Headlines

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস: ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

হে মার্কেট মার্টায়ারস্ মেমরিয়াল

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যেটি মূলত মে দিবস নামে পরিচিত। প্রতি বছর পয়লা মে তারিখে বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় দিনটি। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন। এছাড়াও অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়। উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে না। কানাডায় সেপ্টেম্বর মাসে পালন করা হয় শ্রমিক দিবস। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী জন স্পারও ডেভিড থমসন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার কানাডার সরকারি শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। যুক্তরাষ্ট্রেও একই দিনে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়কার কথা। শ্রমিকরা তখন দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও তার বিনিময়ে সামান্য মজুরিও পেত না। শিল্প মালিকরাই অধিক লাভ ভোগ করতো। উল্টোদিকে শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করতো। রোগ, ব্যধি, ক্ষুধা-দারিদ্র্য ছিলো শ্রমিকদের জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। উপরন্তু ছিল মালিকপক্ষের নির্যাতন। কখনো কখনো তা পৌঁছাতো ক্রীতদাসতুল্য পর্যায়ে! ১৮৬০ সালে শ্রমিকরা তাদের মজুরি না কমিয়ে সারা দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের জন্য দাবি জানান। এ জন্য তাঁরা একটি সংগঠনও তৈরি করেন পরবর্তীকালে, যার নাম হয় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার। এই সংগঠন শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অবিরত আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের স্লোগান ছিল—

“Eight hours for work, eight hours for rest, eight hours for what we will.”

দীর্ঘ বঞ্চনা, মলিক পক্ষের নির্যাতন আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের ১ মে রক্ত ঝরিয়ে ছিলো শ্রমিকরা। মূলত মে মাসের ৪ তারিখে পুলিশের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িত হয়েছিলো শ্রমিক সমাজ। পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় মিছিল থেকে তাদের উপর বোমা ছোড়া হয়েছে। ১ মে থেকে শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলো। শ্রমিক সমাবেশকে ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভ সমুদ্রে। এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে অন্তত ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। উপরন্তু সঠিক কোনো তথ্য প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ৮ জন শ্রমিককে দোষী সাব্যস্ত করে (পুলিশের উপর বোমা ছোড়ার অভিযোগে) ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। 

এরপরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ‘মে দিবস’ হিসাবে পালন করতে শুরু করে।

১৮০০ সালের দিকে আমেরিকায় শ্রমিকদের জীবনমান পরিস্থিতি

মূলত ১৮৮০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের দ্বারা ঘন ঘন হরতাল ধর্মঘট পালিত হতে থাকে, এই সময়ে শ্রমিকদের জীবনমান ছিলো অত্যন্ত শোচনীয়, শ্রমের মজুরী ছিলো খুবই কম, কর্মঘণ্টা বাধাধরা ছিলো না। এর আগে থেকে শ্রমিকরা মাঝে মাঝে সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করলেও প্রকৃতপক্ষে ১৮৮০ সালের দিকেই আন্দোলন আদর্শিক এবং রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হতে শুরু করে। আন্দোলনে সোস্যালিস্ট এবং কম্যুনিস্ট ভাবধারা যুক্ত হয়। যদিও মালিক শ্রেণি তথা শাসক শ্রেণি এদেরকে এনার্কিস্ট বা অরাজগতা সৃষ্টিকারী হিসেবে অভিহিত করতো। 

হে-মার্কেট ট্রাজেডি

১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, এবং তাদের এ দাবী কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেন ১৮৮৬ সালের পহেলা মে পর্যন্ত। বারবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হলেও একটুও সাড়া মেলে না তাদের কাছে। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এ বিষয়ে এক আলোড়ন তোলা আর্টিকেল। এরপর বিদ্রোহ ওঠে চরমে। আর শিকাগো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-বিদ্রোহের মূল মঞ্চ।

পহেলা মে যতই এগিয়ে আসছিল, দুই পক্ষের সংঘর্ষ অবধারিত হয়ে উঠছিল। মালিক-বণিক শ্রেণি ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। পুলিশ আগেই শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল। আবারও চলল তেমনই প্রস্তুতি। শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে পুলিশকে বিশেষ অস্ত্র কিনে দেন ব্যবসায়ীরা। পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে নেমে আসেন রাস্তায়। আন্দোলন চরমে ওঠে।

৪ মে, ১৮৮৬ সাল। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চারিদিকে হালকা বৃষ্টির সাথে হিমেল হাওয়া বইছে। এরই মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। তারা ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে এটি করেছিলেন।

অগাস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, এতে মেথিয়াস জে. ডিগান নামের একজন পুলিশ তৎক্ষণাৎ এবং আরও ছয়জন পরবর্তীতে নিহত হয়। পুলিশবাহিনী শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে, যা রায়ট বা দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।

মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি

পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে অগাস্ট স্পীজ-সহ মোট আটজনকে  প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ‘অস্কার নীবে’-কে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফাঁসি দেওয়ার আগেই কারারুদ্ধ অবস্থায় ‘লুইস লিং’ নামের একজন আত্মহত্যা করেন। বাকি ছয়জনকে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তারিখে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেওয়া হয়।

ফাঁসিতে ঝুলার আগ মুহূর্তে অগাস্ট স্পীজ বলেছিলেন, “The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today.”

