Headlines

প্রশ্ন ফাঁস করতে করতে ডাক্তার, শত শত কোটি টাকার মালিক!

খুলনা

বলা হচ্ছে ডা. ইউনুস উজ্জামান খান তারিমের কথা। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং চিকিৎসার মতো মহান পেশাকে কারা কলঙ্কিত করেছে, তার একটি জলজ্ব্যান্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই ডাক্তার তারিমনামা। জাল জালিয়াতির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়া এই তারিম কিন্তু এখন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারি রেজিস্টারও! ভাবা যায়? খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারি রেজিস্টার হলেও কখনো তিনি নিয়মিত অফিস করেন না বলে জানা যায়। তার একটি ক্লিনিকও রয়েছে। তার প্রতিষ্ঠিত ফাতেমা ক্লিনিকে বসে রোগী দেখেন মেডিকেল এসোসিয়েশন খুলনার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মেহেদী নেওয়াজ। খুলনা শহরের রয়েল মোড়ের ফাতিমা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ১১ জন মালিকের একজন ডাঃ তারিম। প্রশ্ন ফাঁস এবং ডাঃ তারিমের গ্রেফতার বিষয়ে জানতে চাওয়া জন্য ডাঃ মেহেদী নেওয়াজকে ফোনে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজেরও তিনি এখন পর্যন্ত কোনো জবাব দেননি।

ফলোআপ নিউজ এ বিষয়ে কথা বলে খুলনা-বিএমএ-এর সভাপতি ডাঃ শেখ বাহারুল আলমের সাথে। ডাঃ বাহারুল আলম প্রশ্ন তোলেন— ডাঃ তারিমের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি অনেক পুরনো। তাকে পূর্বেও গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন ফাঁস করে থাকলে পুলিশ তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে না কেন? তার বিচার হচ্ছে না কেন? তিনি এটিকে ইঁদুর-বিড়াল খেলা হিসেবে অভিহীত করেন। একইসাথে তিনি বলেন যে, শুধু চিকিৎসকদের পক্ষে প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব নয়, এর সাথে কোনো না কোনো স্তর থেকে প্রশাসন জড়িত আছে। অতএব, সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করতে হবে। ডাঃ বাহার প্রশ্ন তোলেন— পুলিশ গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইনের তোয়াক্কা করছে না। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোনো সন্দেহভাজন অপরাধীকে আদালতে সোপর্দ করার কথা থাকলেও ডাঃ তারিমের সাথে আরো যে চারজন চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তা করছে না। এক্ষেত্রে পুলিশকে তিনি স্বেচ্ছাচারী বলে অভিহীত করেন। তিনজন নারী চিকিৎসককে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টিকে তিনি নৈতিকতার দৃষ্টিকোন থেকে কীভাবে দেখেন— এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিষয়টি ঘৃণ্য, তবে এ ধরনের অপরাধ রাষ্ট্রের অন্য সব বড় বড় অপরাধের মতোই। দেশের যে দীর্ঘদিনের দুবৃত্তায়ন সেটিরই অংশ। ডাঃ তারিমকে বিএমএ থেকে বহিষ্কার করা হবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বিএমএ কোনো সন্দেহভাজন অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। অপরাধ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নিবে। এ মুহূর্তে বিষয়ে পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো বিবৃতি দেবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে এ ডাক্তার নেতা বলেন, আজকে পুলিশ কমিশনারের সাথে কথা বলে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।  

তারিম চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) খুলনা জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। ডাঃ তারিম ষোলো বছর ধরে মেডিকেলে ভর্তি কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত।

