ডাক্তারি পড়তে চাইনি, চান্স পাবো ভাবিওনি, এমনকি প্রথমবর্ষে ডাক্তারি ছেড়ে চলে আসার প্ল্যানও করে ফেলেছিলাম, হোম সিকনেসের জন্য।
কিন্তু পড়া শেষ করার পর কি বুঝলাম জানেন, যা পড়ে এসেছি, যা দেখেছি তা যদি সব মানুষেরা জানত, তাহলে সমাজ টা অন্যরকম হত।
পেটে গুলি খাওয়া মানুষটার নাড়িভুড়ির মধ্যে থেকে যখন গামলা গামলা মল বের করতে হত সার্জারির সময় , তখন আর হাগু শব্দটা খারাপ লাগত না। যখন বাচ্চা ডেলিভারী বা সিজারের সময় ছিটে এসে লাগত গর্ভস্রাব, তখন আর পোয়াতী মেয়েদের অশুদ্ধ ভাবতেন না। যদি জানতেন মাসিকের কেন হয় , তাহলে মেয়েদের মাসিকের সময় পূজা , প্রার্থনা করতে কাউকে মানা করতেন না।
লজ্জা পেতেন না , নিজের শরীর নিয়ে। মেয়েদের শরীর নিয়ে এত বেশি উশখুশ খানাঘুষা, এত অকারণ অনুভূতি থাকত না । ছেলে মেয়ে নিয়ে এত ভেদাভেদের চিন্তা, বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের সাথে আচরণে আর কথা বলায় এত সংকোচ, ভয় , অতি আগ্রহ বা এত রোমান্টিসিজম থাকত না। নগ্নতা নিয়ে এত ঘেন্না , লজ্জা থাকত না।
প্রতিদিন নগ্ন মানব শরীর দেখে,কাটা হার্ট, মস্তিষ্ক, পুরুষাঙ্গ , স্তন হাতে নিয়ে দেখে, মানুষের হাড় পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে , কোষ থেকে শুরু করে অঙ্গের গঠন, রক্তচাপ থেকে শুরু করে যৌন অনুভুতির , কারন পড়তেন যখন, তখন বুঝতেন কি অসাধারণ সৃষ্টি এই মানব শরীর । কত জ্ঞানের আধার। কোনো লজ্জা নাই এই মানুষের শরীরে।
বুঝতেন পুরুষ আর নারীর পার্থক্য কত কম। বুঝতেন যে না মানুষের না্না রকম শরীরের গড়ন হওয়াটাই স্বাভাবিক, আর তার কোনোটাই বেশি বা কম সুন্দর বলা যায় না। ছোটোবেলা থেকে অন্য মানুষের কথা শুনে আর ফিল্মের হিরো হিরোইনদের দেখে আমরা শুধু হাতে গোনা কয়েকটা ধরনকে সুন্দর বলতে শিখি।
যখন প্রস্রাব আটকে যাওয়া পুরুষ বা মহিলার ক্যাথেটার পরাতে হত, গ্লাভস পরে আঙ্গুল দিয়ে দেখতে হত পায়ুপথে, যখন বাচ্চা হওয়ার সময় যোনীতে আঙ্গুল দিয়ে দেখতেন বাচ্চা কতদূর নেমেছে, যখন অপারেশন থিয়েটারে আপনার উপর জীবনের দায়িত্ব দিয়ে অসহায় মানুষ গুলো নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকত, তখন বোধোদয় হত, বিপদে পড়লে মানুষ এই সত্য টা বুঝতে পারে, যে তারা শুধুই মানুষ ,পুরুষ বা নারী না, যেটা তাদের আগেই বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে আলাদা প্রজাতির জীব ভেবে “চিন্তা আর আচরণের” সংকোচ থাকত না তখন। মানুষের জন্য ভালো কিছু করতে বা মানুষকে ভালোবাসতে পুরুষ বা নারী পার্থক্য করতেন না কখনো আর।
হিংসা করতেন না সমলিঙ্গের কাউকে।
বাচ্চার আকৃতির দশ ভাগের একভাগ ব্যাসের পথ দিয়ে কি কষ্টে নারী স্নতান কে জন্ম দেয় তা যদি দেখতেন, মানুষের জন্ম কিভাবে হয় যদি দেখতেন, তাহলে পৃথিবীর কোনো কিছুই আর ভয় পেতেন না। আর কোনোদিন নারীদেল দূর্বল ভেবে হেয় করতেন না। কোনোদিন কাউকে “মাদার…চো…” বলে গালি দিতেন না।
যখন অসুস্থতা নিয়ে পড়তেন, তখন দেখতেন শারীরিক বা মানসিক সমস্যা পরস্পর কতটা জড়িত। জানতেন যে আমাদের খাদ্যাভ্যাস , মানসিক চাপ, বসবাসের পরিবেশ ,আবহাওয়া এমনকি পেশা পর্যন্ত শারীরিক আর মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে। জননাঙ্গ আর যৌনতা নিয়ে পড়লে জানতে পারতেন যে একাধিক মানুষের সাথে যথেচ্ছ এবং বিকৃত যৌনাচার কতগুলো অসুখ আর মানসিক সমস্যার কারন ।
যে যৌনতা না থাকলে সৃষ্টিতে প্রাণের ধারা আর বংশগতি বজায় রাখা সম্ভব হত না, প্রজাতির বৈচিত্র তাথা জিনের বৈচিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে বৈরি পরিবেশে উন্নত কোনো প্রানীর টিকে থাকা সম্ভব হত না, সেই যৌনতা নিয়ে বেশি সমাজের রাখঢাকের আর অজ্ঞানতার জন্য অতি উৎসাহ ,ভুল ধারনা, বিকৃত অনুভুতি, আর লজ্জা সৃষ্টি হত না। যৌন অপরাধও হত না এত।
বুঝতে পারতেন, ছোটোবেলা থেকে কত কি ভুল শিখে এসেছেন, ভুল ভেবে এসেছেন, ভুল করে এসেছেন।
তারপরেও হয়ত আমাকে বলবেন পাগল। সবাই ডাক্তার হয়ে গেলে বাকি কাজ করবে কারা? তোমার নিজেরই তো ভাত মারা যাবে। আর এত মানুষের ডাক্তারি পড়ার খরচ, বা সময়য়ের ব্যাবস্থা কীভাবে করা সম্ভব?
