জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদরঘাটের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে একটি মোড়, যেখান থেকে চারদিকে চারটি রাস্তা এবং উপরে ফুট-ওভার ব্রিজ গিয়েছে। বাম দিকে বাংলাবাজার। বাংলাবাজার রেখে আরো কিছুটা এগিয়ে গেলে প্যারিদাস রোড। বামে একটি চিকন গলিতে ঘুরলেই শ্রীশদাস লেন। এই লেনের ১নং বাড়িটি হচ্ছে বিউটি বোর্ডিং।
বিউটি বোর্ডং নামের ১নং শ্রীশদাস লেনে অবস্থিত এই দোতলা পুরাতন বাড়িটির সাথে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক গুণী মানুষের আড্ডাস্থল ছিল পুরনো ঢাকার বিউটি বোর্ডিং। বিউটি বোর্ডং এর জন্মলগ্ন থেকে এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, রণেশ দাসগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেরব সাহা, আহমেদ ছপা, হায়াৎ মাহমুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, খান আতা, আখতারুজ্জআমান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মহিউদ্দিন আহমেদ, আ্সাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুর হক, জুয়েল আইচ প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তির পদচারণায় মুখরিত থাকত বিউটি বোর্ডিং।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিউটি বোর্ডিং-এর বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। ’৪৭ এ দেশভাগের আগে সেখানে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস এবং প্রেস। দেশভাগের পরে পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় চলে যায়। এরপর পঞ্চাশের দশকে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা বাড়িটিতে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে নিহত হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। প্রহ্ণাদ চন্দ্রের পরিবার জীবন রক্ষায় ভারত চলে যায় তখন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন।
বিউটি বোর্ডিংয়ের মুখর আড্ডা আগের মতো আর নেই। তবে খাবারের ঘরে ভিড় এখনো থাকে। ভোজনরসিকরা ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং-এ একবেলা খেয়ে গর্ববোধ করে। খাবার বিষয়ে স্থানীয়দের, বিশেষ করে বাংলাবাজারস্থ লেখক-প্রকাশকদের অভিযোগ রয়েছে খাবারের মান এবং দাম নিয়ে। মানের তুলনায় খাবারের দাম অনেক বেশি বলে তাদের অভিযোগ।
এ প্রসঙ্গে বোর্ডিংটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমর সাহা বলেন, “বাজার দরের সাথে খাবারের দাম হেরফের হয়। তাছাড়া বিভিন্ন অলিখিত বিষয়াদি থাকে, যার কারণে খাবারের দাম বাড়ে।”
একটি বাস কোম্পানির এজেন্সি নেওয়া প্রসঙ্গে এবং কোম্পানিটির বড় বড় সাইনবোর্ড বাইরের গেটসহ ভেতরে সাঁটা থাকায় বিউটি বোর্ডিং তার আপন ঐতিহ্য থেকে সরে যাচ্ছে কিনা -বিষয়ে জানতে চাইলে তারক সাহা বলেন, “সকল বড় বড় হোটেলে এটা থাকে, বাস কোম্পানির সাথে চুক্তি থাকলে গ্রাহকদের সুবিধা হয়।” সাইনবোর্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “‘বিউটি বোর্ডিং’ লেখা সাইনবোর্ডটি পুরনো বলে নতুনটি বেশি চোখে পড়ছে, পুরনোটির সংস্কার করলে ঠিক হয়ে যাবে।”
স্থানীয় কিছু লোক, এবং কয়েকজন লেখক-প্রকাশক অভিযোগ করেন- এভাবে একটি বাস কোম্পানির সাইনবোর্ড বড় বড় করে ঝুলানোয় বিউটি বোর্ডিং-এর ঐতিহ্য বিনষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয়রা বোর্ডিং-এর পিছন দিককার সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাদের দাবি, এভাবে গাছ কেটে সংস্কার করা ঠিক হচ্ছে না। বিউটি বোর্ডিং বর্তমানে যারা ‘পরিচলানা’ করছেন তাদের সে একতিয়ার নেই বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন মত প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনাব তারক সাহা বলেন, “সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কার করার জন্য গাছটি কাটতে হয়েছে। সময়ের ফেরে কিছু পরিবর্তন হবেই। তবে বিউটি বোর্ডি আগের মতই তার ঐতিহ্য বজায় রাখবে।” সাহিত্য-সংস্কৃতির আড্ডা সংকুচিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বিষয়টিকে জাতীয় সংকট বলেছেন।
জন্মলগ্ন থেকে এই এলাকার বাসিন্দা, রাজনীতিক, পুস্তক প্রকাশনা ও ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি জনাব আলমগির সিকদার লোটন বলেন, “আমরা চাই বিউটি বোর্ডিং-এর ঐতিহ্য অটুট থাক। আমরা এটিকে অবিকৃত দেখতে চাই।