প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট, হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছিলেন। আমাদের দেখে মুখের মাস্কটি খুলে ফেললেন। শ্বাসকষ্ট যেন আরও তীব্রতর হয়ে উঠলো।দেশের সংকটের কথা বললেন, সংকট থেকে উত্তরণের পথও বাতলে দিলেন। এরপর তার ব্যবহার্য অক্সিজেন সিলিণ্ডার এবং বাকী জিনিসগুলো কীভাবে আর্ত ও বিপন্ন মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে হবে সে বিষয়েও ফিরিস্তি দিলেন। বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়েও একজন মানুষ কীভাবে দেশ ও মানুষের কথা ভাবতে পারেে -এই প্রথম দেখলাম। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল কোটর থেকে চোখ দুটো বের হয়ে আসবে। এমন সময় ডাক্তার এবং নার্স কেবিনে প্রবেশ করলেন।
আমি আমার অনুজ বন্ধু আবু আহাদকে সাথে নিয়ে হেলথ এণ্ড হোপ হাসপাতালের ৭ তলা থেকে ৩ তলায় নেমে আসলাম। আমার কক্ষে দুজন চুপচাপ বসে রইলাম। তখন এই হাসপাতালের আমিই ব্যবস্থাপক। এমন সময় ওয়ার্ডবয় মোমিন দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ম্যাডামের অবস্থা খারাপ। আপনাকে ডাকছেন, আপনার সাথে নাকি জরুরি কথা আছে।
আমি আর আহাদ ছুটে গেলাম কেবিনে। দেখলাম সব শেষ। তিনি আর নেই। চোখ দুটি আধো খোলা। নার্স মুখের মাক্সটি খুলে ফেললো, ঠোঁট দুটি কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছেন। নাহ! শেষ কথা আর শোনা হলো না।
কমরেড নাসিমা ইসলাম হার না মানা এক বিপ্লবীর নাম। পেশায় ছিলেন শিক্ষিকা। ছাত্র জীবনে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গৌরবময় সংগ্রামী জীবন তার। আরেকজন বিপ্লবী কমরেড তাজুল ছিলেন তার জীবনসঙ্গী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র ছিলেন তাজুল ইসলাম। শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি গোপন রেখে আদমজীতে বদলী শ্রমিকের চাকুরি নিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ ৩৪ বৎসর বয়সে আজীবন সংগ্রামী কমরেড তাজুল স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে যেয়ে এরশাদের গুণ্ডাবাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন।
কমরেড নাসিমা ইসলাম আমাদের ‘সমসর সমবায় সমিতি’র সম্মানিত সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর আগে দুই ছেলেকে বলে গিয়েছিলেন তারা (ছেলেরা) যেন তার (নাসিমা ভাবীর) সমিতির সদস্য পদ প্রত্যাহার করে না নেয়। বরং তার সঞ্চিত আমানত সমান ভাগ করে দুইভাই যেন সমসরের সদস্যপদ গ্রহণ করে। বিদেশে বসবাসরত তার দুই পুত্র মায়ের কথা রেখেছেন।
৪ জানুয়ারি ছিল নাসিমা ভাবীর প্রয়াণ দিবস। শ্রদ্ধা অবনত মস্তিষ্কে সমসরের পক্ষ থেকে কমরেড নাসিমা ইসলামকে লাল সালাম। কমরেড নাসিমা ইসলামের বিপ্লবী জীবন সমাজ বিপ্লবের লড়া্ইয়ে নিবেদিত কর্মীদের চিরদিন অনুপ্রাণিত করবে।