‘উমেদার মান্নান’ একাই কি শুধু দোষী?

সাবিল গ্রুপ

শিরোণাম দেখে মনে হয়েছিল ওনার নাম বুঝি ‌‌’উমেদার মান্নান’‍! প্রথমে ভেবেছিলাম হতে পারি, অনেকের নাম অনেক ভাবেই তো হয়। পরে বুঝলাম এটা পত্রিকার দেওয়া নাম। প্রথমেই প্রতিবাদ করছি, কারণ, মনে করি কারো নাম এভাবে পত্রিকা ছাপতে পারে না।

এবার আসি বিষয়ে-
বলা হচ্ছে প্রতারণার মাধ্যমে তিনি বিশাল বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলেছেন। আমি জানি না। আবার আমি জানতেও চাচ্ছি না, কারণ, আমি প্রতিবেদন করছি না। শুধু পত্রিকার ঐ প্রতিবেদন ধরে ধরে কিছু বিষয় উল্লেখ করছি। প্রথমে একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করছি:

জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাজ কী? সবার চোখ এড়িয়ে একজন লোক অবৈধভাবে চার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল! সত্যি সেলুকাস!!

১। বলা হচ্ছে, এমএম আব্দুল মান্নান তালুকদার ছিলেন পাঁচ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী এবং ১৯৮৪ থেকে পরবর্তী ২৬ বছর তিনি জেলা প্রশাসনে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী কি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারবে না? বিষয়টা তো এখানে নয় যে কে কত টাকার মালিক হলো। বিষয়টা হচ্ছে, ‌’কীভাবে’ তিনি এত টাকার মালিক হলেন? 

২। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, “২০১০ সালের পর তিনি ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছেন।” ২০১০ থেকে ২০১৮, মাত্র ৮ বছর, এই ৮ বছরে তিনি কীভাবে এত টাকার মালিক হলেন তা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়নি। কোনো অনুসন্ধানী বক্তব্য নেই, অথচ ঢালাউভাবে বলা হচ্ছে যে তিনি ২০১০ সালের পর চার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।!

৩। প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে, ‌”জানা গেছে, শত শত একর জমি, আটটি ব্যক্তিগত গাড়ি, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন শহরে মার্কেট, জুট মিলসহ অঢেল সম্পত্তির মালিক আবদুল মান্নান বাস করেন শতাধিক সিসি ক্যামেরা পরিবেষ্টিত বাড়িতে। মাঝেমধ্যে উড়াল দেন হেলিকপ্টারে। তার গড়ে তোলা ১৫-২০টি কোম্পানিতে কর্মরত রয়েছে ৩০০ জনবল। ” এ ধরনের বক্তব্যের সাথে সুস্পষ্ট রেফারেন্স থাকতে হয়, সূত্র উল্লেখ করতে হয়, অথচ পত্রিকাটি লিখেছে, ‌’জানা গেছে’। সাধরণ পাঠক হিসেবে আমরা কী বুঝব? কার কাছ থেকে জেনেছেন তিনি (প্রতিবেদক) এসব?

৪। প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, “সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জমা নেয়া আমানতই হলো মান্নানের অর্থের মূল উৎস। নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি খুলে প্রায় ৪০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছেন তিনি।” অর্থাৎ একটি কোম্পানি এবং একটি ঋণদান সমবায় সমিতি খুলে তিনি আমানত সংগ্রহ করেছেন মানুষের কাছ থেকে। এখানে অবশ্যই বলা দরকার ছিল, তিনি কীভাবে কোম্পানিটি ও ঋণদান সমবায় সমিতিটি খুলেছেন, কোথা থেকে খুলেছেন, সেক্ষেত্রে সকল শর্ত মানা হয়েছে কিনা?

৫। বলা হচ্ছে, ব্যাংকে লাখ টাকা আমানত রাখলে মাস শেষে পাওয়া যায় সর্বোচ্চ ৫০০-৭০০ টাকা মুনাফা। এজন্য সাধারণ মানুষ ছুটছে আব্দুল মান্নানের নিউ বসুন্ধরায়। কারণ কোম্পানিটিতে লাখ টাকা আমানত রাখলে প্রতি মাসেই ২ হাজার ৪০০ টাকা মুনাফা পাওয়া যায়। চার-পাঁচ বছর পর বিনিয়োগের দ্বিগুণ অর্থ দেয়ার প্রলোভনও পাচ্ছেন গ্রাহক। ফলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিউ বসুন্ধরায় বিনিয়োগ করছে সাধারণ মানুষ।” এটা খতিয়ে দেখা দরকার ছিল যে ঠিক কি প্রক্রিয়ায় এটি হচ্ছে। কয়েকজন আমানতকারীর সাথে কথা বলার দরকার ছিল, অথচ কোনো আমানতকারীর বক্তব্য এখানে নেই। বলা হচ্ছে, প্রতারণার কথা, কিন্তু প্রতারিত হয়েছেন এমন কারো বক্তব্য প্রতিবেদনটিতে নেই! তাই বলা যায়, এই প্রতিবেদনটি একেবারেই অসসম্পূর্ণ এবং একপেশে।

