠে যেতে হয়েছিল। উঠলাম অনেক কষ্টে। পুরোটা পথই ছিল ছোট ছোট পাথরে ভরা, পা রাখতেই পিছলে দিকে নেমে যাচ্ছিলাম। যাইহোক কিছু দূর উঠে, সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আবার নিচে নেমে আসলাম। আমাদের সবার নিশ্বাস স্বাভাবিক ছিল। সবাই আমরা সুস্থ ছিলাম। সনি ভাই কঠোরভাবে বলে দিলেন পানি এবং খাবার ঠিক ঠাক মত খেতে হবে, এমনকি আমি যদি শুধু বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে চাই।

পাহাড় থেকে নেমে বাজারে এক রেস্টুরেন্টে চা আর কচুরি খেলাম। তারপর বেস ক্যাম্পের জন্য কিছু বাজার করা হল। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা রিজার্ভ সুমোতে করে রওনা হলাম কিবেরের পথে। দুই পাশে শুষ্ক, রুক্ষ পাহাড়ের মাঝে চলছিল আমাদের গাড়ি। জানালা দিয়ে পথের সৌন্দর্য আর কাঠিন্য দেখি আর মনে বয়ে যায় হাজারো ভাবনা। কোথায় চলেছি, কোন অজানা তে, কী আছে সামনে, এই যে এখন প্রায় ৪৩০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছাব, সুস্থ বোধ করব তো আমি?! নাকি এই উচ্চতায়, স্বল্প অক্সিজেনে অসুস্থ হয়ে আমাকে নিচে নেমে যেতে হবে?

কিবের গিয়ে যখন পৌঁছুলাম তখন গোধুলী লগ্ন। পাহাড়ের এক পাশে লালচে আভায় আলোকিত তিব্বতি ডিজাইনের অল্প কিছু ঘরবাড়ির কিবের গ্রাম। গাড়ি থেকে নেমে যখন থাকার জন্য ঠিক করা স্থানীয় একজনের বাড়ির পথে হাঁটছিলাম আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন আর এই জগতে নেই। অন্য কোনো গ্রহে, অন্য কোনো এক সময়ে আমি উপস্থিত হয়েছি।

খেয়াল করলাম, আমার নিশ্বাস স্বাভাবিক, কিন্তু আমার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম হওয়ায় স্বাভাবিকের চেয়ে আমি ঠাণ্ডা বেশি বোধ করছিলাম। এই ঠাণ্ডায় খাপ খাওয়ানোর জন্য সনি ভাই বেশি গরম কাপড় পরতে দেননি, মাথায় টুপিও পরতে দেননি। এমনকি রাতের খাওয়া শেষে আমাদেরকে নিয়ে উনি বাইরে হেঁটেছেন, যা ছিল আমার কাছে পুরো ‘অত্যাচারের পর্যায়ে’। সেই অত্যাচারই পরবর্তীতে আমাকে সাহায্য করেছে আমার লক্ষ্যে পৌঁছুতে।

পাহাড়ের রাতগুলিতে ঘুম হয়নি ঠিকমত। সারাদিনের ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত হয়ে ঘুমোতে যেতাম। গভীর ঘুম ভাঙ্গার পরে মনে করতাম বুঝি সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যেতাম। দেখতাম, রাত একটা কিংবা দুইটা বাজে। ভোরের অপেক্ষায় দুর্বিষহ সময় কাটত তখন। কান পেতে রইতাম বাইরের শব্দে, দূরে কোথাও হয়ত কুকুর ডাকছে। নাম না জানা পোকার শব্দ শুনতে শুনতে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়তাম!

কিবেরের প্রথম রাতটা ছিল নিজের সাথে বোঝাপড়ার রাত। নিজের বিচার নিজেই করছিলাম। একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলাম, হাজার মাইল অতিক্রম করে ফেলেছি সেই উদ্দেশ্য সফলের প্রত্যাশায়। মানালির অসুস্থতা আমাকে কতটুকু দুর্বল করেছে?! এই যে আমি এখন কিবেরে, আমি কি পুরোপুরি সুস্থ? আমি ঠিক মত শ্বাস নিতে পারছি তো? আমার কোনো সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে বা লুকিয়ে রেখে কি আমি এগোনোর পরিকল্পনা করছি? আমি কি আদৌ বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে পারব?

কিবেরের প্রথম সকালটা ছিল একটা মন ভালো করা সকাল। হালকা ঠাণ্ডা বাতাস আর মিষ্টি রোদে মাখা কিবের গ্রামটিকে মনে হচ্ছিল যেন স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে দাদুবাড়িতে এসেছি। থিনলিং এর যে বাসায় আমরা ছিলাম সেটার খাওয়ার রুমটা ছিল অসাধারণ। বিশাল বড় একটা রুমে জাপানিজ স্টাইলের নিচু টেবিল পাতা। সাথে বিছানার মত করে পাতা ম্যাট্রেস। এমন একটা রুমে সারাদিনই আড্ডাবাজি করে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সনি ভাইয়ের যন্ত্রণায় ঘরে বানানো তিব্বতী রুটি দিয়ে নাস্তা খেয়েই বাইরে বের হতে হল একলিমেটাইজ্শনের জন্য।

কিবের গ্রাম
কিবের গ্রাম

কিবের গ্রামটা অতিক্রম করে আমরা কানামো বেস ক্যাম্পের পথে উঠতে শুরু করলাম। পাহাড়ে আমি খুব আস্তে হাঁটি। বলা চলে প্রায় পুরোটা সময়ই দলের সবার পিছনেই ছিলাম আমি। কিন্তু আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন সনি ভাই। আমার প্রতিটা পদক্ষেপ খেয়াল করছিলেন, কীভাবে শ্বাস নিতে হবে, কীভাবে না ঝুকে হাঁটতে হবে এই সব নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। ওই দিন আমরা প্রায় ৩০০ মিটারের মত উঠেছিলাম। তারপর আবার নিচে নেমে এসেছি।

দুপুরের খাবার খেয়ে আর কোনো বাধা নিষেধই মানতে পারিনি, টানা দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙে বিকেলে গ্রামে একটু হেঁটে এসে খাওয়ার রুমে এসে রাত পর্যন্ত আড্ডাবাজি হল। এমনকি রাতে বাইরে হাঁটতেও গেলাম না। সনি ভাই খুব রাগ করলেন, বললেন দুপুরের ঘুম আর রাতে না হাঁটার ফল আগামীকাল টের পাবেন। “আল্লাহ্ ভরসা” বলে আমি ঘুমোতে গেলাম।

দরকার ছিল ভালো একটা ঘুম, কারণ পরের দিনই হাঁটা শুরু করব এক স্বপ্নের পথে। স্বপ্ন সফল করতে হলে আমাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। তার জন্য ভালো ঘুমের কোনো বিকল্প নাই। ঘুমের মধ্যেই যেন আমি চলে গেলাম কানামো সামিটে। সামিটে খুব উচ্ছ্বাস করছি আর সেই উচ্ছ্বাসের সাথে সাথে ঘুমটাও ভেঙে গেল। পুরনো প্রত্যয় আর সংকল্পকে আরেকটিবার ঝালাই করে নিয়ে উঠে তৈরি হতে লাগলাম স্বপ্নের কানামোর পথের হাঁটার জন্য।

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬। সকাল ছয়টার মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। ঘুম ভেঙে কিচ্ছু খেতে ইচ্ছা করে না। তাও জোর করে কিছু খেয়ে বের হলাম। আমি যেহেতু সবার চেয়ে আস্তে হাঁটি তাই ঠিক করেছিলাম আমি একটু আগেই হাঁটতে শুরু করব। কারণ, আমি জানি দলের অন্যরা কিছুক্ষণ পরেই আমাকে অতিক্রম করে যাবে। হাঁটতে শুরু করেই টের পেলাম সনি ভাইয়ের কথা। পা তো এগোতেই চায় না। প্রথম এক ঘণ্টা খুব কষ্ট হল সামনে এগোতে তারপর ধীরে ধীরে জড়তা কাটতে শুরু করল।

এগোতে শুরু করলাম কানামো বেস ক্যাম্পের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সনি ভাইকে সাথে পেয়ে গেলাম। সনি ভাইয়ের নির্দেশ মত পাঁচবার নিশ্বাস নিয়ে দশ-পনেরো পা করে এগোতে থাকলাম। এইভাবে চলার গতি অনেক বাড়ল। বেস ক্যাম্পের পথটুকু আমার কাছে একইসাথে বৈচিত্রহীন ও বৈচিত্রময় লেগেছে। চারদিকে একই পাহাড় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। কঠিন, রুক্ষ, শুষ্ক পাথুরে পাহাড় বেয়ে উঠে চলেছি তো চলেছি। মাঝে মাঝে লাল, সবুজ কিছু পাহাড়ী উদ্ভিদ পথে বৈচিত্র আনছিল। হঠাৎ করেই চোখে পড়ল দারুণ একটা জলাধার। নীল পানি, সবুজ, হলুদ আর লাল শ্যাওলা মিলে এমন অপরূপ ধারণ করেছে যা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল।

ওখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে নিমেষেই ভুলে গেলাম পথের ক্লান্তি। নতুন স্পৃহা নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম বেস ক্যাম্পের দিকে। বেলা বারটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বেস ক্যাম্পে। ছোট সমতল একটা জায়গা যার অদূরে ছোট্ট একটা পানির ধারা। গাইড তেনজিং দা আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। আমাদের দেখেই টমাটো স্যুপ আর চা বানিয়ে দিলেন। খেয়ে পুরোপুরি সতেজ হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে আমার কোনো কষ্ট হয়নি। বরং অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়াতে আমি অবাকই হয়েছি। বেস ক্যাম্পে টেন্টগুলো পিচ করার পরে দুপুরের খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আশেপাশে একটু ঘুরে দেখলাম। বেশ ঠাণ্ডা ছিল কিন্তু ফ্লিস ছাড়া আর কিছুই পরি নাই ওই উচ্চতায়, ঠাণ্ডায় অভ্যস্ত হওয়ার জন্য।

বেস ক্যাম্পে পৌঁছে অন্য আরেকটা টেন্ট পিচ করা আছে দেখছিলাম। বুঝলাম, সজীব আর শান্তনুর টেন্ট ওটা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, ওরা কখন ফিরবে। একটা সময় বেশ কথাবার্তার আওয়াজ শুনে বাইরে বের হয়ে দেখি, সজীব ফিরে এসেছে। ও বলল, সামিটের ৬০০ মিটার নীচ থেকে ফিরে এসেছে পেট ব্যাথার কারণে। আর শান্তনু বেস ক্যাম্প পর্যন্তই আসে নাই। সজীবকে বললাম আমাদের সাথে আরেরবার চেষ্টা করতে। কিন্তু সজীব রাজী হল না। টেন্ট গুছিয়ে ফিরে গেল কিবেরে।

সজীবকে দেখে নানান চিন্তার ঝড় বয়ে যেতে লাগল মনের ভিতর। নিজেকে টেনে এনেছি বেস ক্যাম্প পর্যন্ত, কিন্তু সামিট পর্যন্ত যেতে পারব কি? যাইহোক নানান চিন্তার ঝড় বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারে নাই আমাদের দলটির জন্য। সদস্যরা সবাই এত হাসি-খুশী-উচ্ছ্বল ছিল যে আমরা সবাই খুব উপভোগ করছিলাম বেস ক্যাম্পে। মনেই হচ্ছিল না আমরা কোনো কঠিন অভিযানে এসেছি, আমাদের কঠিন একটা লক্ষ্য আছে, যে লক্ষ্যে পৌঁছুতে আমাদের আগে আরো কয়েকটি দল চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে।

দুপুরের খাবার খেয়ে একটু আড্ডাবাজি চলছিল। কিবের থেকে একজন গ্রামবাসী আমাদের সাথে এসেছিল। তার নিয়ে আসা সাউন্ডবক্সে নানান গান শুনছিলাম। খুবই আনন্দময় পরিবেশ। এরই মাঝে সনি ভাই ঘোষণা করলেন সামিটে রওনা হবার পূর্বের প্রস্তুতি হিসেবে এখন আমাদের আবার কিছুদূর উপরে উঠে নেমে আসতে হবে বেস ক্যাম্পে। কী আর করা, চড়াই বেয়ে উঠতে লাগলাম। উপরে কী যে কনকনে বাতাস! আমি অল্প কিছুদূর গিয়ে নিচে নেমে আসলাম, সনি ভাই আর সোনালী আরো বেশী উপরে উঠেছিল। ফিরে এসে টেন্টে বসে সবাই ঝালমুড়ি আর চা খেলাম।

ধীরে ধীরে ঠান্ডা বাড়ছিল। টেন্টে বসেই সূর্যের অস্তে চলা দেখলাম। লাল আভায় চারদিকের পাহাড় অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল। তারপরেই দেখা পেলাম মাথা নষ্ট করা এক চাঁদের। ওই দিন পূর্নিমা ছিল। গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছা করছিল “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে” অথবা “ও আমার চাঁদের আলো”। কিন্তু ওই উচ্চতায়, এত ঠাণ্ডায় গলা দিয়ে কোনো আওয়াজই বের হল না শুধু উপভোগ করলাম জোৎস্না প্লাবিত সেই উপত্যকা।

