বিয়ের পর স্বামী কিংবা স্ত্রীপক্ষ অন্য পক্ষের কাছে অর্থ-সম্পদ দাবি করলেই তা যৌতুক বলে বিবেচিত হবে না। এ ধরনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করলে সে মামলাও চলবে না। সম্প্রতি হাইকোর্ট এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন একটি মামলার রায়ে। এ রায় অনুযায়ী, বিয়ের সময় কোনো পক্ষ শর্ত দিয়ে থাকলে এবং পরে সে অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ দাবি করলে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে এবং তখন যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।
আইনজীবীরা বলছেন, ইদানীং পারিবারিক কলহ কিংবা দাম্পত্য-সংক্রান্ত অন্য কোনো জটিলতাকে যৌতুক দাবির ঘটনা সাজিয়ে যখন তখন মামলা দায়েরের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দেশের আদালতে যেসব নালিশি মামলা দায়ের হয় তার অন্তত ৫০ শতাংশ যৌতুক নিরোধ আইনের মামলা। ফলে আদালতগুলোতে মামলা জট মারাত্মক আকার নিয়েছে। হাইকোর্টের এমন সিদ্ধান্ত প্রকাশ হওয়ার পর আদালতে মামলা দায়েরের হার কমবে। পারিবারিক কলহের কারণে সাজানো ও মিথ্যা যৌতুক দাবির পরিমাণও কমবে।
আইনজীবীরা মনে করছেন, পারিবারিক কলহ ও পারিবারিক সহিংসতার মাধ্যমে নারী নির্যাতন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বিচারের জন্য পৃথক আইনও রয়েছে। কোনো নারী স্বামীর হাতে নির্যাতিত হলে তিনি ওই আইনে মামলা করতে পারেন। তাতে অভিযোগ প্রমাণতি হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির কঠোর শাস্তিরও বিধান রয়েছে। বরং নির্যাতনের ঘটনায় যৌতুক আইনে মামলা করলে তার ভিত্তি দুর্বল হবে।
যৌতুক নিরোধ আইনে করা একটি মামলা বাতিল চেয়ে আসামির করা আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি আবদুর রবের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। আদালত একই সঙ্গে মামলাটির কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করেন। এ বছরের শুরুর দিকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়েছে।
ওই মামলার আসামির নাম এন এম শফিকুর রহমান। ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সালমা সুলতানা নামের এক নারীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সালমা ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর স্বামীর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় মামলা করেন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, বিয়ের কিছুদিন পরই সালমা বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্ত। তিনি (সালমা) শ্বশুর-শাশুড়িকে বিষয়টি জানান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু শফিকুর জানান, তিনি অসুস্থ কিংবা হতাশাগ্রস্ত নন। সালমা মনে করেন, তাঁর স্বামী পরধন লোভী। সে জন্যই ব্যবসার কথা বলে তাঁর (সালমা) কাছে পাঁচ লাখ টাকা চান। বাবার বাড়ি থেকে ওই টাকা এনে দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে সালমা বাবার বাড়ি চলে যান। কিছুদিন পর তাঁকে ফিরিয়ে আনেন শফিকুর। কিন্তু তাঁর (শফিকুর) স্বভাব পরিবর্তন হয় না। ২০০৯ সালের ২০ মে আবার পাঁচ লাখ টাকা এনে দিতে চাপ দেন। এবার শফিকুর বলেন, তিনি ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান। সালমা ফের টাকা এনে দিতে অস্বীকার করেন। এতে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। সালমা স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাবার বাড়ি যেতে বাধ্য হন। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর সালমার বাবার বাড়ি গিয়ে একই পরিমাণ টাকা দাবি করেন শফিকুর। টাকা না দিলে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। পরে বাধ্য হয়ে সালমা তাঁর (শফিকুর) বিরুদ্ধে মামলা করেন।
আদালত শফিকুরের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে নেন। পরে মামলা বিচারের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-১৮তে স্থানান্তর করলে বিচারক আসামি শফিকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। শফিকুর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা বেআইনি হয়েছে—উল্লেখ করে মামলা কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট কেন মামলার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করা হবে না, সে মর্মে রুল জারি করেন। সেই রুলের শুনানি শেষে গত বছরের এপ্রিলে রায় দেন।