৬। প্রতিবেদনে উল্লেখ,

“সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নেয়া আমানত জমা হচ্ছে আব্দুল মান্নানের পকেটে। সে অর্থে বাড়ি, গাড়ি, মার্কেট, জমি, জুট মিলসহ নতুন নতুন কোম্পানি খুলছেন তিনি। নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের নামে অর্থ সংগ্রহ করলেও সে অর্থ বিনিয়োগ করছেন অন্য কোম্পানিতে। এরই মধ্যে সাবিল গ্রুপ লিমিটেড, বাগেরহাট ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড, জাকারিয়া এন্টারপ্রাইজসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি খুলেছেন। ঋণের দায়ে নিমজ্জিত পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা এ্যাজাক্স জুট মিল কিনে নিয়েছেন। এভাবেই সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে নতুন নতুন কোম্পানি খুলে বিনিয়োগ করছেন আব্দুল মান্নান।”
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো একটি কোম্পানির নামে এবং ঋণদান সমবায় সমিতির টাকা ব্যক্তিগত নামে কোনো কোম্পানিতে করা যায় কিনা? পত্রিকাটি এ বিষয়ে আইনগত দিক উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোম্পানির নামে আমানত সংগ্রহ করতে হলে তো শেয়ার বণ্টণ করতে হয়, সেটি তিনি কোন প্রক্রিয়ায় করলেন তাও প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।

৭। বলা হচ্ছে, “বাগেরহাট শহরের মিঠাপুকুর পাড় (সরই) এলাকায় ইসলামী আদর্শ ক্যাডেট একাডেমি নামে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন আব্দুল মান্নান। ওই মাদ্রাসার আঙিনার পাশে তিনতলা একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি। এ বাড়ির নিচতলা থেকেই পরিচালিত হচ্ছে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটসহ সবক’টি কোম্পানির কার্যক্রম। বাড়িটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আব্দুল মান্নানের পরিবার বসবাস করে। গত ৩১ জুলাই দুপুরে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সুদৃশ্য একটি কামরায় বসে আছেন আব্দুল মান্নান। প্রথম দর্শনে যে কেউ মনে করবেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। সামনে টেবিলে অ্যাপলের ল্যাপটপ, পাশে এবং সামনে বেশ কয়েকটি বড় মনিটর। মনিটরে দুই শতাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ভেসে উঠছে। পাশের বুক শেলফে সারি সারি বিভিন্ন আইনের বই।”

শিরোণামের সাথে সংগতি রেখে অনেক প্রয়োজনীয় কথা প্রতিবেদনে নেই। অথচ এসব পড়ে মনে হচ্ছে, প্রতিবেদক যেন তাঁর বায়োগ্রাফি লিখেছেন।

৮। বলা হচ্ছে, ‍”আব্দুল মান্নানের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অঢেল সম্পত্তির উৎস নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ আছে বাগেরহাটের বিশিষ্টজনদের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, আব্দুল মান্নান আমার অফিসেরই কর্মচারী ছিলেন। চতুর্থ শ্রেণীর একজন কর্মচারী সারা জীবন কত টাকা আয় করেন এবং অবসরে যাওয়ার পর প্রভিডেন্ট ফান্ডে কত টাকা পান, তা সবাই জানেন। কিন্তু তার বর্তমান পরিস্থিতি চাকরিজীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে কিংবা ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করলে আমরা আব্দুল মান্নানের সম্পত্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে খতিয়ে দেখব। তবে সরকারি কোনো জমি বা খাসজমি দখল করলে আমরা অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেব।”

বিশিষ্টজনদের নাম এখানে উল্লেখ নেই! শুধু জেলা প্রশাসক মহোদয়ের বক্তব্য আছে। এর মানে কি এই না যে জেলা প্রশাসনের অজান্তের এত কিছু হচ্ছে? খাস জমি দখল হচ্ছে, শত শত বিঘা জমি রেজিস্ট্রি হচ্ছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, ইসলামী ক্যাডেট একাডেমি গড়ে উঠছে, সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে জেলায় ইফতার পার্টি হচ্ছে, অথচ জেলা প্রশাসন বলছে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেব!! 

তার মানে কি এই যে ‘কম শিক্ষিত’ বলে শুধু মান্নান সাহেবকেই ফাঁশানো হবে? নাকি বিভিন্ন ধরনের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। । ভাগীদারের সংখ্যা বাড়বে, তাতে জনগণের কী লাভ হবে?

