২০ মে খুলনার চুকনগর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় কয়েক হাজার (১০ হাজার?) নিরীহ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪৬ বছর পার হলেও বধ্যভূমিটিতে পূর্ণাঙ্গ একটি কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়নি এখনো। সকল শহীদের নামের তালিকাটিও স্পষ্টভাবে নেই, স্বীকৃতিও দেয়া হয়নি শহীদদের সন্তানদের। পরিবারগুলো চরম দারিদ্র্যে কোনোমতে বেঁচে আছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলার সময় ৫ মে দক্ষিণাঞ্চলে বাংলাদেশের সর্ব প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এই রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেন সে সময়ের জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ। এ বাহিনী গঠন হওয়ার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। এই নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে বাগেরহাট, খুলনা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ফুলতলাসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার হাজার হাজার মানুষ ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে আশ্রয় নেয় ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকায়। ২০ মে সকাল ১০টার দিকে খাবার খেয়ে চুকনগর বাজার, ভদ্রা নদী, মালতিয়া গ্রামের পাতখোলার মাঠে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এসব মানুষ। তাদের উদ্দেশ্য দুপুরের দিকে কেশবপুর দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের দিকে রওনা হবেন।
ঐদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সাতক্ষীরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি গাড়ি আসে চুকনগর বাজারের পাতখোলা মাঠে। হানাদাররা সেখানে জড়ো হওয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে, সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় তাদের দোসররাও । জমিতে কাজ করা অবস্থায় মালতিয়া গ্রামের অধিবাসী কৃষক চিকন আলীকে সর্বপ্রথম গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়। পাকিস্তানি সেনাদের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর হাজার হাজার নারী-পুরুষের লাশ এখানে-সেখানে পড়ে থাকে। নজিরবিহীন এ নির্মম হত্যাকাণ্ডে মা-বাবা নিহত হলেও লাশের স্তুপের মধ্যে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় ৬ মাসের শিশুকন্যা সুন্দরী দাসী।
এরশাদ আলী মোড়ল বাবার লাশ খুঁজতে গিয়ে লাশের বুকের ওপর থেকে জীবিত অবস্থায় সুন্দরীকে উদ্ধার করেছিলেন। তবে বর্তমানে কষ্টে আর দুঃখের মধ্যে তার দিন কাটছে। সুন্দরী দাসী জানান, ৬ মাস বয়সের পর থেকে মা-বাবাকে হারিয়ে খুবই কষ্টে অন্যের কাছে বড় হয়েছি। তার স্বামীও বেঁচে নেই ফলে সংসার চালানোর মতো কেউ নেই।
অশ্রুসজল সুন্দরী দাসী ক্ষোভের সাথে বলেন, বসতবাড়ির জন্য বধ্যভূমির পাশে ১১ শতক জমি বরাদ্দ দিয়েছিল খুলনা জেলা প্রশাসন, কিন্তু দখলদারদের হাত থেকে সেই জমি আমি উদ্ধার করতে পারিনি।
সে দিনের এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী চুকনগর গণহত্যা ১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি ও চুকনগর কলেজের অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের পাঁচদফা দাবি আজো পূরণ হয়নি। চুকনগর এখনো অবহেলিত।’ তিনি বলেন, ২০০৯ সালের ২০ মে গণহত্যা দিবসের স্মরণসভায় জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলীর কাছে চুকনগরে বৃহত্তম গণহত্যার স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিসহ পাঁচদফা দাবি পেশ করে স্মৃতিরক্ষা পরিষদ। দাবিগুলোর মধ্যে ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের দলিলে চুকনগর গণহত্যার ইতিহাস যথাযথভাবে উল্লেখ করা, বধ্যভূমিতে জাদুঘর, লাইব্রেরি, কমপ্লেক্স নির্মাণসহ এখানে পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা ও কেয়ারটেকার নিয়োগ, ২০ মে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনে সরকারি ঘোষণা প্রদান এবং চুকনগর বাজার থেকে বধ্যভূমি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার পাকা সড়ক নির্মাণ।
তিনি বলেন, ২০০৫ সালে সাত লাখ টাকা ব্যয়ে চুকনগর বধ্যভূমিতে একটি সৌধ নির্মাণ করা হলেও এটা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাউকে নিয়োগ করা হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১৫ খণ্ডের দলিলের পাতায় চুকনগর গণহত্যার ইতিহাস লেখা না থাকায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, যেখানে ১০ হাজার মানুষকে এক সঙ্গে একদিনে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। এর চেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে হয়নি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের দলিলে যদি চুকনগর গণহত্যার কথা উল্লেখ না থাকে তা হলে আমি ব্যক্তিগতভাবে এ দলিলকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি না।
চুকগনর গণহত্যা দিবস যথাযথভাবে পালনে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে চুকনগর গণহত্যা ১৯৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ২০ মে প্রথম প্রহরে মশাল প্রজ্বলন ও আলোর মিছিল, সকালে বধ্যভূমিতে ফুলের মালা দিয়ে ১৯৭১-এর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী ও র্যালি, সকাল ১০টায় চুকনগর কলেজ প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা।