Headlines

মাছই হতে পারে বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদার প্রধান খাদ্যোপকরণ // দিব্যেন্দু দ্বীপ

সামুদ্রিক মাছ

সামুদ্রিক মাছ

এবস্ট্রাক্ট

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি মাছ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে একটি। গত এক দশকে দেশটি স্বাদুপানির মাছ চাষে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে। অধিক ইলিশ উৎপাদন এবং সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা ও রপ্তানি আয়ের জন্য সামগ্রিক উৎপাদনের পরিমাণ এবং মাছের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা সম্ভব। মাছ— চাষের এবং প্রাকৃতিক, উভয় মিলিয়ে আমাদের জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার প্রাথমিক স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কৃষি বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো এমন একটি জনসংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি যাদের সম্পূর্ণরূপে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসমস্যা নেই। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, বাজারে মাছ ও খাবারের প্রচুর সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও আমাদের জনগণ “নীরব ক্ষুধায়” (বা অপুষ্টিতে) ভোগে। প্রায় ২০ মিলিয়ন নারী ও শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, হয় তারা রক্তস্বল্পতায় ভুগছে (নারী) অথবা স্টান্টিং বা শারীরিক বৃদ্ধিজনিত সমস্যার শিকার (শিশু ও কিশোরী)। তাদের খাদ্য তালিকায় সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নেই।

মূল শব্দ: মাছ, পুষ্টি চাহিদা, অপুষ্টি

ভূমিকা

জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যের ওয়ার্ল্ডোমিটার বিশদ বিবরণের ভিত্তিতে ১১ নভেম্বও ২০২২ শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা হলো ১৬৮,৫৫১,৪৭২। ৪.৫৬ মিলিয়ন হেক্টর (ডিওএফ ২০০৫) এলাকা জুড়ে পুকুর, প্রাকৃতিক নিম্নাঞ্চল (হাওর এবং বিল), হ্রদ, খাল, নদী এবং মোহনার আকারে একটি বিস্তৃত জলজ সম্পদ থাকার জন্য দেশটি ভাগ্যবান। তদুপরি এত বড় একটি জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত আমিষের যোগান দেওয়া একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। যদিও চাষের পাশাপাশি প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদে ভরপুর একটি দেশ বাংলাদেশ। দেশের মোট জিডিপির ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এখন মৎস্য খাতের অবদান। বিগত ১২ বছরে মৎস্য খাতে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মোট মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সামুদ্রিক মাছের অবদান ৬ দশমিক ৮১ লাখ মেট্রিক টন, যা দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার মেট্রিক টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

বিশ্লেষণ

মাছের প্রজাতি নির্বাচন, নমনীয় ও উন্নত সরবরাহ শৃঙ্খল, পুষ্টি শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার জন্য খাদ্য তালিকায় আমীষ অংশের নিশ্চয়তা প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অপুষ্টি দূর করা সম্ভব। বাংলাদেশে এখন মাছের উৎপাদন ঘাটতি নেই। ৪.৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন উৎপাদনের সাথে সাথে বাংলাদেশ মাথাপিছু ৬৩ গ্রাম প্রাপ্যতা অর্জন করেছে, যা মাথাপিছু দৈনিক ৬০ গ্রাম প্রস্তাবিত ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রাকে সফলভাবে অতিক্রম করেছে। বর্তমানে দেশটি তার জনসংখ্যার পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত মাছ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এই উৎপাদনের প্রধান অনুপাত— ৫৬ শতাংশ মাছ আসে জলজ চাষ থেকে। এই জলজ খামারগুলির বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত এবং এর একটি ভালো অংশ গৃহস্থালির পুকুর থেকে আসে। যথেষ্ট মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ সক্ষম হলেও ডেটা বলছে যদিও এখন মাথাপিছু ৬৩ গ্রাম মাছ পাওয়া যায়, তবে উপাখ্যানমূলক প্রমাণ থেকে জানা যায় যে, গ্রামীণ এবং শহুরে দরিদ্র পরিবারগুলিতে মাছের গড় দৈনিক খরচ জাতীয় গড় থেকে অনেক কম। এটি তাদের পুষ্টির চাহিদাকে প্রভাবিত করে। ফলে মৎস্য সম্পদ সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে অন্যসব পণ্যের মতো সরকারি উদ্যোগে সমুদ্রে মাছ ধরার ব্যবস্থা থাকতে পারে, সেগুলো স্বল্পমূল্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে বিক্রি করা যেতে পারে। এইভাবে উৎপাদিত মাছের সহজলভ্যতা, ক্রয়ক্ষমতা, সঞ্চয়স্থান, গুণমান ও উপযোগিতা উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিৎ। প্রয়োজন বিবেচনায় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি বৈশ্বিক অগ্রাধিকার এজেন্ডার শীর্ষে উঠে এসেছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-২ হিসেবে স্থান পেয়েছে: “ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা এবং উন্নত পুষ্টি অর্জন”। খাদ্য নিরাপত্তা একটি দেশের প্রত্যেকের জন্য খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং ক্রয়ক্ষমতা হিসাবে বিবেচিত হয়। ফলে শুধু প্রাপ্যতা নিশ্চিত করলে হবে না সকলের ক্রয়ক্ষমতাও নিশ্চিত করতে হবে।
মৎস্য সম্পদই বাংলাদেশে পুষ্টির চাহিদায় সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে। তারপরেও আমাদের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে। এক দশক ধরে সরকারের প্রচেষ্টার কারণে শিশুদের মধ্যে মারাত্মকভাবে কম ওজনের প্রবণতা ২০১২ সালের ৩১.৯ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ২২.৬ শতাংশে নেমে এসেছে। মাঝারি থেকে গুরুতর বৃদ্ধিজনিত সমস্যা ২০১২ সালের ৪২ শতাংশ থেকে একই সময়ের মধ্যে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এখনো অন্তত ৩৯ শতাংশ মহিলা অপুষ্টিতে ভুগছেন।
গর্ভবতী মহিলা, নতুন মা এবং শিশুদের মধ্যে উচ্চ স্তরের অপুষ্টি ঘটে, যাদের অত্যাবশ্যকীয় মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টসমৃদ্ধ খাবারে সীমিত প্রবেশাধিকার রয়েছে। মাছ খাওয়া দেশের এই দৃশ্যপট পরিবর্তন করতে পারে। নির্দিষ্ট মাছের প্রজাতির বর্ধিত ব্যবহার মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট, প্রয়োজনীয় খনিজ, প্রোটিন সরবরাহ করতে পারে এবং সব বয়সের মানুষের জন্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। কিছু অভ্যন্তরীণ মাছ যেমন মোল, ঢেলা, ডার্কিনা, চেলা এবং সমস্ত পেলাজিক সামুদ্রিক মাছ মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানে সমৃদ্ধ যা শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, মস্তিষ্ক এবং বোধশক্তির বিকাশে সহায়তা করে এবং মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতা কমাতে পারে।
ছোট মাছ অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, আয়োডিন, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন বি ১২-এর মতো মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টে সমৃদ্ধ। খাদ্য সমৃদ্ধ করার জন্য পুষ্টিসমৃদ্ধ দেশি ছোট মাছকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমাদের জলজ প্রজাতির বৈচিত্র্যের ওপর জোর দিতে হবে। মাছ হলো পুষ্টি-ঘন উচ্চ-মানের প্রোটিন, লো-চেইন পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড এবং মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টের একটি অত্যাবশ্যক উৎস। মাছের ব্যবহার অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
কার্পস, পাঙ্গাস এবং তেলাপিয়া উৎপাদনের জলজ চাষে অসাধারণ সাফল্য সত্ত্বেও গ্রামীণ ও শহুরে মানুষ পুষ্টিসমৃদ্ধ ছোট মাছের ঐতিহ্য থেকে বঞ্চিত। এই মাছ একসময় অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে ছিল, বিনামূল্যে যে কেউ তা সংগ্রহ করতে পারত। বিএফআরআই (বাংলাদেশ ফিশ রিসার্চ ইনস্টিটিউট) এবং ব্যক্তিগত হ্যাচারিতে প্রজনন সাফল্যের মাধ্যমে এখন অনেক ছোট স্থানীয় প্রজাতির মাছের বীজ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের এখন উদ্ভাবনী পুষ্টি-সংবেদনশীল জলজ চাষকে প্রচার করা উচিৎ, অর্থাৎ ছোট আকারের পুকুর এবং ধান ক্ষেতে কার্পস, তেলাপিয়া সহ ছোট মাছ চাষ করতে হবে। ছোট মাছ পরিবার দ্বারা খাওয়া যায়, এবং বড় মাছ পরিবারের আয়ের জন্য বিক্রি করা হয়।
মৎস্য বিভাগ, বাংলাদেশ ফিশারিস রিসার্চ ইনস্টিডঁউট (বিএফআরআই), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলি বিজ্ঞান-ভিত্তিক পুষ্টি-সংবেদনশীল এমন সব জলজ প্রযুক্তি এবং প্রজাতির বিকাশে কাজ করতে পারে, যা পুষ্টিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে উপকারী, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং পরিবেশগতভাবে সৌম্য হবে। দেশব্যাপী মাছ, সামুদ্রিক মাছ এবং ইলিশ বিতরণের জন্য হিমাগার, মাছ শুকানো, লবণাক্তকরণ, বরফ ও পরিবহনের মতো ভালো সুবিধা প্রয়োজন। এটি বর্জ্য হ্রাস, দ্রুত প্রাপ্যতা এবং এমনকি বাজার বণ্টন নিশ্চিত করবে। আমাদের উচিৎ স্থানীয় মাছের বাজার উন্নত করা এবং প্রধান মাছ উৎপাদন ও অবতরণস্থলে বাজার কেন্দ্র স্থাপন করা। ত্রিশাল (ময়মনসিংহে) পাইকারি মাছের বাজার এমন মাছের হাবের উদাহরণ হতে পারে। সারাদেশে ত্রিশ থেকে চল্লিশটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য উৎপাদন কেন্দ্রে এ ধরনের হাব স্থাপন করা যেতে পারে। মাছের বাজারের উন্নত স্টোরেজ সুবিধা, পরিষ্কার ভূগর্ভস্থ পানি, বিদ্যুৎ এবং উন্নত কোল্ড চেইন থাকা উচিৎ। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।
খাদ্য তালিকায় মাছের ব্যবহার বাড়াতে হবে। স্কুল ফিডিং প্রোগ্রামে মাছ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। হাসপাতালগুলি নিয়মিত রোগীর খাবারে মাছ সরবরাহ করতে পারে। মাছকে আমাদের খাদ্যের একটি সক্রিয় অংশ হিসাবে প্রচার করার জন্য আরও কাজ করা প্রয়োজন, যা সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি, খনিজ এবং প্রোটিন সরবরাহ করে। উৎপাদনের জন্য খনিজ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ মাছের সঠিক প্রজাতি নির্বাচন, একটি দক্ষ মাছ বিতরণের সাপ্লাই চেইন তৈরি করা, মাছকে প্রধান খাদ্য হিসেবে প্রচার করা এবং সঠিক পুষ্টি শিক্ষা আমাদের দেশকে অপুষ্টির বাধা ভাঙতে সাহায্য করবে।

সমুদ্রে মাছ শিকার

দেশে আমিষের চাহিদার বৃহৎ অংশের জোগান দেয় সামুদ্রিক মাছ। বিগত অর্থ বছরে (২০২০-২০২১) ৬ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে (জিডিপি) এ খাতের অবদান ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ করে দেশের অভ্যন্তরে আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি মৎস্য ও চিংড়ি আহরণ করে গভীর সমুদ্রে ট্রলারেই প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। আর এসব প্রক্রিয়াজাত মৎস্য রফতানি করা হচ্ছে বিদেশে। এর ফলে এ খাত দেশে আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছে। গত অর্থ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার মৎস্য ও চিংড়ি রফতানি হয়েছে। তবে অতিরিক্ত আহরণ, আবহাওয়ার বৈরী আচরণের ফলে সমুদ্রে আগের মতো মাছ মিলছে না। এ ছাড়া খরচ বৃদ্ধির ফলে অনেকে লোকসানের ভয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছে না।
সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের মজুত নিরূপণ, এ খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং গভীর সমুদ্রে মাছের টেকসই আহরণের মাধ্যমে সমুদ্র অর্থনীতির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। এই লক্ষ্যে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উপকূলীয় জলাশয়ে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও সিউইড চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এ বিষয়ে কাজ করছে।
‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ প্রকল্পের আওতায় সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সর্বোত্তম আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ৩৮টি সার্ভে পরিচালনা করা হয়েছে। আরভি ‘মীন সন্ধানী’ নামক মৎস্য গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে চালানো অনুসন্ধানে ৪৫৭ প্রজাতির মৎস্য ও মৎস্যজাতীয় প্রাণী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়াও সমুদ্রে টুনা ও পেলাজিক মৎস্য আহরণের জন্য আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের আওতায় প্রতি বছরের ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন সামুদ্রিক জলসীমায় সব ধরনের নৌযান দিয়ে মৎস্য আহরণ বন্ধ হচ্ছে। ফলে বঙ্গোপসাগরে বিলুপ্তপ্রায় মাছের মজুত বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছে। সরকার গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন ৬ দশমিক ৮১ লাখ মেট্রিক টনে উন্নিত হয়েছে, যা ২০১০-১১ অর্থবছরে মোট উৎপাদনের (৫ দশমিক ৪৬ লাখ মেট্রিক টন) চেয়ে ২৪ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।

