পৃথিবীতে শীর্ষ পাঁচটি চিনি রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে— ব্রাজিল, ভারত, থাইল্যান্ড, জার্মানি এবং ফ্রান্স। মোট চিনি রপ্তানির ৩৬ থেকে ৪০ শতাংশ রপ্তানি করে ব্রাজিল। ভারত রপ্তানি করে ১৫ থেকে ১৮%। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত হওয়ায় এবং ভারত একটি চিনি রপ্তানিকারক দেশ হওয়ায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের চিনির বাজারমূল্যে খুব বেশি পার্থক্য হওয়ার কথা না থাকলেও দেখা যাচ্ছে ভারতে সাথেই এখন বাজার মূল্যে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য। ভারতে বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশী টাকায় ৫৫ টাকা, অথচ বাংলাদেশের বাজারে চিনি এখন ১৪০টাকা। এত বড় পার্থক্যের কারণ কী? বিশ্ববাজারে চিনি ঘাটতির দিক দিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে পাঁচ নম্বরে। বাংলাদেশের প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের চিনি আমদানী করা লাগে। একটা দেশে সকল ধরনের পণ্য উৎপাদনের করতে পারবে এটা বাস্তবসম্মত নয়, তাই আমদানী সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে কোন দেশ থেকে কত দামে আমদানী করছে, এবং কত টাকা শুল্ক বসছে, এবং কত দামে তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদনে প্রথম হলেও ভারত চিনি রপ্তানিতে দ্বিতীয়। ভারত সবসময় তাদের অভ্যান্তরীণ চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। দেশে দাম বাড়তে দেয় না। ভারত বছরে কম বেশি এক কোটি টন চিনি রপ্তানি করে থাকে। আর বাংলাদেশের বছরে চিনি আমদানী করার প্রয়োজন হয় ১৮ থেকে ২২ লক্ষ টন। অতএব, বাংলাদেশের যে পরিমাণ চিনি আমদানীর প্রয়োজন পড়ে তার পুরোটাই ভারত থেকে আমদানী করা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে কেন তা হয় না?
গতবছর টিসিবি ব্রাজিল থেকে প্রতি টন চিনি আমদানী করেছিলো ৫২৪ মার্কিন ডলার দাম দিয়ে। এদিকে প্রাণ এবং আকিজ গ্রুপ ভারত থেকে চিনি আমদানী করেছে ৫৬০ থেকে ৫৭৫ মার্কিন ডলারে। যেহেতু ভারত থেকে আমদানী করতে ট্রান্সপোর্ট খরচ অনেক কম, তাই দাম একটু বেশি হলেও ভারত থেকে আনাই যুক্তিযুক্ত। প্রশ্ন হচ্ছে— টিসিবি কেন ভারত থেকে আমদানী করতে পারলো না। কোম্পানিগুলোর চিনি আমদানীর ক্ষেত্রে শুল্কসহ দাম পড়ে যাচ্ছে একশো টাকার ওপরে। অতএব, এটা নিশ্চিত যে সরকার চিনিতে ভর্তুকি না দিলে বা শুল্ক প্রত্যাহার না করলে চিনির দাম সহসা কমবে না। এক্ষেত্রে একটি পার্থক্য অবশ্যই লক্ষণীয়— ভ্যাট ট্যাক্সসহ চিনি আমদানীতে গত বছরের শেষের দিকে টিসিবির খরচ হয়েছিলো ৯০ টাকার মতো, যেখানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর খরচ হয়েছিলো ১০৩ টাকা, ফলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আসলে আমদানীকৃত চিনির কেজি প্রতি খরচ কত?
চিনির ক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়াও একটি আমদানী নির্ভর দেশ। এবং আমদানীর পরিমাণের দিক থেকে তারা বাংলাদেশেরও উপরে। চিনির মূল্যের দিক থেকে বাংলাদেশ রয়েছে ৬২ নম্বরে এবং ইন্দোনেশিয়া রয়েছে ৭১ নম্বরে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতি কেজি চিনির যে মূল্য দেখিয়েছে (১.০৫ মার্কিন ডলার) তার থেকে অন্তত ২০ টাকা বেশি দামে দেশের বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ায় বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ০.৯১ ডলারে। বর্তমানে ১ ইউএস ডলার সমান প্রায় তিনশো পাকিস্তানি রুপি, ফলে ডলারে পাকিস্তানে চিনের দাম দেখে রুপিতে দাম বোঝা যাবে না। মজার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেমন বাংলাদেশের তুলনায় চিনির দাম অনেক কম, আবার ব্রাজিলের প্রতিবেশী দেশ আর্জেন্টিনাতে চিনির দাম ব্রাজিলের তুলনায় অনেক বেশি। আর্জেন্টিনাতে প্রতি কেজি চিনি বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে দেড় মার্কিন ডলারে। ব্রাজিল ভারতের মতো তার অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির দাম খুব বেশি কমিয়ে রাখে না। ব্রাজিলের বাজারে এক কেজি চিনি বিক্রি হয় কমবেশি এক মার্কিন ডলারে। বাংলাদেশে আমরা মূলত ভারতের সাথে তুলনা করে আমাদের দাম হিসেব করি। কিন্তু ভারত সাধারণত অভ্যন্তরীণ চাহিদা নিশ্চিত করে তারপরে রপ্তানি করে। গণতন্ত্রের পাশাপাশি ভারতে এখনো কিছুটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিদ্যমান থাকায় ভারতের জনগণ অনেকটা কম মূল্যে চিনির মতো কিছু পণ্য পেয়ে থাকে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলোর সংকটের একটা বড় কারণ হলো উৎপাদন খরচ আমদানিকৃত চিনির বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। আর কলগুলোর বাড়তি উৎপাদন খরচের কারণ কয়েকটি— এর মধ্যে দুর্নীতি বড় একটি কারণ। এছাড়া কলগুলো মাড়াই করার মতো পর্যাপ্ত আখ পায় না, এতে বছরের একটা বড় সময়জুড়ে কারখানাগুলো বন্ধ থাকে, কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা দিয়ে যেতে হয়। এই খরচ উৎপাদন খরচের সাথে যুক্ত হয়। যে আখ পাওয়া যায়, তা থেকে চিনি আহরণের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক কম— ৬–৭ শতাংশ। ভারতে বা ব্রাজিলে এই হার ১২–১৪ শতাংশ। ফলে ১০০ কেজি আখ থেকে ভারত বা ব্রাজিল যে পরিমাণ চিনি আহরণ করে, বাংলাদেশ করে তার প্রায় অর্ধেক। চিনি উৎপাদনের মোট খরচের প্রায় ৪০ শতাংশই হয় কাঁচামাল বাবদ, ফলে এত পরিমাণ কম চিনি আহরণের ফলেও উৎপাদন খরচের ওপর ব্যাপক একটি প্রভাব পড়ে। চিনি আহরণের এই অতি নিম্ন হারের কারণে বাংলাদেশে কলগুলোর কাঁচামাল বাবদ খরচ ভারতীয় কলগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ, যা শেষ পর্যন্ত প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ হিসেবে যোগ হচ্ছে। আখ পাওয়া যায় না তার কারণ— দেশে আবাদী জমির সংকট রয়েছে— এক ফসল বেশি আবাদ করতে গেলে অন্য ফসলে টান পড়ে। এছাড়া কৃষকরা আখ সময়মতো বিক্রি করতে পারে না বলে তারা আখ উৎপাদন না করে ধান বা অন্য কোনো শস্য উৎপাদন করে থাকে। চাষাবাদ ব্যবস্থার বিভিন্ন সংকটের কারণে দেশে একরপ্রতি আখের ফলন ১৮ থেকে ১৯ টন, যা অন্যান্য আখ উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় খুবই কম। যেমন সারা ভারতের গড় উৎপাদন ২৮ টন।