সংবাদ সূত্রে জানা যায়— খুলনায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি কোচিং থ্রি ডক্টরসের উপদেষ্টা ডা. ইউনুস উজ্জামান খান তারিমকে ১৮ আগস্ট ২০২৩ ফের আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। উপদেষ্টা বলা হলেও বস্তুত এই কোচিং সেন্টারটি তারই প্রতিষ্ঠা করা, এবং এটির মাধ্যমেই তিনি জাল জালিয়াতি চক্রটি গড়ে তুলে বছরের পর বছর ধরে মেডিকেল ভর্তির প্রশ্ন ফাঁস করে আসছেন। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ২০১৯ সালেও তিনি আটক হয়েছিলেন। এ সময় দুইদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। সর্বসাধারণ থেকে প্রশ্ন উঠেছে— কেন গ্রেফতারের পরও তিনি ছাড়া পেয়ে যান এবং তার বিচার হয় না। এ যাত্রায় ডাঃ তারিমের সাথে খুলনা থেকে আরো যে তিনজন নারী চিকিৎসক আটক হয়েছেন তারা হলেন ডাঃ লুইস, ডাঃ তিশা ও ডাঃ শর্মিষ্ঠা। যেহেতু পুলিশ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতারের বিষয়টি জানায়নি তাই খুলনা-বিএমএ-এর সভাপতি ডাঃ বাহারুল আল এই চিকিৎসকরা নিখোঁজ রয়েছেন বলে দাবী করছেন।

এ সময় খুলনা জেলা প্রশাসন থেকে ডাঃ তারিমকে খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে বরখাস্তের সুপারিশ করাও হয়েছিলো। ১০ অক্টোবর ২০১৯ নিজ দপ্তরে বসে খুলনার তখনকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন ডাঃ তারিমকে খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে বহিষ্কার এবং তার কোচিং সেন্টারটি সিলগালা করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। জেলা প্রশাসক তখন জানিয়েছিলেন ডাঃ তারিমকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক মাসের সাজাও দেওয়া হয়েছিলো। প্রেস ব্রিফিং-এ ক্ষোভ প্রকাশ করে ব্রিফিংয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘মেডিকেল ভর্তির কারসাজির জন্য থ্রি ডক্টরস এর স্টুডেন্টদের কাছে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছেন ডাক্তার তারিম। এছাড়া ডাঃ তারিম অফিসের সময় ছুটি না নিয়েই কোচিং ব্যবসা পরিচালনা করে চলেছেন। 

উল্লেখ্য, ১০ অক্টোবর (২০১৯) জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ ইমরান হোসেন খান বেলা ১১ টার দিকে নগরীর ফুলমার্কেট এলাকায় অবস্থিত ডাঃ তারিমের মেডিকেল ভর্তির কোচিং সেন্টার থ্রী ডক্টরসে অভিযান পরিচালনা করেন। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে নিয়ে যান। এসময়ে কোচিং সেন্টারের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও কম্পিউটারের হার্ডডিক্সে জব্দ করা হয়।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থা এ বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে এক প্রতিবেদনে বলেছে, খুলনার এই কোচিং সেন্টার (থ্রি ডক্টারস্) ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে ‘মেধাহীন’, ‘অযোগ্য’ ছাত্রছাত্রীদের মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ করে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে জনপ্রতি ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা করে নিচ্ছে। এই ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে বছরে শত কোটি টাকার বেশি অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে কিছু শিক্ষার্থীর ফলাফল বিবরণীর বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়, যারা থ্রি ডক্টরসে কোচিং করেছেন। তাতে দেখা যায়, তারা কেউ এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পায়নি। তবে ভর্তি পরীক্ষায় ৭৩ করে নম্বর পেয়েছে। একজন ৭৩.২৫ নম্বর পেয়েছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি সিআইডি প্রশ্ন ফাঁস চক্রের ১২ সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সাত জনই চিকিৎসক। তদন্তের ধারাবাহিকতায় খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মালিক ডা. তারিমকে আটক করা  হয়েছে।