৯। বলা হচ্ছে, “স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাগেরহাট জেলা থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু মানুষ দেশ ছেড়েছে। তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন খাসজমি দখল কিংবা স্বল্পমূল্যে কিনে নেয়াই ছিল আব্দুল মান্নানের লক্ষ্য। এভাবে বিপুল পরিমাণ জমির মালিক হওয়ার পর নতুন করে নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের নামে জনগণ থেকে টাকা নিয়েছেন। উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে পড়ে সাধারণ মানুষও আব্দুল মান্নানের হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন।”

হিন্দু সম্পত্তি দখলের কোনো অভিযোগ কি তাঁর বিরুদ্ধে আছে? তাহলে “তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন খাসজমি দখল কিংবা স্বল্পমূল্যে কিনে নেয়াই ছিল আব্দুল মান্নানের লক্ষ্য। ” এ বক্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা কি? এখানে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য থাকা দরকার ছিল না কি?

নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেট

১০। গত ৩০ জুলাই খুলনা শহরে বয়রা এলাকায় নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের খুলনা কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটা সমবায় সমিতি কিংবা ব্যাংকের স্টাইলে সেখানে লেনদেন চলছে। গ্রাহকরা হিসাব বই সঙ্গে এনে টাকা জমা দিয়ে রসিদ নিচ্ছেন। কেউ কেউ মুনাফার টাকা উত্তোলন বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন। এ শাখার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যশোরের চৌগাছার বাসিন্দা মো. মহিউচ্ছুন্নাহ বুলবুল। কোম্পানিটির কার্যক্রম বিষয়ে তিনি বলেন, গ্রাহক সংগ্রহ ও টাকা কালেকশনের জন্য খুলনায় ৫০-৬০ জন মাঠ কর্মকর্তা রয়েছেন। এরই মধ্যে খুলনায় নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটে সাড়ে তিন হাজার গ্রাহক বিভিন্ন অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। সব মিলিয়ে শুধু খুলনা থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এসেছে। কোম্পানির এমডি আব্দুল মান্নান মহানুভবতার জায়গা থেকে গ্রাহকদের ২৪ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছেন। খুলনার বিভিন্ন স্থানে কোম্পানি জমি কিনেছেন। ঠিক কত পরিমাণ জমি খুলনায় আছে, তার নির্দিষ্ট পরিমাণ জানাতে পারেননি মহিউচ্ছুন্নাহ বুলবুল।

ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা এখানে সুস্পষ্টভাবে ফুঁটে উঠেছে। কেন মানুষ ব্যাংকের ওপর অাস্থা হারালো? শুধু একজন মান্নানকে দোষারোপ না করে ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো খতিয়ে দেখা দরকার নয় কি? অার জমি কিনতে হলে টাকার উৎস্য দেখাতে হয়, কীভাবে তিনি টাকার উৎস্য দেখাচ্ছেন? তখন কেন প্রশাসনের লোক খোঁজ নিচ্ছে না? হয়ত খোঁজ নিয়ে অবৈধ কিছু পাচ্ছে না। তাহলে এই প্রতিবেদনের সারবস্তু থাকে কিছু? এখানে বিষয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বক্তব্য সংযুক্ত থাকা উচিৎ ছিল না কি? 

১১। বলা হচ্ছে, “সূত্র জানিয়েছে, আব্দুল মান্নানের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে চরমোনাই পীরের অনুসারীদের মাধ্যমে। কোম্পানিটির প্রায় সব মাঠকর্মীই পীরের অনুসারী। খুলনাঞ্চলে চরমোনাই পীরের অনুষ্ঠান বাস্তবায়নে আব্দুল মান্নান আর্থিক সহায়তা দেন। নিউ বসুন্ধরা রিয়েল এস্টেটের একটি শরিয়াহ বোর্ডও গঠন করেছেন আব্দুল মান্নান। খুলনার বোয়ালখালী মাদ্রাসার মুহতামিম খলিফা আব্দুল আউয়াল, মুফতি ওয়াক্কাস আলীসহ চরমোনাই পীর পন্থী আলেমরা কোম্পানিটির শরিয়াহ বোর্ডের সদস্য।”

এসব কথা তাঁর বায়োগ্রাফিতে থাকতে পারে, বা বিশ্লেষণে থাকতে পারে, প্রতিবেদনে কি থাকতে পারে?

সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের সঠিক তথ্য এবং আইনগত দিক জানার অধিকার রয়েছে। তাই ফলোআপনিউজ পত্রিকার কাছে অনুরোধ, আপনারা একটি গঠনমূলক প্রতিবেদন তৈরি করুন এ বিষয়ে।


প্রেরক:
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।

যে প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রেরক চিঠিটি লিখেছেন সেটি এখানে জুড়ে দেয়া হলো:

খুলনা অঞ্চলজুড়ে উমেদার মান্নানের প্রতারণার ফাঁদ

স্ক্রিনশট