বাংলাদেশে সরকারি চিনিকলগুলোতে চিনি উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ার আরেকটি বড় কারণ ঋণের বোঝা। প্রতিবছর ঋণের সুদ বাবদ বিপুল অর্থ খরচ হওয়ার কারণেও চিনির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। চিনির উৎপাদন খরচের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই হলো ঋণের সুদ! ২০২০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের ১৫টি রাষ্ট্রীয় চিনিকলের মধ্যে ৬টিতে আখমাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ কলগুলো হলো— পাবনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, পঞ্চগড়, শ্যামপুর ও সেতাবগঞ্জ চিনিকল। এই চিনিকলগুলো লোকসান এবং ঋণের ভারে জর্জরিত। এছাড়া সচল চিনিকলগুলো বেশিরভাগ লোকসানে চলে, ঋণ তো রয়েছেই। কেরু এন্ড কোং উপজাত থেকে, বিশেষ করে মদ থেকে পুশিয়ে নেয় বলে এটি সফলভাবে সচল রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন ও চিনিকলগুলো ৬ হাজার ৪৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের সুদের পরিমাণ ৩ হাজার ৮৫ কোটি টাকা হয়েছে। বর্তমানে সদর দপ্তরের ঋণসহ চিনিকলগুলোকে ৭ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা সুদসহ বকেয়া ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এখান থেকে উত্তরণের একটাই পথ— চিনিকলগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া বা ঋণের সুদ মওকুফ করা।
চিনিকলগুলোয় চিনি আহরণের হার এত কম হওয়ার কারণ শুধু আখে চিনি কম থাকা নয়। সময়মতো আখ সংগ্রহ না করলে, আখ ক্রয় করে ফেলে রাখলে চিনির পরিমাণ কমে যায়। সবচেয়ে বড় কারণ— যান্ত্রিকভাবে যথেষ্ট পরিমাণ চিনি আহরণ করতে না পারা। চিনিকল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, কৃষকদের কাছ থেকে কেনা আখের চিনি ধারণক্ষমতা ৮ থেকে ৯ শতাংশ; ২.৩৫ থেকে ২.৪০ শতাংশ কারখানা লস যুক্ত করেই নাকি তারা এ হিসেব করে থাকে।
অন্যদিকে ইক্ষু গবেষণা সংস্থার বক্তব্য হলো— আখে চিনির পরিমাণ ১২ শতাংশের কম থাকে না। মূলত কারখানাগুলোতে চিনি লস বা অপচয় বেশি হওয়ার কারণেই আহরণের হার কম হয়। এই অপচয় অনুমোদিত মাত্রার মধ্যে দেখানোর জন্য পেছন থেকে হিসাব করে আখের চিনির হার কম করে দেখানো হয় বলেও অভিযোগ আছে। আসলে আখে চিনি থাকলেও কম আহরণ হওয়ার কারণ হলো, আখ মাড়াই করে রস বের করার যন্ত্র (রোলার) ঠিকঠাক কাজ না করা, নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার, রস প্রক্রিয়াজাত করার সময় রসের তাপমাত্রা ও অম্লত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হওয়া ইত্যাদি। উৎপাদনের খরচের কারণ হিসেবে উপরিউক্ত সব কারণের পাশাপাশি প্রতি টন আখ মাড়াইয়ে বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আখ মাড়াইকালে সময়ের অপচয় ইত্যাদিও অনেক বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ চিনি প্রয়োজন হয়, তার সিংহভাগই আমদানী করতে হয়। বর্তমানে আমদানী খরচের সাথে প্রায় সমপরিমাণ শুল্ক যোগ হওয়ায় চিনির দাম বেশ আগেই একশো টাকা অতিক্রম করেছে, এখন তা খোলাবাজারে দেড়শো টাকার কাছাকাছি। চিনির দাম কমাতে গেলে সরকারি চিনিকলগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া এবং আমদানী শুল্ক প্রত্যাহার করার কোনো বিকল্প নেই। বাজার মনিটরিংসহ অন্যসব পন্থা অবলম্বন করে চিনির দাম সামান্য কমানো সম্ভব হলেও সেটি টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। শীর্ষ পাঁচ চিনি আমদানীকারণ দেশের মধ্যে চিনির মূল্যের তারতম্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়— বাংলাদেশের চেয়ে ইন্দোনেশিয়ায় চিনির মূল্য কম। বাংলাদেশের চেয়ে ইন্দোনেশিয়ার চিনি আমদানী করতে হয় বেশি। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রে চিনির দাম বেশি। একটি প্রশ্ন থেকে যাচ্— স্বাস্থ্যগত কারণেই চিনির দাম একটু বেশি থাকা ভালো কিনা, ভর্তুকি দিয়ে চিনির দাম কমিয়ে রাখা আসলেই উচিৎ কিনা? এছাড়া চিনির দাম বেশি থাকলে আমাদের প্রাচীন গুড় শিল্পের আবার জাগরণের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ভর্তুকি দিয়ে চিনির দাম আদৌ কমিয়ে রাখার প্রয়োজন রয়েছে কিনা, এটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।
ফলোআপ নিউজ ডেস্ক