পত্রিকার খবর অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায় বিচারের প্রতীক জাস্টিসিয়া মূর্তিটির ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বলা হচ্ছে— নামাজের সময় মূর্তি, প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্যটি ঢেকে রাখা হবে।
সিদ্ধান্তটি কতটা হাস্যকর হয়েছে তা কৌশলগত কারণে বলা মুশকিল, তবে এটি ভেঙে ফেলতে হলে সেটি যে কত বড় অবিচার হত তা ভেবেও শঙ্কিত হচ্ছি। আশঙ্কাটি আসলে একই থাকছে, শুধু নতুন মাত্রা পেয়েছে নামাজের সময় ভাস্কর্যটি ঢেকে রাখার সিদ্ধান্তে।
প্রশ্ন হচ্ছে, নামাজের সময় ভাস্কর্য ঢেকে রাখতে হবে কেন? ভাস্কর্যটি বেশি খোলামেলা বলে, নাকি যেকোনো ভাস্কর্যই নামাজের সময় ঢেকে রাখা উচিৎ বলে? যদি প্রথমটি এক্ষেত্রে কারণ হয়, তাহলে এর চেয়ে উন্মুক্ত ভাস্কর্যও দেশে রয়েছে। সেগুলোও কি ঢেকে রাখতে হবে?
ভাস্কর্য প্রধানত উন্মুক্তই হয়। জাস্টিসিয়া ভাস্কর্যটি সেক্ষেত্রে অনেক বেশি আব্রু পেয়েছে বলা যায়। সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে— ‘জাস্টিসিয়া’ ঢাকা হলে একই কারণে ‘অপরাজেয় বাংলা’ কেন ঢাকা হবে না?
নামাযের সময় ভাস্কর্য ঢেকে রাখাটাই যদি রীতি হতে হয় তাহলে তো কোনো ভাস্কর্য বানানোর কোনো মানে থাকে না। যা ঢেকে রাখতে হবে তা বানাতে হবে কেন? ভাস্কর্য তো আর খেয়ে পরে বাঁচার জন্য অপরিহার্য নয়। ভাস্কর্য নন্দনতাত্ত্বিক এবং ভাববাচক গুরুত্ব বহন করে, ঢেকে রাখতে হলে সে গুরুত্ব শুধু ভূলুণ্ঠিতই হয় না বরং তাতে সাধারণ জনসাধারণের মনে ভাস্কর্য সম্পর্কে এমনই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় যে তা সাম্প্রদায়িক দিকে মোড় নেওয়ারও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে।
দেশে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উন্মুক্ত মন্দির রয়েছে, যিশুর ভাস্কর্য বা মূর্তি রয়েছে, বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। নামাজের জন্য এরপর সেগুলো ঢেকে রাখার দাবি উঠলে কী বলবে সরকার?
নারীর শরীরের আব্রু বিবেচনায় নিয়ে যদি ভাস্কর্য ঢাকতে হয় তাহলে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘অপরাজেয় বাংলা’, ‘রাজু ভাস্কর্য’ এবং এরকম ভাস্কর্যগুলো একই যুক্তিতে ঢাকা লাগে। এত ঢাকাঢাকি করতে গেলে বাংলাদেশটাই হয়ত ঢাকা পড়ে যাবে।
যে যুক্তিতে ‘জাস্টিসিয়া’ সরানোর কথা বা ঢাকার কথা বলা হচ্ছে সে যুক্তি মানলে ‘রাজু ভাস্কর্য’ তো আরো ভয়ঙ্কর! এখানে একজন বক্ষ উন্মীলিত নারী পুরুষের হাতে হাত ধরে সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে।
দিনাজপুরের কান্তজিউ মন্দিরে এবং পাহাড়পুরে এমন কিছু টেরাকোটার কাজ রয়েছে সেগুলো দৃশ্যত এবং তাৎপর্যের দিক থেকে অনেক বেশি উন্মুক্ত।
দৈর্ঘে ১০০ ফুট একটি বৌদ্ধ ভাস্কর্য বা মূর্তি রয়েছে কক্সবাজারের রামুর জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নে ২নং ওয়ার্ডের উত্তর মিঠাছড়ি পাহাড়চূড়ায়। আশেপাশের অনেক মসজিদ থেকেই এটি দেখা যায়। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে ভাস্কর্য ঢাকার বাস্তবতা তৈরি করলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এরকম দাবি উঠতে পারে।
ভাস্কর্য সরানো বা ঢেকে দেওয়ার প্রসঙ্গটির সাথে সাথে একটি বিষয় আপনা থেকেই উত্থাপিত হয়— সমস্যা কি তাহলে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে?
