Headlines

নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা

শাহরিয়ার কবির

শাহরিয়ার কবির

প্রানতোষ তালুকদার, ঢাকা সংবাদদাতা

রাজধানী ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিযাত্রা ও নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় মন্ত্রী জনাব মুস্তফা জব্বার (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার)। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত শত্রুরা, ‘৭১-এর গণহত্যাকারীরা, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরা যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে হামলা করতে না পারে সেজন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি একটি তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল গঠন করেছে।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মহাজোট সরকারের যে সব সাফল্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা অর্জন করেছে সে সবের ভেতর তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মানুষের কল্যাণের জন্য বিজ্ঞানের অনেক অবদানকে মানবতার শত্রুরা তাদের হীন স্বার্থে যেভাবে ব্যবহার করেছে—তথ্য প্রযুক্তিও এর ব্যতিক্রম নয়। গত এক দশকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমাজ ও সভ্যতা যতটা এগিয়েছে সাইবার অপরাধীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধের মাত্রার পরিধিও বাড়িয়েছে।

ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাস ও হত্যাকে বৈধতা প্রদান করেছে তারা তথ্যপ্রযুক্তিরও সহযোগিতা নিয়েছে তাদের অপরাধ চক্রের শক্তি বৃদ্ধির জন্য। আল কায়দা ও আইএস-এর বিশ্বব্যাপী জিহাদী বলয় সম্প্রসারণের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। সম্প্রতি সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন আসাদ সরকারকে উৎখাতের জন্য তাদের তথাকথিত জিহাদের লোকবল সংগৃহীত হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

আইএস-এর আহ্বানে সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার তরুণ, এমনকি তরুণীও সিরিয়ায় গিয়েছে, আইএস ও আলকায়দার তথাকথিত জিহাদে অংশ নিয়েছে।

বাংলাদেশে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তারাঁর নৃশংস হত্যাকান্ডের জন্য যারা দায়ী, যারা মুক্তচিন্তার তরুণ লেখক ও ব্লগারদের হত্যা করেছে, তারা এসব নৃশংস অপরাধ সংঘটন উদ্বুদ্ধ হয়েছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। একইভাবে ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রামু থেকে নাসিরনগরে যে সব সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেখানেও দুর্বৃত্তরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছে।

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চিহ্নিত শত্রুরা, ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় অর্জনের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক অপপ্রচার আরম্ভ করেছে, যার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়।

তথ্যপ্রযুক্তি সন্ত্রাস দমনের জন্য সম্প্রতি সরকার ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করেছে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ রোধের জন্য এ ধরনের আইন প্রয়োজন ছিল। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে তিন বছর আগে ইউরোপের ‘হলোকস্ট ডিনায়াল এ্যাক্ট’ এর আদলে ‘৭১-এর গণহত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকারকারীদের শাস্তির জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়নের দাবি জানিয়েছিলেন। নতুন আইন অন্ততপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ দমনে সহায়ক হবে। তবে এই আইনের মাধ্যমে ঢালাওভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার উর্ধ্বে রাখা হয়েছে, যা সমর্থনযোগ্য নয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি একটানা দশ বছর ক্ষমতায় থাকলেও এখনও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির অবস্থান অটুট রয়েছে। ’৭১ এর গণহত্যাকারীদের দল উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক জামায়াতে ইসলামীকে এখনও সংগঠনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়নি। জামায়াতের সমালোচনাকে এই দলের লোকজন সব সময় বলেছে ‘ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ’। একই ধুয়ো তুলে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ঘাতকরা ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে ইসলামের দোহাই দিয়েই হত্যা করেছিল কিংবা হত্যাকাণ্ডে হযোগিতা করেছিল।

নারী ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধ ইসলামের নামে জায়েজ করা হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয়েছিল ‘কাফের’, ‘দুষ্কৃতকারী’ ‘ইসলামের দুষমন’। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট ওলামারা বিভিন্ন সময় মওদুদির মতবাদ এবং জামায়াতে ইসলামীকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা করে ফতোয়া দিয়েছেন। অথচ জামায়াত এখনও ’৭১ এর ভাষায় বলছে যারা তাদের সমালোচনা করে তারা ‘নাস্তিক’ ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ ইত্যাদি।

ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে ‘ধর্মদ্রোহিতা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন হবে বলে বক্তাগণ মনে করেন। উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাসী হেফাজতে ইসলাম ২০১৩-১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারকে ‘নাস্তিক মুরতাদ কাফেরদের সরকার’ বলেছে। অথচ ক্ষমতার সামান্য হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়ে তারা এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনেক জামায়াতি-হেফাজতি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকায় ওঠার জন্য দৌঁড়-ঝাঁপ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত এদের অনেক বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের সংবিধানবিরোধী।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা মুক্তিচিন্তা নিয়ন্ত্রণ চায় না, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, তথা মুক্তচিন্তার বিরোধীদের দমনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হোক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশী মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বহুমাত্রিক তৎপরতা মোকাবেলার জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ৩-৪ আগস্ট, ২০১৮ ঢাকায় অনুষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলনে অপেক্ষাকৃত তরুণ তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ব্লগারদের সমন্বয়ে নির্মূল কমিটির ‘তথ্যপ্রযুক্তি সেল’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, যাদের উদ্যোগে এবং অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২০ অক্টোবর সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে। এই সেমিনার উপলক্ষে নির্মূল কমিটির তরুণ নেতৃবৃন্দ এবং তাহাদের সমমনা ও শুভানুধ্যায়ীদের লেখা বর্তমান সংকলনে স্থান পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে তাহারা যেভাবে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছেনÑতাহারা চান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক তরুণ প্রজন্ম একইভাবে ‘৭১-এ পরাজিত মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে চলমান সাইবার যুদ্ধে পরাজিত করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দীপ্ত তারুণ্যের জয় হওয়ার কথা বলেছেন।
বিশেষ করে তারুণ্যের জানা আর জানানোর জগত হয়ে উঠেছে সাইবার বিশ^। সঙ্গত কারণেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও তথ্য প্রযুক্তি যোগাযোগ সেল কার্যকরী করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। একটি নীতিমালা এই সেলের কার্যক্রমকে গাইড করবে।
এই সেল এবং নীতিমালার লক্ষ্য হবে, তথ্য প্রযুক্তি যোগাযোগ মাধ্যমে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আদর্শিক সকল বিষয়ে সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করা। মূল্য উদ্দেশ্য হবে–
ক. তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সৃজনশীল ও রুচিশীলভাবে তারুণ্যের ভাষায় দেশে ও প্রবাসে নবতর প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও চেতনায় আলোকিত করা। খ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পাল্টা জবাব ও ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা। গ. দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা এবং ঘ. একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভার্চুয়াল আরকাইভ গঠন ও তহবিল সংগ্রহ এই মাধ্যমকে কাজে লাগানো।
আলোচকবৃন্দ বলেছেন কাজটি সহজ নয়, তবে জরুরী এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেজন্য যে কর্মকৌশল অবলম্বন করা দরকার হবে তা হলোÑ
১. বাংলা ও ইংরেজীতে ওয়েবপেজ, ওয়েব পোর্টাল, ফেসবুক, ব্লগ, ইউটিউব পৃষ্ঠা, নেট টিভি, অ্যাপ, টুইটার, ইমেইল গ্রুপ, ই-নিউজলেটার, হেল্প লাইন পরিচালনা করা। ২. নীতিনির্ধারণ ও পর্যালোচনা, লেখা, ওয়েব কন্টেন্ট তৈরি, তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও মনিটরিং-এর জন্য পৃথক পৃথক কমিটি গঠন অথবা একজন দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ফোকাল পয়েন্ট) নির্ধারণ। ৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কিত সমসাময়িক প্রসঙ্গে নিয়মিত আপডেট রাখার ব্যবস্থা করা।
আলোচকবৃন্দ বলেছেন তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল গঠনের পিছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর সকল ধরণের যোগাযোগ মাধ্যম আজ ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিকতায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িকতা রোধ করতে, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ও মূলনীতি রক্ষা করতে ইলেট্রনিক গণমাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ঠিক তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নানাবিধ তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমও হয়ে উঠেছে ব্যক্তি বা সমষ্টির মতপ্রকাশ ও অধিকার রক্ষার মাধ্যম। বিশেষ করে তারুণ্যের জানা আর জানানোর জগত হয়ে উঠেছে সাইবার বিশ^। সঙ্গত কারণেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও তথ্য প্রযুক্তি যোগাযোগ সেল কার্যকরী করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। এই সেলের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোÑ
(ক) তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সৃজনশীল ও রুচিশীলভাবে তারুণ্যের ভাষায় দেশের ও প্রবাসে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও চেতনায় আলোকিত করা। (খ) মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পাল্টা জবাব ও ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা। (গ) দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা। (ঘ) একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভার্চুয়াল আর্কাইভ গঠন ও তহবিল সংগ্রহে এই মাধ্যমকে কাজে লাগানো এবং (ঙ) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপপ্রচার বা অন্য কোনো কারণে দেশের কোথাও হামলার ঘটনা ঘটলে এই সেলের মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করে তৎক্ষণিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।
সরকার সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করছে, অন্যদিকে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তা সেল তৈরি করেছে। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাতের ঘটনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ঘটনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সে ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে এসব হামলার ঘটনা ঘটছে তিনি আসলে সে ঘটনার সাথে জড়িত নয়। এইসব ঘটনা ঘটনার সাথে সাথে যাতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদান করা যায় এবং জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা যায় সেই উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল গঠন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইন পাস এবং নির্মূল কমিটির তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল গঠনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা
২০১৪ সালে ৫ই জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যশোহরের ঋষিপাড়া, হাজরাইল, হরিদাসকাঠি, মনিরামপুর যেন এক অজানা আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছিলো। হাজরাইলের ঋষিপাড়ায় স্বামী ও শ^শুর কে বেঁধে রেখে নির্যাতন চালানো হয় গৃহবধূর উপর। শ^াশুড়ি ধর্মের বাপ ডেকেও বাঁচাতে পারেননি ছেলে বউকে। অপরদিকে বাবা-ছেলেকে বেঁধে রেখে তাদের চোখের সামনেই শ^াশুড়ী ও বউয়ের উপর চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। শুধু যশোহর নয় ঠাকুরগাঁও’র গারোয়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের ঝাকুয়াপাড়া বাজারে ভেঙ্গে দেওয়া হয় পঞ্চানের খাবারের হোটেল। অপরদিকে গাইবান্ধার কূপাতলা ইউনিয়নে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় জীবন দিতে হয়েছে খোকারামকে। ভোটের আগের দিন স্থানীয় বিএনপি’র লোকজন এসে ঘোষণা দেন ‘হিন্দুপাড়া এক ঘন্টার মধ্যে পুড়িয়ে দেব, সব শালাকে উচ্ছেদ করব’। এ কথার প্রতিবাদ করায় খোকারামের পরিবারের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। খোকারামকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। একইভাবে দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, চারঘাট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও পিরোজুরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সংখ্যালঘুদের অপরাধ ছিলÑতারা জামায়াত-বিএনপির হুমকি উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিল।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনে চিত্র তুলে ধরা এবং তাদের সাহায্য প্রদানের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রেরণ করে। সেই সময়ে যশোহরের অভয় নগরের পর সবচেয়ে ভয়াবহ লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে। দিনাজপুর সদর উপজেলার ১নং চেহেলগাজী ইউনিয়নের একটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রাম কর্ণাই। কর্ণাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গণনার পরপরই নির্বাচনবিরোধীরা ওই গ্রামের বৈদ্যনাথপাড়া, স্কুলপাড়া, তেলিপাড়া, হাজিপাড়া ও প্রিতমপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর আক্রমণ করে। লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ৫টি পাড়ায় বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সাড়ে ৩ ঘণ্টা তা-বলীলা চালায় তারা। হিন্দুদের সাতটি বাড়ি ও ৩২টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয়। নির্র্মূল কমিটির প্রতিনিধি দলের সাথে কর্ণাই গ্রামের নির্যাতিক মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তাদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। হামলায় যারা অংশ নিয়েছিলো তাদের অধিকাংশ আশে পাশের গ্রাম থেকে এসে হামলা চালায় যারা দিনাজপুরের স্থানীয় লোক ছিলো না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে হামলা
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এর ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে করা হামলাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না। দাঙ্গার জন্য দুটি পক্ষ লাগে, আরও বড় এলাকাজুড়ে সহিংসতা ঘটানো হয়। দুটি সম্প্রদায়ের বিরাট সংখ্যক মানুষকে অল্প সময়ের জন্য হলেও দাঙ্গাবাজদের সমর্থন করতে দেখা যায়। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নামে করা হামলাকারীদের প্রতি সংখ্যাগুরু সমাজেরই সমর্থন নেই। দ্বিতীয়ত, ঘটনাগুলো একটি-দুটি গ্রাম বা পাড়ার মাধ্যমেই সীমিত। তৃতীয়ত, দুটি সম্প্রদায়ের দুটি পক্ষের বদলে (রামু, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বা পাবনার সাঁথিয়ায়) দেখা যাচ্ছে, কয়েক শ দুষ্কৃতকারী বনাম অসহায় কয়েকটি ধর্মীয় সংখ্যালুঘু পরিবার। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গোষ্ঠীগত হামলার আরেকটি চরিত্র খুব নজর কাড়ে। প্রায় সব ঘটনাতেই হামলাকারীরা আসছে বাইরে থেকে। রামু-সাঁথিয়া-নাসিরনগর সবখানে একই চিত্র। এই বহিরাগতরা হয় ভাড়াটে, নয়তো মিথ্যা গুজবে বিশ^াস করা উন্মাদ। যাদের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য তাদের আনা হয়েছে, তাদের তারা চেনে না, তাদের সম্পর্খে কিছু জানেও না।