ভোর তিনটায় আমরা রওনা হব শুভ্র নারী কানামোর উদ্দ্যেশ্যে, তাই রাত আটটার মধ্যেই খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ডাউন স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শুয়ে শুধু ঘামছিলাম, গরমে নাকি দুশ্চিন্তায় নিশ্চিত নই। বারোটার দিকে একবার ঘুম ভেঙে চাঁদের বাঁধ ভাঙা আলোয় ভেসে যাওয়া প্রকৃতি দেখলাম টেন্টের ফাঁক দিয়ে। আড়াইটার সময় উঠে তৈরি হতে শুরু করলাম। সামিটে তাপমাত্রা বা আবহাওয়া কেমন হবে তা অনিশ্চিত, তাই সর্ব্বোচ্চ প্রস্তুতি নিলাম। মাইনাস তাপমাত্রায় পরার জন্য মস্কো থেকে ইনার কিনেছিলাম। সেটি পরলাম। তার উপরে নাইকির একটা গেঞ্জি। তার উপরে লোলার ডাউন জ্যাকেট আর সবার উপরে নর্থ ফেসের একটা আউটার শেল। ছোট্ট একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস সব গুছিয়ে নিয়ে টেন্ট ছেড়ে বের হয়ে আসলাম। জোর করে কুৎসিত স্বাদের নুডলস গিলে সাড়ে তিনটার দিকে রওনা হলাম সামিটের পথে।

প্রত্যেকের সাথে হেড ল্যাম্প ছিল কিন্তু আমি পথ চলছিলাম পূর্ণিমার আলোতে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, আমি যেন অন্য কোনো গ্রহে আছি। অচেনা, অজানা এক গন্তব্যে পৌঁছুতে পাহাড় বেয়ে উঠছি তো উঠছিই। উপরের দিকে যখন ওঠা শুরু করলাম ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসে মাথার ভিতরে কেমন যেন লাগছিল। পা চলতে চাইছিল না এই মাঝরাতে। এক সময় খেয়াল করলাম আমার পা জমে যাচ্ছে ঠাণ্ডায়। পায়ের আঙুল নাড়া চাড়া করার চেষ্টা করলাম। তারপরে দেখি, আমি তো জুতোর ফিতাই বাঁধি নাই! নিচু হয়ে ফিতা বাঁধতে অসুবিধা হচ্ছিল, তখন দীপংকর এগিয়ে এল সাহায্য করতে। দীপংকর বা দীপু হল সনি ভাইয়ের সহ অভিযাত্রী।

কানামো অভিযানে সহযাত্রী হতে শিলিগুড়ি থেকে এসে উনি দলে যোগ দিয়েছেন। গত দুই দিন ট্রেকিং এর সময় সনি ভাই ছিলেন আমার সাথে সাথে। আজ সনি ভাই সবার সামনে ছিলেন। আর সবার পিছনে আমার সাথে ছিল দীপু। টানা দশ ঘণ্টা ট্রেক করতে হয়েছিল কানামোর সামিট পর্যন্ত পৌঁছুতে। এই পুরোটা সময় দীপু আমার সাথে সাথে আমার গতিতে চলেছে। একটা মুহূর্তের জন্য আমি তাকে বিরক্ত বা রাগ বা উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি। কতটা ধৈর্য থাকলে একটা মানুষ এভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পারে আমার জানা নাই।

এক সময় পূর্ণিমার চাঁদ মিলিয়ে গিয়ে ভোরের আলো দেখা দিল। অবিরাম চলছিলাম আমরা। একটা একটা করে চড়াই ডিঙোচ্ছিলাম। পথ যেন আর শেষই হয় না। পথ ছিল চরম একঘেয়ে আর বৈচিত্রহীন। একই রকম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বিরক্ত। রুক্ষ, ঝুরঝুরে পাথর সারা পথে যাকে বলে স্ক্রি। স্ক্রিতে পা ফেললে পা পিছলে চলে যেতে থাকে। কষ্ট সহনীয় করার জন্য প্রায় ৪৫ ডিগ্রী খাড়া ঢাল বেয়ে উঠছিলাম জিগ জ্যাগ করে। যার কারণে সময় লেগেছিল অনেক বেশী।