তখন অ্যাডল্ফ ফিশার বলেছিলেন,  “This is the happiest moment of my life.”

এবং আলবার্ট পারসন্স বলেছিলেন, “Let the voices of people be heard…”  তিনি এই বাক্যটি শেষ করার আগেই ফাঁসিতে মৃত্যু হয় তার।

এই মিথ্যা বিচারের অপরাধ শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। ২৬ জুন ১৮৯৩ ইলিনয়ের গভর্নর জন পিটার অল্টগেল্ড-এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিথ্যে ছিল ওই বিচার। পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।

শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। সেই থেকে ১ মে পালিত হয় শ্রমিকদের আত্মদান আর দাবি আদায়ের দিন হিসেবে।

হে-মার্কেট স্মৃতিস্তম্ভ এবং হেমার্কেট মার্টায়ারস্ মনুমেন্ট

প্রথমে কিন্তু নিহত শ্রমিকদের স্মরণের স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি। ১৮৮৯ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয় বোমার আঘাতে সেদিন নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে। পুলিশের গুলিতে নিহত এবং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিকদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয় ১৮৯৩ সালে। হে মার্কেট চত্বরে যে স্মৃতিসৌধটি আছে (ছিলো) সেটি মূলত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত হয়। ডেনিশ ভাস্কর্য শিল্পী জোহানেজ গেলার্টের করা ব্রোঞ্জ নির্মিত নয় ফুট উচ্চতার এ স্মৃতিস্তম্ভটি ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত হে মার্কেট চত্বরে ছিলো, ১৯৬৯ সালে বোমার আঘাতে এটি গুড়িয়ে দেওয়া হলে এই ভাস্কর্যটির একটি রেপ্লিকা স্থান পায় চিকাগো পুলিশ হেড কোয়ার্টারে। 

Workers finish installing Gelert’s statue of a Chicago policeman in Haymarket Square, 1889. The statue was destroyed by a bomb in 1969 and a replica now stands at the Chicago Police Headquarters.

শ্রমিকদের স্মরণে নির্মিত সৌধটি (হেমার্কেট মার্টায়ারস্ মনুমেন্ট) স্থাপিত হয় চিকাগোর অদূরে ইলিনয়ের ফরেস্ট পার্কে। ১৯৯৭  সালে এই স্মৃতিস্তম্ভটিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। গ্রানাইটের তৈরি ১৬ ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভের সামনের দৃশ্যে দেখা যায় একজন নিপীড়িত শ্রমিককে ধরে রেখেছে ন্যায় বিচারের প্রতিনিধিত্বকারী একজন নারী। এর পাদদেশে লেখা রয়েছে অগাস্ট স্পীজের সেই সর্বশেষ উক্তিটি—

হে মার্কেট মার্টায়ারস্ মেমরিয়াল

“THE DAY WILL COME WHEN OUR SILENCE WILL BE MORE POWERFUL THAN THE VOICES YOU ARE THROTTLING TODAY”

“সেই দিনটি আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা আজ আপনাদের জিঘাংসার চেয়ে আরও শক্তিশালী হবে”

স্তম্ভটির পিছনের দৃশ্যে রয়েছে গভর্নর অল্টগেল্ডের একটি ব্রোঞ্জের ফলক যা তার ন্যায়বিচারের প্রতীক।

হে-মার্কেট ট্রাজেডির প্রতিক্রিয়া

হে মার্কেট ট্রাজেডির পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মানুষের সঙ্গবদ্ধতাকে ঘৃণার চোখে দেখা হতে থাকে। যদিও সমাজতান্ত্রিকরা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি করতে থাকে যে আট জন শ্রমিককে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তবে সে দাবির প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে খুব একটা সমীহ আদায় করা সম্ভব হয়নি।

১৯৮৬ সালে শ্রমিকদের মিছিল-আন্দোলন থেকে যে আটজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো এর মধ্যে সাতজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিলো, একজনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো ১৫ বছর। সেদিনের জুরি যোশেপ ই গ্যারি এই সাজা দিয়েছিলেন। ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর ৪ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়, বাকী ৩ জনের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেন, অবশিষ্ট ২ জনের সাজা কমিয়ে যাবৎজীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন ইলিনয়ের গভর্নর রিচার্ড জে অগলেসবি। মূলত যুক্তরাষ্ট্র তথা ‍পৃথিবীজুড়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতেই এই সাজা কমানো হয়েছিলো।

হে মার্কেটে চত্বরে শ্রমিকদের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সহিংসতা এবং প্রহসনেরর বিচারের পরে জনগণের মতামত  দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। কিছু মানুষের মনে শ্রমিক বিদ্বেষ আরো বৃদ্ধি পায়, একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং পৃথিবীব্যাপি শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণে জনমত তৈরি হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে পুলিশের গুলিতে এবং বিচারের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিকরা শহীদের মর্যাদায় ভূষিত হয়। 

বিশ্বব্যাপী মে দিবস

১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী বছর থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’। বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের প্রায় আশি-টিরও বেশি দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন। এছাড়া বেশ কিছু দেশে বেসরকারিভাবে পালিত হয়। কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্র দিনটিকে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করে না।