৩ মে ২০২১ সালে প্রকাশিত কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি নিউজ বলছে— ডাঃ তারিমের কোচিং থেকে এ পর্যন্ত চার সহস্রাধিক শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। এ নিউজ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে— এ সময়ও ডাঃ তারিমকে একবার সিআইডি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন সিআইডি থেকে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ অনুসন্ধানের কথা জানানো হয়েছিলো বলে এ প্রতিবেদনে উঠে আসে। ২০১৯ সালের গ্রেফতার প্রসঙ্গে এ প্রতিবেদনের বরাত থেকে জানা যাচ্ছে— প্রশ্ন ফাঁসের গ্রেপ্তারকৃত আসামি জাকির হোসেন দীপু, পারভেজ হোসেন এবং এস এম সানোয়ার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে থ্রি ডক্টরস কোচিংয়ের নাম বলেছেন। চক্রের হোতা জসিমের সহযোগী রওশন আলী হিমু একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের জন্য মোটা অঙ্কের টাকায় তার কাছ থেকে ফাঁসকৃত প্রশ্ন কিনতেন ফার্মগেটের একটি অ্যাডমিশন সেন্টারের মালিক জহিরউদ্দিন বাপ্পী।

১৪ আগস্ট ২০২৩ দৈনিক মানবজমিনে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখনও ডাঃ তারিম এ যাত্রায় গ্রেফতার হয়ে পারেনি। প্রতিবেদনটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে বলছে— ১৬ বছর ধরে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছে চক্রটি। ফাঁস হওয়া এসব প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে অনেকেই মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এমবিবিএস শেষ করে তারা এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরি করছেন। চক্রটি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে হাজার খানেক শিক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র সরবরাহ করেছে। হাতিয়ে নিয়েছে শ’ শ’ কোটি টাকা। গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। এসব টাকা দিয়ে তারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। আবার অনেকেই অবৈধ পন্থায় আয় করা এসব টাকা বিদেশে পাচার করেছে। চক্রের বেশিরভাগ সদস্য মেডিকেল ভর্তির কোচিং সেন্টারের আড়ালেই প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারের এক তদন্তে এই চক্রটির সন্ধান মিলেছে। 

গোয়েন্দা সংস্থা প্রথমে ১২ জনকে গ্রেফতার করে। এর মধ্যে ৭জনই চিকিৎসক। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ (৫০), ডা. সোহেলী জামান (৪০), ডা. মোহাম্মদ আবু রায়হান, ডা. জেড এম সালেহীন শোভন (৪৮), ডা. মো. জোবায়দুর রহমান জনি (৩৮), ডা. জিল্লুর হাসান রনি (৩৭), ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল (৩২), জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার (৬৮), রওশন আলী হিমু (৪৫), আখতারুজ্জামান তুষার (৪৩), জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পি (৪৫) ও আব্দুল কুদ্দুস সরকার (৬৩)। ৬ আগস্ট (২০২৩) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি সদর দপ্তরের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়ে সংস্থাটির প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০২০ সালের প্রশ্নপত্র ফাঁস-সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে জসীম উদ্দীন ও মোহাম্মদ সালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মূল হোতা ছিলেন জসীম। তার খালাতো ভাই সালাম স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রেসের মেশিনম্যান। তারা আদালতে ৬৪ ধারার জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে সবশেষ গ্রেপ্তার ১২ জনের নাম আসে। এরা সবাই পলাতক ছিলেন।

মিরপুর মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা তদন্ত করে পাওয়া যায় চক্রটির অন্তত ৮০ সদস্য প্রায় ১৬ বছর ধরে হাজার খানেক শিক্ষার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্ন দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি করিয়ে শত কোটি টাকা আয় করেছে। পরে ঢাকা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি’র সাইবার টিম। পূর্বেই বলা হয়েছে গ্রেপ্তারকৃত ১২ জনের মধ্যে ৭ জনই ডাক্তার। এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্ন ফাঁস করতেন।যেসকল শিক্ষার্থী ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রে মেডিকেলে ভর্তি হয়ে পাস করেছেন তাদেরও আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে জানা যায়। একইসাথে জালিয়াতি চক্রের মানি লন্ডারিং-এর তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সিআইডি জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়ান। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে গত ২০ বছরে অবৈধভাবে শত শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ডাক্তার ময়েজ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও মানি লন্ডারিং দুটি মামলার এজাহারনামীয় আসামি। তিনি চিহ্নিত ছাত্রশিবির নেতা ও পরবর্তীতে জামায়াতের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। গ্রেপ্তার ডা. সোহেলী জামান প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম সদস্য। তিনি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ফেইম নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে স্বামী ডা. ময়েজের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। গ্রেপ্তার ডা. মো. আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ২০০৫ সালে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি প্রাইমেট কোচিং সেন্টার চালান। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে প্রেকটিস করেন। ডা. জেড এম সালেহীন শোভন মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে থ্রি ডক্টরস নামক কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে তিনি অনেক বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। তিনি ২০১৫ সালে র?্যাবের হাতে একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। শোভন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদলের পদধারী নেতা ছিলেন।