উপসংহার

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের বেশিরভাগ মানুষই অপুষ্টিতে ভোগে। বিশেষত গ্রামীণ ও শহরের দরিদ্র শিশু ও মহিলারা দারিদ্র্যতার দরুণ যথেষ্ঠ পুষ্টিকর খাবার পায় না। বিবিএস (২০০৯)-এর তথ্যমতে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে রয়েছে। তবে গত এক দশকে অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের দারিদ্র্যের হার ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে এবং নিম্নতর দারিদ্র্যসীমা বা চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাসকারী লোকেরা— ২০১৮ সালে দারিদ্র্যের হার ১১.৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
মানবদেহের পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য আমিষ বা প্রোটিন অপরিহার্য। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিন গড়ে প্রোটিন গ্রহণের পরিমান ৬২.৫২ গ্রাম (পরিসংখ্যান বুলেটিন, ২০০৮)। মৎস্য অধিদপ্তর (২০০৯)-এর তথ্যানুসারে প্রাণিজ আমিষের মধ্যে কেবলমাত্র মাছ থেকেই আসে ৫৮ শতাংশ। বর্তমানে আমাদের দেশে বছরে মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমান মাত্র ১৭.২৩ কেজি অথচ গ্রহণ করা প্রয়োজন ১৮ কেজি (মৎস্য অধিদপ্তর, ২০০৯)। অর্থাৎ মাছ গ্রহণের পরিমাণ আমাদের সামগ্রিক পুষ্টির তুলনায় অপ্রতুল। যদিও প্রাণিজ আমিষের মধ্যে মাছের আমিষ সবচেয়ে সস্তা ও সহজলভ্য।
এছাড়াও ছোট মাছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন-এ আছে। ভিটামিন-এ এর অভাবে রাতকানা রোগ হয়ে থাকে। একজন মানুষের প্রতিদিনের ভিটামিনের চাহিদা মেটাতে কয়েকটি ছোট মাছই যথেষ্ঠ। আবার মাছের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান হচ্ছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও লৌহ। ক্যালসিয়াম মানুষের হাড় ও দাঁতের উপাদান গঠন করে এবং ভিটামিন বিশোষণ ও রক্তে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুদের রিকেট ও বড়দের অষ্টিও রোগ হয়ে থাকে। ফসফরাস হাড়, পেশী ও রক্ত গঠনে সক্রিয় অংশ নেয়। লৌহ মানবদেহের লোহিত কনিকায় হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। বিজ্ঞানীদের মতে যারা বেশী মাছ খায় তাদের স্মরণশক্তি ও বোঝার ক্ষমতা প্রখর হয়। তার কারণ হিসেবে বলা হযে থাকে যে, মাছে বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছে মেধা বৃদ্ধিকারক ডি.এইচ.এ (Docosahexaenoic acid) নামক এক ধরনের ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড রয়েছে যা মাছের তেলে যথেষ্ঠ পরিমাণে থাকলেও অন্যান্য আমিষ জাতীয় খাদ্যে খুব একটা পাওয়া যায় না। মাছের তেলে ওমেগা থ্রি এম নামে এক ধরনের অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড আছে যা রক্তের অণুচক্রিকাকে জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। ফলে রক্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা কমে যায়। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছের তেল রক্তে কোলেস্টেরল কমায়, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়া মাছের কোলেষ্টেরলও মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকারক নয়। তাই বলা যায় যে প্রাণিজ আমিষের মূল যোগানদাতা মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে শরীরের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে শরীর সুস্থ থাকার সম্ভাবনাও বাড়বে। আর বলা হয়ে থাকে সুস্থ দেহে সুস্থ মন। তাই সুস্থ জাতি গঠনের মাধ্যমে উন্নতির শিখরে পৌঁছায় মাছের ভূমিকা অগ্রগণ্য।


অনলাইন অবলম্বনে দিব্যেন্দু দ্বীপ