বইটি আত্মজৈবনিকমূলক হলেও নিজের কথা খুব বেছি নেই। লেখক মূলত তাঁর সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়, রাজনীতি, নেতৃত্ব, এবং বিশেষত ব্যাংকিং বিষয় তুলে এনেছেন গল্প বলার ঢংএ। শেখাতে চাননি কিছু, তারপরও তিনি বুঝিয়েছেন অনেক কিছু, অনেক ক্ষেত্রে লেখাগুলি ইঙ্গিতপূর্ণ, তবে বিদগ্ধ পাঠকের তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। তৎকালীন পল্টন ময়দান, এবং সে সময়ের মিছিল-সমাবেশ নিয়ে লিখেছেন ‘পল্টন কথা কয়’ নামক পরিচ্ছেদে। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “শেরে বাংলা এবং সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তব্য প্রদানের স্টাইলের পার্থক্য লক্ষণীয়। একজনের গল্পের আড়ালে কৌশলে জবাব প্রদান এবং সেইসাথে রসোত্তীর্ণ পরিবেশনা। অন্যজনের বক্তব্যের ঋজুতা, সহজ যুক্তিবোধ, জনগণের বুদ্ধির উপর আস্থা এবং গভীর আত্মপ্রত্যয়। লক্ষণীয়, দু’জনের কেউই উগ্রতার আশ্রয় নেননি। প্রতিপক্ষের উপর স্থুল আক্রমণ নেই। শব্দ দোষে দূষিত হয়নি ভাষণ। প্রতিপক্ষকে সম্মান জানানো হয়েছে। যুক্তির আলো দিয়ে বিদীর্ণ করা হয়েছে আবেগের কুয়াশা।” লেখাটুকুর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট তুলে ধরেছেন, যদিও তিনি বর্তমান নেতৃত্বের সাথে তাঁদের তুলনা করেননি, কিন্তু পাঠক পড়ার সময় নিশ্চয় তুলনা করে নেয়। ‘একাত্তরের মার্চের দিনগুলি’ নামক পরিচ্ছেদে তিনি লিখেছেন, “সকালে পাড়ার দু’একজন তরুণ এসে জানাল–রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ। কার্ফ্যু চলছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সব যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। আশা-নিরাশা-অস্থিরতার দোলায় দুলছি সবাই। অপরাহ্নে আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে তরুণ ডাক্তার শওকত সাহেব এসে সোৎসাহে জানালেন যে তিনি নিজ কানে রেডিও থেকে একটি ঘোষণা শুনেছেন ঐদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ তারিখে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি প্রচার করেছেন। মরুভূমিতে যেন মরুদ্যানের সন্ধান পেলাম আমরা।” এভাবে লেখক বইটিতে অনেক ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরেছেন সহজে। ‘সিভিল সোসাইটি কথা বলে বিবেকের টানে’ নামক পরিচ্ছেদে তিনি সিভিল সোসাইটি সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সামাজিক শত্রুরা সিভিল সোসাইটিরও শত্রু। এ জন্য রাজাকাররা ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করেছিল সমাজের নিরস্ত্র–বিদগ্ধ ব্যক্তিদের। তাদের উদ্দেশ্য সমাজকে পঙ্গু করা, সমাজের সংহতি শিথিল করা।” এখানে তিনি সিভিল সোসাইটির শত্রু চিহ্নিত করেছেন, সমাজের শত্রুরাই যে সিভিল সোসাইটির শত্রু সেটি তিনি বলেছেন। ‘তৃতীয় শক্তি: তৃতীয় মত’ পরিচ্ছেদে তিনি তৃতীয় মত এবং তৃতীয় শক্তিকে আলাদা করে দেখেছেন। একটি রাজনৈতিক দল গঠন যে একটি ধারবাহিক প্রক্রিয়া, তা এখানে তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। ধর্ম সম্পর্কেও লেখকের মতামত রয়েছে বইটিতে। সরাসরি মতামত না দিলেও তাঁর গল্পের আড়ালেই মতামত ফুঁটে উঠেছে। ‘মরমীবাদের কথা’ নামক পরিচ্ছিদে তিনি সুফিবাদের জয়গান গেয়েছেন। এ অংশের শেষে তিনি লিখেছেন, “বই পড়ে সুফীবাদের তত্ত্ব শেখা যায় না–সুফী হওয়া যায় না। সুফীর সংস্পর্শে থেকে সুফী হতে হয়। যুগ যুগ ধরে এ প্রথাই চলে আসছে। সুফীরা শুধু ধার্মিকই নন, তাঁরা মানবতাবাদী। সুফীরা কট্টর নন, তাঁরা উদার।” অর্থাৎ বইটিতে মূলত তিনি আমাদের দেশের বৃহৎ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন এবং সমাধানও দিয়েছেন, অথচ কোথাও তিনি বলেননি, এটা হওয়া উচিৎ বা এটা হওয়া উচিৎ নয়। তিনি তাঁর গল্প বলে গিয়েছেন, সেখানেই ঔচিত্য।অনৈচিত্য রয়েছে পরিষ্কারভাবে। শিক্ষনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বর্তমান প্রকাশনার দীনতা এবং শিক্ষানীতির অস্পষ্টতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি একমুখী শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন। তিনি মাদ্রসা রেখে মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আনার কথা বলেছেন। তিনি বাংলা ভাষা সম্পর্কে বলেছেন, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল গুলোতে বাংলা ভাষা কিভাবে অবহেলিত হচ্ছে সে কথা বলেছেন। পরিশেষে তিনি ব্যাংক সংস্কারের কথা তুলে ধরেছেন। এখানে তিনি নীতিমালার চেয়ে নীতিমালা বাস্তবায়নের দক্ষতার কথা বলেছেন, তিনি বলেছেন যোগ্য কর্মকর্তার কথা, কর্মকর্তা যোগ্য হলে একটা খারাপ নীতিমালা দিয়েও প্রতিষ্ঠান ভালভাবে চালানো সম্ভব আবার অযোগ্য কর্মকর্তারা ভাল নীতিমালা দিয়েও যে প্রতিষ্ঠান ভালভাবে চালাতে সমর্থ হবে না, একথা তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। বলেছেন, নিরবিচ্ছিন্ন সংস্কারের কথা। সংস্কার মাঝে মাঝেই করতে হয়, না হলে স্থবিরতা চলে আসে।
অর্থাৎ বইটি আত্মজৈবনিক হলেও এর মধ্যে আত্ম কথা খুব কমই আছে, আত্ম প্রচার তো নেইই। মূলত, তিনি গল্পের ছলে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আসলে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের মত একজন বহু বিদগ্ধ, অভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে পাঠকের আশাটাও এমনই। বইটিতে পড়ে পাঠকের আশাভঙ্গ হয় না মোটেও, আবার পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতার মতামত পড়ার মতও মনে হয় না, মনে হয় গল্পই শুনছি, যদিও সেগুলো মোটেও রূপকথা নয়।