সিআইডি জানায়, ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক। ২০০৫ সাল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে জড়িত। নামকরা বিভিন্ন চিকিৎসকের সন্তানদেরও তিনি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। এই ব্যবসা করে দামি গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকে নগদ অর্থসহ কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে যুবদলের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক। ডা. জিল্লুর হাসান রনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত হন।

২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় র‍্যাব প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে রংপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। রংপুর মেডিকেলে অধ্যয়নকালে ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন। বর্তমানে ড্যাব এর সঙ্গে জড়িত এবং আহত বিএনপি নেতাদের চিকিৎসায় গঠিত টিমের একজন চিকিৎসক। ডা. হিমেল তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস সরকারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়ান। ময়মনসিংহের বেসরকারি কমিউনিটি বেইজড মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলে তার শ্বশুরবাড়িতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন দিয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে মেডিকেলে ভর্তি করান। জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া মুক্তার মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীমের বড় ভাই ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যুরো প্রেসের মেশিনম্যান সালামের খালাতো ভাই। তিনি নিজে আলাদা একটি চক্র চালাতেন। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। রওশন আলী হিমু (৪৫) জসীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং পুরনো সহযোগী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ২০০৬ সাল থেকে মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

একইভাবে জহির উদ্দিন আহমেদ বাপ্পী মেডিকেল প্রশ্ন ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা। ঢাকার ফার্মগেটে ইউনিভার্সেল নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি সহায়তা কেন্দ্র চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরসসহ বিভিন্ন মেডিকেল কোচিং সেন্টারে ফাঁসকৃত প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি যুবদলের কর্মী। জহিরের পুরো পরিবার বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আব্দুল কুদ্দুস সরকার টাঙ্গাইলের মিন্টু মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসরে গেছেন। ২০০৬ সালে মেয়ে কামরুন নাহার কলিকে ভর্তির মাধ্যমে এই চক্রে জড়ান। এরপর ছেলে ইমরুল কায়েস হিমেলকে সঙ্গে নিয়ে টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহে গড়ে তোলেন প্রশ্ন ফাঁসের বড় এক সিন্ডিকেট। জসীমের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল কুদ্দুসের। জসীমও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নিয়মিত টাঙ্গাইল যেতেন। গ্রেপ্তার আক্তারুজ্জামান তুষার প্রশ্ন ফাঁস মামলার এজাহারনামীয় আসামি। ই-হক নামে কোচিং সেন্টার চালাতেন। ২০০৫ সাল থেকে এই চক্রের সঙ্গে জড়ান। ২০১৫ সালে রাবের হাতে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

অতএব, দেখা যাচ্ছে মেডিকেল ভর্তির মতো একটি স্পর্শকাতর প্রক্রিয়া অপরাধীরা পুরোপুরি তছনছ করে দিলেও পুলিশ এবং প্রশাসন এ বিষয়ে বরাবরই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে— এবারও কি পুলিশ প্রশাসন এবং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ব্যর্থ হবে?


যে সকল পত্রিকার সহায়তা নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছেঃ

♣ কালের কণ্ঠ, বাংলা ট্রিবিউন, মানবজমিন, বিডিনিউজ।