জনগণের নির্যাতিত অংশ ঈশ্বরের কাছে বিচার দিয়ে বসে থাকে, থাকানো হয়। নীপিড়িতদের একটা বড় অংশ শুধু পরকালের দিকে তাকিয়ে থাকে, ফলে পৃথিবীতে তারা ভয়ানকভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিয়তিবাদী এবং অসংগঠিত, একইসাথে তারা দুঃখবোধহীন। সন্তান বেঘোরে মরলেও তাদের খুব সহজে সয়ে যায় সে বেহেস্তে যাবে ভেবে।
এদেশে ভাল মানুষেরা ক্ষমতাহীন, এবং এ কারণে সম্বলহীন মানুষেরা নিপীড়িত, একইসাথে তারা বাকশক্তিহীন। (ক্ষমতাসীন মানে সবসময় সে বড় পদের অধিকারী হবে, বা সমাজে তার অবস্থান খুব উঁচু হবে, এমন কথা নেই। নিম্নস্তরের মানুষের মধ্য থেকেও কেউ জুলুমবাজ-ক্ষমতাবান হতে পারে।) এক্ষেত্রে সেটি সাধারণ সমাজ জীবন থেকে সকল অফিশ আদালতের ক্ষেত্রেও সত্য। পুলিশের কথা যদি বলি, তাহলে পুলিশ কনস্টেবলেরাও কিন্তু নির্যাতীত। দুইভাবে তারা নির্যাতীত-
১। জনগণের মধ্যে যারা ক্ষমতাসীন তাদের দ্বারা;
২। এবং অভ্যন্তরীণভাবে।
একজন ট্রাফিক কনস্টেবলের কথাই ধরুণ, সারাদিন ওরকম একটি টাফ জব করে সে কতটুক সুবিধা নিয়ে বাঁচে?
আসলে এদেশের মূল সমস্যা হচ্ছে, ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং দুবৃত্তের সোস্যাল অলিগার্কি। প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েকজন রংবাজ একত্রিত রয়েছে আমাদের সমাজে । এই সঙ্ঘবদ্ধতা খুব ভয়ঙ্কর কারণ, ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক, এই ত্রিমুখী আঁতাত শোষণ করছে মানুষকে। তাই এ তিন পক্ষের কোনো পক্ষ দ্বারা কাউকে নিয়ন্ত্রণ করা আর সম্ভব না, যদি অর্থনীতির চাকাটি ঠিকভাবে ঠিকপথে না ঘোরে। মোটা দাগে বলতে গেলে ব্যবসায়ীরা ব্যবসার নামে জনগণকে ঠকাচ্ছে এবং সেই ঠকানোর পথে সম্ভাব্য বাধাগুলো দূর করতে লুটপাটের টাকার একটা অংশ ভাগ করছে তারা আমলা এবং রাজনীকিতদের সাথে, একটা ভাগ বিজ্ঞাপনের উছিলায় বা সরাসরি গণমাধ্যমও পাচ্ছে। ফলে অবশ্যই গণমাধ্যমও এই অঁতাতের মধ্যেই আছে, আর যেহেতু বেশিরভাগ গণমাধ্যমের মালিক ঐসব ব্যবসায়ীরাই, তাই বিষয়টি আলাদাভাবে উল্লেখ না করলেও সমীকরণ একই থাকে।
এখান থেকে বেরিয়ে আসা খুব সহজ কথা নয়, কারণ, জনগণের নির্যাতিত অংশ ঈশ্বরের কাছে বিচার দিয়ে বসে থাকে, থাকানো হয়। নীপিড়িতদের একটা বড় অংশ শুধু পরকালের দিকে তাকিয়ে থাকে, ফলে পৃথিবীতে তারা ভয়ানকভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, নিয়তিবাদী এবং অসংগঠিত, একইসাথে তারা দুঃখবোধহীন। সন্তান বেঘোরে মরলেও তাদের খুব সহজে সয়ে যায় সে বেহেস্তে যাবে ভেবে। তাই খুব সহজ নয় দেশটা বদলানো, কারণ, নির্যাতিতদের নিয়ে দলবেধে কিছু করার সুযোগ আসলে নেই। এদেশের নির্যাতীতরা যাদের হাতে নির্যাতীত আবার তাদেরই ক্রীড়নক। ওরা ওদের শত্রুদের হয়ে আপনাকে মারবে, অর্থাৎ ওরা যে ওদের শত্রুর ফাঁদে আছে তা জানে না, জানার সুযোগ নেই, এবং বিদ্যমান কৌশলে তা ওদের জানানো সম্ভবও না। যতক্ষণ না ওদের কোনোমতে বেঁচে থাকার রশদটুকু কাজের বিনিময়ে আপনার কাছ থেকে পাবে, তার আগে ওদের বাগে আনা যাবে না। সাধারণ মানুষের একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে, ওরা কষ্টে বাঁচে, খেয়ে-না-খেয়ে বাঁচে, কিন্তু বাঁচতে চায় সবচে’ বেশি। ওরা মরতে পারে না মোটেও। তাই ওদেরকে ভড়কে দেওয়া যাবে না।
সবকিছু সবদিক মাথায় রেখে একটা উপায় হতে পারে, প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েকজন সঙ্ঘবদ্ধ তরুণের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। পরিকল্পনাটা হতে হবে কমপক্ষে বিশ বছরের। ধরা যাক, ব্যাংক সেক্টরের কথা, এই সেক্টরের নবাগত বিশজন (কমপক্ষে) কর্মকর্তা যদি একত্র হতে পারে মনে মনে, তাহলে তারা ব্যাংক সেক্টরে আগামী বিশ বছরের মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে বলে বিশ্বাস করা যায়।
এরকম প্রকাশনা জগতে, দশজন লেখক-উদ্যোক্তা যদি মনে করে এই সেক্টরটি বদলে দেব, তাহলে বিশ বছরের মধ্যে তা সম্ভব। গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। ধার যাক, বিশজন সাংবাদিক একত্রিত হতে পারল মানসিকভাবে, আপাতত তারা বিশটি ম্যাগাজিন টাইপ ওয়েবসাইট চালাবে, ধীরে ধীরে টিভি চ্যানেল ইত্যাদি করবে। এলেবেলেভাবেই আপাতত চলুক, নিশ্চয়ই একসময় তারা অনুসরণীয় এবং প্রভাববিস্তারকারী কিছু করতে পারবে।
এরকম প্রতিটি সেক্টরে সম্ভব, যদি মেধা-প্রজ্ঞা-পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো যায়। তবে স্বল্পমেয়াদী হলে হবে না। প্রতিটি সেক্টরে এরকম কিছু মানুষ সৃষ্টি হওয়ার পর রাজনীতি নিয়েও ভাবা সম্ভব হবে। তখনই শুধু রাজনীতি এবং দেশ বদলে দেওয়া যাবে।
বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় লাফ দিয়ে রাজনীতির ক্ষেত্রে তেমন কিছু করা যাবে না। আগে বাজারের দখল নিতে হবে। বাজারের দখল হৃদয়বান মানুষের হাতে আসতে হবে।