শিশুর জ্বর হলে করণীয়

১

থার্মোমিটার দিয়ে মাপার পর তাপমাত্রা যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার চেয়ে বেশি হয় তবে তাকে জ্বর বলা যায়। জ্বর হচ্ছে শরীরের মধ্যে কোন অসুখের একটি সাধারণ লক্ষণ। সাধারণত জ্বর নিজে রোগ না হলেও জ্বরের কারণে শরীরে ক্লান্তি, ক্ষুধামন্দা ও পানিশূন্যতা তৈরি করে। হঠাৎ করে বেশি জ্বর শিশুদের খিঁচুনির অন্যতম কারণ।
যে কারণেই জ্বর হোক না কেন জ্বর হলেই জ্বরের প্রাথমিক পরিচর্যা শুরু করে জ্বর কমানোর চেষ্ট করতে হবে। যে কারণে জ্বর হয়েছে তার কারণ খুঁজে চিকিৎসা না করলে অনেকসময়ই জ্বর পুরোপুরি ভাল হয় না।
জ্বর মাপা:
শিশুর গায়ে হাত দিয়ে জ্বরের মাত্রা বোঝা কঠিন, কারণ ছোট শিশুদের মাথা ও ঢেকে রাখা শরীর এমনিতেই গরম থাকে। ফলে জ্বর না থাকলেও জ্বর আছে বলে ভুল হতে পারে। তাই থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপা (আসলে শরীরের তাপমাত্রা) উচিত। অনেকেই সাধারণ যে থার্মোমিটার পাওয়া যায় (দাম ২০/৩০ টাকা) তা পড়তে পারেন না। কিন্তু কিনে বারবার চেষ্টা করলেই এবং অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে ৫/১০ মিনিটের সাহায্য নিলেই শিখতে পারবেন। আজকাল ডিজিটাল থার্মোমিটার পাওয়া যায়। ভালগুলোর দাম বেশি (প্রায় ৩০০-৪০০ টাকা)।
কিভাবে থার্মোমিটার ব্যবহার করবেন:
প্রথমে থার্মোমিটার স্পিরিট বা সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে নিন। ডিজিটাল থার্মোমিটার হলে খেয়াল রাখুন ভিতরে যেন পানি না যায়।
সাধারণ থার্মোমিটার হলে পারদের অবস্থান দেখুন তা যদি ৯৭ ডিগ্রির উপরে থাকে, তবে জোরে ঝাঁকিয়ে পারদকে এর নিচে নিয়ে আসুন। ডিজিটাল থার্মোমিটার হলে সুইচ চাপ দিন এবং চালু করুন।
থার্মোমিটারের গোড়া বগলের নিচে রেখে হাতে শরীরের সাথে মিশিয়ে ২/৩ মিনিট চেপে ধরুন। বড়দের বেলায় মুখের ভিতর জিহ্বার নিচে রেখে ঠোঁট দিয়ে চেপে রাখতে বলুন। ১ থেকে ২ মিনিট। সাধারণভাবে ১ মিনিট রাখা হয়। ডিজিটাল থার্মোমিটার হলে মিউজিক বাজলে বের করুন।
এবার তাপমাত্রা দেখুন। ডিজিটাল থার্মোমিটারে সংখ্যা সহজেই পড়া যায়।
থার্মোমিটারটি পরিষ্কার করে ধুয়ে মুছে রাখুন।
জ্বরের প্রাথমিক পরিচর্যা:
থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর পরিমাপ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরের তাপমাত্রা ১০০০ ফারেনহাইট পর্যন্ত সামান্য জ্বর, ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত খুব জ্বর এবং ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে খুব বেশি জ্বর বলা যায়। তাই প্রথমেই সম্ভব হলে জ্বর মাপার চেষ্টা করতে হবে এবং লিখে রাখতে হবে।
গায়ে হালকা কাপড় রাখা যায়। জ্বর খুব বেশি হলে শরীরের সব জামা-কাপড় খুলে দিতে হবে।
জ্বর খুব বেশি হলে ফ্যান ছেড়ে তার নিচে রাখতে হবে, সমস্ত শরীর কুসুম গরম পানি দিয়ে স্পঞ্জ করে দিতে হবে। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে শরীর মোছা উচিত নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জ্বর না কমবে ততক্ষণ স্পঞ্জ করে যেতে হবে।
মাথায় পানি ঢালা ও কপালে পানির পট্টি দেয়া যায়। খেয়াল রাখতে হবে, কানে যেন পানি না যায়।
মাত্রা অনুযায়ী প্যারাসিটামল ঔষধ খাওয়াতে হবে বা প্যারাসিটামল সাপোজিটরি (পায়খানার রাস্তায় ডুস) ব্যবহার করতে হবে। যতক্ষণ জ্বর থাকবে ততক্ষণ ৬ ঘণ্টা পরপর এই ঔষধ চলবে।
জ্বরের সময় পানিশূণ্যতা প্রতিরোধে ঘন ঘন বুকের দুধ চুষতে দিতে হবে এবং বড় শিশুদের পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খেতে দিতে হবে।
জ্বরের সময় স্পঞ্জ করার/ গা মুছে দেয়ার নিয়ম:
পরিষ্কার তোয়ালে, গামছা বা সুতি বড় ওড়না কুসুম গরম বা ট্যাপের স্বাভাবিক পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে পানি চিপে/নিংড়ে নিয়ে ভেজা তোয়ালে বা কাপড় দিয়ে প্রথমে এক হাত পরে অন্য হাত, তারপর শরীর, দু’পা বিশেষ করে বগল ও কুচকি ভালো করে মুছে দিতে হবে। ভেজা কাপড় দিয়ে মোছার পরপরই শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে, যেন শরীর বেশিক্ষণ ভেজা না থাকে। এভাবে জ্বর না কমা পর্যন্ত (১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট না হওয়া পর্যন্ত) বারবার সমস্ত শরীর মুছে দিতে হবে।
জ্বরের ঔষধ প্যারাসিটামল:
শিশুদের ক্ষেত্রে ভাল শিশু ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ঔষধ ব্যবহার করা যাবে না।
শিশুর প্রতি কেজি ওজনের জন্য প্রতিবার ১৫ মি.গ্রা করে প্যারাসিটামল পাবে। ৪/৬ ঘণ্টা পরপর খাওয়াতে হবেÑ যতক্ষণ জ্বর থাকবে, প্রতি ১ চামচ (৫ মিলি) সিরাপে ১২০ মি.গ্রা. এবং প্রতি ১ মিলি (১৫ ফোঁটা) ড্রপে ৮০মি.গ্রা প্যারাসিটামল থাকে।
সহজে মনে রাখার জন্য, প্রতি ৮ কেজি ওজনের জন্য ১ চামচ করে প্যারাসিটামল পাবে। যেমন  বাচ্চার ওজন যদি হয় ৮ কেজি, যে ১ চামচ করে ৩/৪ বার প্যারাসিটামল সিরাপ খাবে, যদি ৪ কেজি হয় তবে আধা চামচ করে পাবে। জ্বর খুব বেশি হলে বা, শিশু খেতে না পারলে একই হিসাবে প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ব্যবহার করতে হবে। আমাদের দেশে ৬০ মি.গ্রা, ১২৫ মি.গ্রা, ২৫০ মি.গ্রা ও ৫০০ মি.গ্রা-এর সাপাজিটরি পাওয়া যায়।
সাধারণভাবে
৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত        প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ১২৫ মিগ্রা.
২ বছর থেকে ৫ বছর পর্যন্ত        প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ২৫০ মিগ্রা.
৬ বছর থেকে        প্যারাসিটামল সাপোজিটরি ২৫০-৫০০ মিগ্রা.
আপনার করণীয়:
জ্বর হলেই জ্বর মাপতে হবে এবং লিখে রাখতে হবে (এজন্য প্রত্যেক ঘরেই জ্বর মাপার থার্মোমিটার থাকা উচিত। আজকাল ভাল মানের ডিজিটাল থার্মোমিটার পাওয়া যায়, যেখানে লেখা উঠে মোবাইলের লেখার মত; যা সহজেই পড়া যায়)
জ্বরের প্রাথমিক পরিচর্যা, ফ্যানের নিচে রাখা, গায়ের কাপড়-চোপড় খুলে দেয়া এবং প্যারাসিটামল খাওয়ানো শুরু   করতে হবে।
জ্বর খুব বেশি বেড়ে গেলে স্বাভাবিক/কুসুম গরম পানি দিয়ে সমস্ত শরীর স্পঞ্জ করতে থাকুন।
বেশি করে পানি, ফলের রস, স্যুপ, তরল খাবার দিন।
লক্ষ্য রাখতে হবে:    মুখের ভিতর, জিহ্বায়, মাড়িতে ঘা দেখা যায় কি না।
জ্বরের সাথে নতুন কোনো লক্ষণ দেখা যায় কি না, যেমন- * গায়ে হাম বা লুতি, * পাতলা পায়খানা, * চোখ হলুদ, * প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া বা ব্যথা বা তলপেটে ব্যথা, * গলাব্যথা, * খুব কাশি, * শ্বাসকষ্ট, * কাঁপুনি নিয়ে জ্বর আসা, * ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া ইত্যাদি।
কখন শিশুর ডাক্তার দেখাবেন:
তিন মাসের কম বয়সী শিশুর জ্বর হয়।
জ্বরের সাথে শিশুর যদি
খিঁচুনি হয়, ঘাড় শক্ত থাকে বা তীব্র মাথাব্যথা হয়
ঘুমঘুম ভাব, সারাক্ষণ কান্না করতে থাকে, ঘ্যান-ঘ্যান বা বিরক্ত করতে থাকে, ঘুরে থাকে বা অজ্ঞান হয়ে গেলে
শিশুর মাথার তালু খুব ফুলে গেলে
খুব বেশি অসুস্থ মনে হলে বিশেষ করে জ্বর কমার পর।
শিশুর প্রস্রাবে কোনো জ্বালা-পোড়া থাকলে, প্রস্রাব করতে কষ্ট হলে বা পেটে ব্যথা থাকলে।
১২ ঘণ্টার মধ্যে যদি শিশু একেবারেই প্রস্রাব না করে  অবশ্যই সাথে সাথে শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে।
গায়ে কোনো হাম বা লুতি উঠলে।
গলা ব্যথা থাকলে।
শ্বাসকষ্ট হলে।
খুব জ্বর হলে, তাপমাত্রা ১০২ -এর বেশি হলে।
জ্বর কমে গিয়ে ২/১ দিন পর আবার হলে।
জ্বর ৪৮ ঘণ্টার বেশি থাকলে।
জ্বরের সাথে পাতলা পায়খানা বা বমি ১২ ঘণ্টার বেশি থাকলে।