আবহাওয়া আরামদায়কই ছিল, কিন্তু একটা সময় দেখলাম কানামোর চূড়া মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। তাপমাত্রা আরো নিচে নামছিল, বাতাসের গতি তীব্র হচ্ছিল। এই অবস্থা থাকলে সামিট পর্যন্ত পৌঁছুতে পারব কিনা তা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। তবুও না থেমে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। উচ্চতাজনিত কোনো সমস্যা হয়নি। সূর্য মেঘে ঢেকে গেলেই ঠাণ্ডা বেড়ে যেত, আকাশের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতাম, কখন মেঘের আড়াল থেকে সূর্য বের হবে।

খারাপ বোধ করলে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম, এভাবে ভালো বোধ করছিলাম। একটা সময় খেয়াল করলাম, সামিটের কাছে চলে এসেছি। আমার সামনে সবাইকে দেখতে পাচ্ছি প্রায় পৌঁছে গেছে সামিটে। সেই সময়, ঠিক সেই সময় প্রথম বারের মত মনে হল আমিও পৌঁছুতে পারব সামিটে। সেই সাথে তীব্র একটা ভয়ও মনে এল। অনেক অভিযানের কাহিনী থেকে জানি যে নানান অসুবিধার জন্য সামিটের একেবারে কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয় অভিযাত্রীদের। আমার ক্ষেত্রে কী হবে? আমি পারব তো?

অবশিষ্ট অল্প একটু পথ যেন সব চাইতে দীর্ঘ ছিল। সামিটে পৌঁছে কোনো কথা বলতে পারিনি। সোনালীকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম। ঠিক মত কান্নাও নয়। কেমন যেন একটা গোঙানী বের হচ্ছিল মুখ দিয়ে। ধাতস্থ হবার পরে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম হিমালয়ের সৌন্দর্য। সামিটে আমরা ৩০ মিনিটের মত ছিলাম। একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে পুরোটা সময়। আমার আরো থাকতে ইচ্ছা করছিল। আরো কিছুক্ষণ কানামোর বরফের অংশটাতে সময় কাটাতে ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার আগে বেস ক্যাম্পে পৌঁছুতে হবে, তাই আবার নীচে নামা শুরু করতে হল।

পাহাড়ে উঠা,  ঐচ্ছিক কিন্তু নেমে আসাটা বাধ্যতামূলক। কানামোর সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় তো উঠলাম। কিন্তু ঠিকঠাকমত নামতেও তো হবে। সূর্য ডোবার আগেই নামতে পারলে ভালো, তাতে ঠাণ্ডা কম লাগবে। সূর্য ডুবে গেলে যে কনকনে ঠাণ্ডা পড়বে তা কষ্ট বাড়াবে। ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলাম। সবাই যে যার মত করে নামছিলাম। স্ক্রিতে এক জায়গায় পা ফেললে সেই পা পিছলে আরো ২/৩ স্টেপ সামনে চলে যায়। তাল ঠিক রাখা মুশকিল। উঠার সময় উঠেছিলাম জিগজ্যাগ করে, নামার সময় আর অত খেয়াল করে নামিনি। ইচ্ছা মত নেমে যাচ্ছিলাম।

জুতো কিনেছিলাম দুই সাইজ বড়, যাতে পাহাড় থেকে নামার সময় পায়ের আংগুল যথেষ্ট জায়গা পায়। ওঠার সময় যেমন মনে হচ্ছিল উঠছি তো উঠছিই, নামার সময়ও একই অবস্থা, নামছি তো নামছিই। পথ শেষ হয় না। সূর্যের তীব্র রশ্মি মুখে এসে পড়ছিল, বেশি দূর তাকাতে পারছিলাম না। শেষ চড়াইটার কাছে গিয়ে পথ ভুল করলাম। একটুও ভয় পাইনি বা দুশ্চিন্তা করিনি। আমি সূর্যের অবস্থান বুঝে, আমাদের ক্যাম্পটার পথ বের করার চেষ্টা করেছি। একা হাটঁছি তো হাটছিই। পথ শেষ হয় না। সূর্য তখন প্রায় অস্ত যাবার পথে। কানামো তখন আমার পিছন দিকে। সেই সময় অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল, কানামো আমাকে পেছন দিক থেকে টেনে ধরেছে। ঘাড়ের কাছে শিরশিরানী এক অনুভূতি।