সবাইকে ডাক্তার হওয়ার কথা তো বলিনি। সবাই কে দিয়ে প্র্যাকটিস করানোর তো দরকার নেই। আর প্রাকটিস না করলে সব রোগের বিস্তারিত, রোগের ওষুধ , সার্জারি এ সব জানারও দরকার নেই।
যেটুকু দরকার ঠিক করে ধাপে ধাপে একটু একটু করে পড়ালেই হল ছোটবেলা থেকে, হেলথ এডুকেশন বা স্বাস্থ্য শিক্ষা হিসেবে।
দেখবেন মানুষের তখন অসুখই কম হবে, সামাজিক অপরাধও কমে যাবে। হাসপাতালের খরচও কমে যাবে।
একটা সুস্থ আর সুখী সমাজ পাবো আমরা কয়েক প্রজন্মের মধ্যে।
সক্রেটিস সেই কবেই বলে গিয়েছেন, “নো দাইসেলফ”। মানে, “নিজেকে জানো”।
নিজেকে না জেনে আর সবকিছু জানা বৃথা। বিশ্বাস করেন এটা আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছি।
আর নিজেকে জানা নিজের শরীর আর মনকে জানা দিয়েই শুরু হয়, আর পারিপার্শ্বিকের সাথে নিজের শরীর আর মনের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টার সাথে সাথে সে জানা বাড়ে।
এটা কি সম্ভব যে আমরা আজও সক্রেটিসের কথার গুরুত্ব বুঝতে পারনি?
না।
পৃথিবীর পড়ালেখা জানা শাসকেরা, রাজারা সবই বোঝেন, কিন্তু হয়ত ভয় পান, যে, তাদের প্রজা জনগন সব জেনে গেলে তাঁদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন উপর। এজন্য হয়ত শরীরতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব জানা থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে রেখেছে তাঁরা, যুগ যুগ ধরে। নিজেকে জানার সুযোগ শুধু স্বার্থপর অর্থলোভী বোকা ভালোছাত্রদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের জ্ঞান অর্জন করিয়ে তারপর অর্থের লোভ দেখিয়ে কামলার মতো খাটিয়ে নেওয়া যাবে, মানুষের রোগের চিকিৎসা করার জন্য। চিকিৎসা যে মানুষের মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত, সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হওয়া উচিত এটা ভুলিয়ে দিয়ে।
আর এখনকার যুগে নতুন করে যোগ হয়েছে শাসকদের কলকাঠি নাড়া মেগাব্যাবসায়ীদের চাপ । মানুষ নিজেকে জানতে শিখলে, শারীরিক আর মানসিকভাবে অসুস্থ না হলে, মারামারি কাটাকাটি না করলে ওষুধ আর হাসপাতালের ব্যবসা জমবে না, সিগারেট ড্রাগ, এলকোহল বিক্রি হবে না। হতাশাগ্রস্ত মানুষেরা পাগলের মতো ভোগদ্রব্য কিনে, বিনোদনের জন্য অসাস্থ্যকর খাবার খেয়ে নিজেদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করবে না।
এইসব ক্ষমতাধর নিয়ন্ত্রকদের কারো লাগবে টাকা, কারো লাগবে খ্যাতি, কারো শুধুই নিয়ন্ত্রণ, এ জন্য তারা বোকা করে রাখতে চায় জনগণকে। কোনো কন্সপিরেসি থিওরির গল্প বানাচ্ছি না আমি, আঙ্গুল দিয়ে জোরে চোখ খুলে দেখুন, ভালো করে চিন্তা করে দেখুন, বুঝবেন ঠিক কিনা।
যাহোক কিন্তু এই অতি চালাক নিয়ন্ত্রকেরা এত বোকা যে তারা এটাও বোঝেন না, মরে গেলে এসব খ্যাতি, নিয়ন্ত্রণ, টাকা কিছুই থাকে না।
মানুষের জন্য, বা পৃথিবীর জন্য যা করে যাবেন, ভালো বা খারাপ, শুধু সেটাই থাকে।
তাদেরই প্রথম উচিত, বেশি না, মাত্র দুই বছরের জন্য কোনো মেডিকেল কলেজে গিয়ে শারীরতত্ত্বের , মনসতত্ত্বের, জীবনতত্ত্বের জ্ঞান নিয়ে আসা।