মানুষের মন মানুষের ধর্মশালা। সাধারণ মানুষ সম্পর্কে এই কথাটা শতাংমে সত্য। মানুষ যখন তার ধর্মের প্রবর্তক সম্পর্কে অথবা তার ধর্ম সম্পর্কে কারও মুখে কটুক্তি শোনে তখন তার ধর্মশালায় আঘাত লাগে। আর তখনই সে দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধমন্দির পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা, ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামের ঘটনা এবং অতিসাম্প্রতিক সময়ে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার কালিপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আশিষ বিজয় দেব তার ফেসবুকে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটুক্তি করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এমন মিথ্যা রটনা তার বাড়িতে হামলার পরিকল্পনা সবই এর দৃশ্যমান প্রকাশ। কমলগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হকের তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের ফলে আশিষ বিজয় দেবের বিষয়টি খুব বেশি দূর এগোয়নি।

সব স্থানেই এই প্রতিক্রিয়া তৈরি ও হামলা করার পেছনে কলকাঠি নাড়ার মানুষগুলো ছিল একটি গোষ্ঠী। প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, যাদের নামে ফেসবুকের স্ট্যাটাস নিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো হয়েছে, প্রার্থনার স্থান পোড়ানো হয়েছে, সম্পদ লুট হয়েছেÑতারা কেউ স্ট্যাটাস দেয়নি। কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে ট্যাগ করা হয়েছে, কারও ভূয়া অ্যাকাউন্ট বানিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়েছে বা অন্যের পোস্ট শেয়ার করা হয়েছে। তারপরও মানুষ সতর্ক হচ্ছে না। ভাবতে পারছে না, একজনের অ্যাকাউন্ট থেকে অন্যজনেও এইসব করতে পারে। এর পেছনে রয়েছে মৌলবাদীদের সংঘবদ্ধ চক্র। এইসব হামলা প্রতিরোধের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আলোচকবৃন্দ।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আলোচকবৃন্দ বলেন ২০১৮ সালের অনুষ্ঠিতব্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচনে জয় লাভের জন্য মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছে। যদি বুঝতে পারে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না তবে নির্বাচন বানচালের জন্য তারা যে কোন অসাংবিধানিক পথ অবলম্বন করতে পারে। তাদের সে পথ ২০০১ বা ২০১৪ সালের চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটাতে পারে। তাদের সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে জয়ী করার জন্য সকলকে কাজ করার জন্য বলেছেন। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস মোকাবেলার জন্য জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রতিরোধ কমিটি গঠনের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যে আহ্বান জানিয়েছে তা সফল করার জন্য বলেছেন। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার উৎসবে পরিণত করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তির বিজয় নিশ্চিত করার জন্য বলেছেন বক্তারা।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ১টি আইন সহায়তা কেন্দ্র, চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র, তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল গঠন করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে যদি বাংলাদেশের কোন স্থানে সংহিসতা ঘটে তাহার জন্য এই ব্যবস্থা।

রাজধানী ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিযাত্রা ও নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেনÑপ্রধান অতিথি: মাননীয় মন্ত্রী জনাব মুস্তফা জব্বার (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার), শহীদ সন্তান আফিস মুনীর তন্ময়, জনাব মোহাম্মদ আরাফাত, শহীদ সন্তান ডাঃ নুজহাত চৌধুরী, জনাব সুফি ফারুক, জনাব কবীর চৌধুরী তন্ময়, লেখক মারুফ রুসুল এবং সভাপতিত্ব করেন লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির প্রমুখ।