%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%bf%e0%a7%9f%e0%a6%be-%e0%a6%b0%e0%a6%b9%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%a8

মনে হচ্ছিল, কানামো আমাকে এখান থেকে যেতে দেবে না। আমি যত দ্রুত সম্ভব পা চালাচ্ছিলাম কানামোর আড়ালে যাবার জন্য। মনে হচ্ছিল, যেন-যদি এক ছুটে, এক নিমিষে কানামোর আড়ালে চলে যেতে পারতাম আমি। আমার এই ট্রমা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই ডানে মোড় নিয়ে কানামোর আড়ালে চলে গেলাম। অস্তমিত সূর্যের লাল আভায় চারদিক তখন রঞ্জিত। আভায় আবছা মত দেখতে পারলাম আমাদের বেস ক্যাম্প। খুব ভালো লাগছিল,  সূর্যের অবস্থান দেখে বেসক্যাম্পে যাবার জন্য যে হিসেব করেছিলাম সেটি ঠিক ছিল বলে।

এগোচ্ছি বেস ক্যাম্পের দিকে, তখন দেখি আমাদের গাইড আমাকে খুঁজতে বের হয়েছে। আরো প্রায় আধা ঘণ্টা চড়াই উৎরাই ডিঙানোর পরে পৌঁছুলাম বেস ক্যাম্পে। সাধ্যের বাইরের উঁচু একটা পাহাড় চূড়া ছোঁয়ার আমার অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হল। সেই সময়ে আর অন্য কোনো অনুভূতিই কাজ করছিল না। খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম সে রাতে।

পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙল প্রশান্ত মন নিয়ে। মনে পড়ল গত দিন কানামোর সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছি আমি। হ্যাঁ আমি, সেই আমি যে নিজেকে মনে করতাম পাহাড়ে চড়ার অনুপযোগী, যে মনে করে যে তার বয়স এবং শারীরিক সক্ষমতা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা, যার উচুঁতে উঠতে অনেক অনেক বেশি কষ্ট হয়, যে প্রতিবারই পাহাড়ে ওঠার সময় প্রতিজ্ঞা করে যে আর না, এই বারই শেষ, সেই আমি প্রায় ছয় হাজার ফুটের কাছাকাছি উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে গেছি!

বেস ক্যাম্প থেকে কিবের ফেরার সময় খুব উৎফুল্ল ছিলাম। কোনো তাড়া ছিল না। ধীরে ধীরে উপভোগ করতে করতে নামছিলাম। কানামো লেকের পাশে বেশ খানিকটা সময় কাটালাম। প্রথম বারের মত সেলফি স্টিকটাতে ফোন সেট করে ভিডিও করতে করতে নামলাম। দূর থেকে যখন কিবের গ্রামটা দেখতে পেলাম মনে হল, যেন কতকাল পরে নিজের ঘরে ফিরছি। আমার সামনে কিবের, পিছনে কানামো।

কানামোকে আমি তখনও ভয় পেতে শুরু করেছি। কানামোকে দেখলেই মনে হয়, এই পাহাড় আমাকে টেনে ধরেছিল, রেখে দিতে চেয়েছিল নিজের কাছে। এখন ছবি দেখলেও আমার একই অনুভূতি হয়। কানামোকে আমার আপন মনে হয়নি। কানামো আমাকে টানতে পারেনি। আমি কানামো থেকে অনেক অনেক দূরে থাকতে চাই। আমি যেখানেই যাই আমার মনে হয় আমার হৃদয়ের একটা অংশ সেখানে রেখে আসি। কিন্তু কানামোর ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। কানামোকে কেন আপন মনে হল না সেই উত্তর আমি নিজেই খুঁজে ফিরি।

পরিশিস্ট:
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। এটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। সমাজ, সংস্কার, পরিপ্রেক্ষিত সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে অন্যদের কথা তো বহু দূরে, আমি নিজেও কিছুদিন আগে ভাবি নাই যে আমি প্রায় ছয় হাজার মিটার উচ্চতার একটা চূড়ায় উঠতে পারব। কিন্তু আমি তা পেরেছি আমার তীব্র ইচ্ছার কারণে। একটি সফল পর্বত আরোহণের পিছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। আমার মতে এই অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় ঘটায় তীব্র ইচ্ছা আর মনোবল। স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্নে না রেখে বাস্তবায়নের কঠিন পথে যেন সফলভাবে চলতে পারি এই আমার প্রত্যাশা।

সুদূরের পিয়াসী