কুজনেটস্ কার্ভ একটি দেশের উন্নতি এবং তার নাগরিকদের আয় বৈষম্যের মধ্যে একটি সম্পর্ক নিরুপণ করে। রাশিয়ান-আমেরিকান অর্থনীতিবিদ সায়মন কুজনেটস্ ১৯৭১ সালে ইকোনোমিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে কাজ করে নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই প্রথম জিডিপি হিসেব করার নিয়মটি আবিষ্কার করেন। তার আর একটি বড় কীর্তি হচ্ছে কুজনেটস্ কার্ভ।
সায়মন কুজনেটস্ দেখিয়েছেন— একটি দেশ যখন উন্নতির প্রথম পর্যায়ে থাকে তখন অর্থনৈতিক বৈষম্য (ইনকাম ইনইকুয়ালিটি) বাড়তে থাকে, তবে চূড়ায় পৌঁছানোর পর এটি আবার কমতে শুরু করে। বিপরীতক্রমে বলা যায়— আয় বৈষম্য উন্নতি ত্বরান্নিত করে। উনি বলতে চেয়েছেন— বিষয়টি এতটাই স্বয়ংক্রিয় যে, এটা অন্যান্য সকল চলক নির্বিশেষে সত্য। বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে— সায়মন কুজনেটস্ একটি দেশের উন্নতি বলতে শুধু প্রবৃদ্ধি বুঝতে চেয়েছেন। অন্যান্য সামাজিক, মানবিক, এমনকি সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো এবং হস্তক্ষেপ পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। উনি প্রকারন্তরে মূলত পুঁজিবাদ এবং বেসরকারিকরণের পক্ষে কথা বলেছেন।
ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি (জন্মঃ ১৯৭১) কুজনেটসের সিদ্ধান্তের, বিশেষ করে উল্টানো ‘ইউ’ হাইপোথিসিসের তীব্র সমালোচনা করেছেন। পিকেটি বিশ্বাস করেন যে, কুজনেট বক্ররেখাটি বিভ্রান্তিকর, এবং নতুন তথ্যের সাথে বক্ররেখার বহিঃপ্রকাশ ঘটালে ব্যাপকভাবে ভিন্ন ফলাফল পাওয়া যাবে। পিকেটি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, কুজনেট কার্ভ অর্থনীতিবিদদের শুধুমাত্র বিভ্রান্ত করতে সফল হয়েছে এবং অসমতার (ইনইকুয়ালিটি) বিষয়ে গবেষণা থেকে তাদের বিভ্রান্ত করেছে, বিরত রেখেছে। যখন কুজনেটস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ৩৫ বছরের সময়কালের (১৯১৩ – ১৯৪৮) টাইম সিরিজ ডেটা ব্যবহার করেছেন, পিকেটি সেই সময়কালকে ১০০ বছর পর্যন্ত বাড়িয়েছেন এবং দেখিয়েছেন যে, জনসংখ্যার শীর্ষ ১% দ্বারা আয়ের অংশ একটি ‘U’ আকৃতির বক্ররেখা অনুসরণ করে।
পিকেটির বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য ১৯৩০ সালের মহামন্দার ঠিক আগে এবং সেইসাথে ২০০৭ সালের আর্থিক সংকটের আগেও বেড়ে গিয়েছিলো। এর থেকে বুঝতে পারা যায় যে, অত্যধিক উচ্চ মাত্রার বৈষম্য একটি দেশকে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা সম্ভাব্য একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে কম বৈষম্যের সময়কালে অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৭ – ১৯৭৭ সময়কালে, যা ‘মহান সমৃদ্ধির সময়কাল’ নামেও পরিচিত, এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তর্কযোগ্যভাবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলো, এবং এ সবই হয়েছিলো কম বৈষম্যের পটভূমিতে।
কুজনেটস্ কার্ভ বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সত্য হয়েছে, নাকি এসব দেশে সত্য করা হয়েছে? এটা অনেকটা স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করে সে অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ করার মতো।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, একইসাথে আয় বৈষম্যও প্রবলভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্টাটিসটিকসের ডাটা মতে ২০১০ সালে বাংলাদেশের গিনি রেশিও ছিলো ০.৪৬, ২০২২ সালে এটি হয়েছে ০.৫৭। অর্থাৎ বৈষম্য বেড়েছে। উন্নতিও হচ্ছে, বলা যায়— কুজনেটস্ কার্ভ এখানে সত্য হয়েছে, ভীষণভাবে সত্য হচ্ছে। নাকি মুখ থুবড়ে পড়বে? এশিয়ার যে আটটি দেশকে ‘ইস্ট এশিয়ান মিরাকল’ বলা হয়, সেসব দেশে কুজনেটস্ কার্ভ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ভুল প্রমাণ করে তারা উন্নতিও করেছে, একইসাথে বৈষম্যও কমিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে হয়তো শুধু বৈষম্যটাই চূড়ায় পৌঁছাবে, উন্নতি সে অর্থে হবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে কুজনেটস্ কার্ভ উল্টোপথে ভুল প্রমাণিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে আসলে কী হয়েছে— তারা উন্নতির চূড়ায় পৌঁছালেও বৈষম্য কমাকে পারেনি।
[গিনি কোএফিশিয়েন্ট এবং গিনি রেশিও হচ্ছে আয় বৈষম্য নিরুপণের একটি উপায়, যা ০ থেকে ১ অংকে নিরুপণ করা হয়। গিনি কোএফিশিয়েন্ট ১ হওয়ার অর্থ এর চেয়ে বেশি বৈষম্য আর হতে পারে না, ০ হওয়ার অর্থ— সর্বনিম্ন বৈষম্য বা বৈষম্য নেই।]