উচ্চ আদালত রায়ে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের সংজ্ঞার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ওই আইনের ২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিষয়বস্তু বা প্রসঙ্গে পরিপন্থী না হলে এই আইনে যৌতুক বলতে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে প্রদত্ত যেকোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বোঝাবে। যা ক. বিবাহের একপক্ষ অপর পক্ষকে অথবা খ. বিবাহের কোনো এক পক্ষের পিতা মাতার বা অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিবাহের যেকোনো পক্ষকে বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে বিবাহ মজলিসে অথবা বিবাহের পূর্বে বা পরে, বিবাহের পণরূপে প্রদান করে বা প্রদান করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।’ আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো উপঢৌকন যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে না।
আদালত রায়ে বলেছেন, আইনে স্পষ্ট রয়েছে, বিয়ের সময়কার শর্ত হিসেবে বিয়ের মজলিসে কিংবা বিয়ের আগে অথবা পরে কোনো সময় অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে তবে তা যৌতুক হিসেব গণ্য হবে।
আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের এই সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয় যে বৈবাহিক সম্পর্ক বলবৎ থাকা অবস্থায় বিবাহের পূর্ব শর্ত ছাড়া একপক্ষ আরেক পক্ষের কাছে অর্থ বা সম্পদ দাবি করলে তা যৌতুক বোঝাবে না এবং এমন মামলা খারিজযোগ্য।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, হাইকোর্ট বেশ কিছুদিন আগে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে যৌতুকের মামলা দায়ের ও যৌতুকের সংজ্ঞা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন হাইকোর্ট। এ রায় অনুযায়ী, বিবাহের সময়কার শর্ত ছাড়া বিবাহিত জীবনে যখন তখন টাকা বা সম্পদ দাবি করলেই তা যৌতুক হবে না। কিন্তু তাই বলে ধরে নেওয়া যাবে না যে শর্ত ছাড়া অর্থ-সম্পদ দাবি করে স্বামীরা স্ত্রী নির্যাতন করে না। এ ক্ষেত্রে এমন নির্যাতন হলে নারী নির্যাতন বা পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে মামলা হতে বাধা নেই। যৌতুক দাবি ভিন্ন অপরাধ, তার সঙ্গে নির্যাতন যোগ হলে ওই অপরাধের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সেটা অন্য আইনে বিচার্য।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ ইকতেদার আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, যৌতুক নিরোধ আইন অনুযায়ী, কেউ যৌতুক দাবি করলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে এই আইনে। কিন্তু যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করলে সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হতে পারে। পারিবারিক কলহ ও সাধারণ নির্যাতনের ক্ষেত্রে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে মামলা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আবার সতর্ক থাকতে হবে আদালতকে। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলাই মিথ্যা অভিযোগে করা হয়। তাই বিচার শুরুর আগে মামলার তদন্তকাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হবে। যাতে কোনো মিথ্যা মামলায় বিচারকাজ শুরু না হয় এবং কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি না পায়। আর যখন তখন স্বামী টাকা দাবি করেছে, এমন অভিযোগ করে মামলা করা হলে তা হাইকোর্টের এই রায় অনুযায়ী চলবে না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাকারিয়া হায়দার বলেন, সাজানো যৌতুকের মামলা করে পুরুষদের হয়রানি করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার সময় হাইকোর্টের রায় মেনে চললে মামলা জট থাকবে না। পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটলে ওই আইন অনুযায়ী মামলা হতে পারে। সূত্র: আশরাফ-উল-আলম ও রেজাউল করিম/কালের কণ্ঠ