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের দেশ ভারতে গরু জবাই করা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বলে বাংলাদেশের হিন্দুদের এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই, আবার এটাও সত্য যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা চাইলে প্রকাশ্যে শুকর জবাই করতে পারবে না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু (ক্ষমতা কম হলে) হলে সহ্য করার বাস্তবতা মেনে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু গরিষ্ট (বেশি ক্ষমতা) হলে কিছু আর মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আসলে ভাস্কর্য কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের বিষয় নয়। আরবের অনেক দেশে প্রচুর ভাস্কর্য ছিল, এখনো আছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে, সেসব দেশে অনেক খোলামেলা ভাস্কর্যও রয়েছে। সেখানে কিন্তু মুসলিমরা ভাস্কর্য সরানো বা ঢেকে দেওয়ার কথা বলছে না।
অর্থাৎ ধর্মের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ক্ষমতার দম্ভই মূল কথা কিনা সেটি এখন অনেক বড় প্রশ্ন হয়ে সারা পৃথিবীতে দেখা দিচ্ছে। কারণ, ভাস্কর্য যদি এতটাই ধর্ম অবমাননাকর বিষয় হবে তাহলে ধরে নিতে হবে ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাস করছে যেসব মুসলিম তারা কেউই ধার্মিক নন।
শুধু ইউরোপ আমেরিকায় নয়, অনেক মুসলিম দেশেও এখনো অনেক ভাস্কর্য রয়েছে। আফ্রিকার পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে সেনেগালে রয়েছে ‘রেঁনেসা মনুমেন্ট’ ভাস্কর্যটি, এই প্রতিমূর্তিটি সেনেগালের বিখ্যাত জমজ পাহাড় কলিন্স দাস ম্যামিলিসের উপর স্থাপিত।
সেনেগালে শতকরা ৯৪ ভাগ মুসলমান। ধর্মীয় দিক থেকে সেনেগাল অত্যন্ত রক্ষণশীল একটি দেশ। তাই বলে কখনো এ ভাস্কর্যটি সরানোর কথা ওঠেনি, যদিও তামার এ ভাস্কর্যটিতে নারীদেহের প্রায় সবটুকুই উন্মুক্ত। এবং এটি আফ্রিকার সবচে উঁচু ভাস্কর্য।
ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে রয়েছে প্রায় একশো ফিট লম্বা যিশুর ভাস্কর্য ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার, যেটি প্রায় পুরো শহর থেকে দেখা যায় যেহেতু এটি ২৩০০ ফুট উঁচু কর্কোডাভো পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত। এটি আছে বলে ব্রাজিলে কোনো মুসলিম যাচ্ছে না, বা থাকছে না এমন তো নয়। কজাখস্তানের উস্কেমেনে মসজিদের সামনেই রয়েছে লেনিনের একটি ভাস্কর্য।
পৃথিবীতে অনেক ভাস্কর্য রয়েছে যেগুলো বিভিন্নভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। জর্জিয়ার “মুভিং স্টাচু অব এ ম্যান এন্ড ওম্যান” এদিক থেকে অগ্রগণ্য, যেটি প্রতিদিন একে অপরে বিলীন হয় অবলিলায়। মুসলিম যুবকের সাথে অন্য ধর্মের যুব রাণীর প্রেমের বিষয়টিকে মহিমান্বিত করে জর্জিয়াতে স্থাপিত হয়েছে এ ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি চলমান ভাস্কর্য।
“ট্রুথ ইজ বিউটি” নামে আমেরিকার সান লিয়েনড্রো, ক্যালিফোর্নিয়াতে ৫৫ ফুট উঁচু নগ্ন নারীর একটি ভাস্কর্য রয়েছে। এটি আছে বলে সেখানে কি মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করছে না, বা আমেরিকায় যাচ্ছে না? অর্থাৎ, সমস্যা আসলে ভাস্কর্য নয়, সমস্যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবিধা নিয়ে ধর্মীয় রাজনীতির সুযোগ তৈরি করা।
এগুলো রোধ করতে প্রয়োজন ধর্মটাকে শুধু ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক বিষয় হিসেবে দেখা, এবং সেটি যেন গণ বিষয়ে পরিণত না হয় সেদিকে রাষ্ট্রীয় নজরদারী বৃদ্ধি করা, প্রয়োজন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আইন করে বন্ধ করা।