Headlines

ছোট্ট একটি সফলতার গল্প বলি

গোপালগঞ্জ

বাংলার রূপ


একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছি। এসময় দুটো শিশু এসেও দুটো চায়ের অর্ডার দিলো। বড় জনের বয়স ৬/৭ বছর, ছোটো জন আরও ছোট। 
দোকানদারের ব্যবহারে বুঝলাম সে তাদেরকে চেনে। 
কথা বললাম ওদের সাথে। একটু বিস্কুট টিস্কুট খাইয়ে খাতির করলাম। জানলাম, ছোট্টটা স্কুলে যায় না, অবশ্য ওর বয়সও হয় নাই, কিন্তু মেয়ে শিশুটা স্কুল শুরু করে এক বছর পড়ে বাদ দিয়েছে।
ওর মা বাপের খোঁজ নিলাম। 
জানলাম, পাশের আরেকটা চা রুটির দোকান ওর মা চালায়, বাপ ঠেলাগাড়ি চালায়। 
বুঝলাম না—দুজন কাজ করেও সংসার চলবে না কেন?
ওর মা বাপরে ডাকলাম আমার অফিশে। যা থাকে কপালে—ঝাড়লাম ইচ্ছেমতো। দেখলাম, তারা লোক ভালো। বাচ্চা কাচ্চা ভবিষ্যতে আর হবে না, এই গ্যারান্টি পাইলাম। 
এরপর মেয়েটারে আবার স্কুলে দিতে বললাম। দিলও কয়েকদিন পর। 
বিপদ হলো—কয়দিন পর আমার কাছে টাকা ধার চেয়ে বসল। অবশ্য এতে আমি অবাক হই নাই, কারণ, এটাই পূর্ব অভিজ্ঞতা। 
এবার আবার ঝাড়লাম, ‘লজ্জা করে না টরে না’ ইত্যাদি ইত্যাদি মেলা কিছু বললাম ঐ দম্পতিকে। মনে মনে যাই থাকুক নিজের উগ্র মূর্তিই দেখালাম। 
বললাম, আমার সাথে আপনারা এই যে দুইদিন দুই ঘণ্টা কথা বলতেছেন এর চেয়ে দুই হাজার টাকা বেশি নয়, কারণ, আমার দুই ঘণ্টার মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি। 
এখন বলেন যে কোনটা নেবেন—দুই হাজার টাকা, নাকি আরও দুই ঘণ্টা সময়?
হাসে। এবার আবার ঝাড়লাম। এরপর সবকিছু জানলাম। তাদের চলে না তার প্রধান কারণ হচ্ছে—তাদের কোনো পরিকল্পনা করার সামার্থ নেই। 
স্বামী ঠেলাগাড়িও ঠিকমতো চালায় না, স্ত্রী দোকানটাও ঠিকমতো চালায় না, ফলে ঠেলাগাড়ির ভাড়াও ওঠে না, এদিকে দোকান ভাড়াও ওঠে না। 
লোকটাকে বললাম, আপনি ঠেলাগাড়ি ঠেলা বাদ দিয়ে আপনার স্ত্রীর সাথে দোকানে যোগ দেন। ঠিক পনেরো দিন পর দেখা করেন। 
ওরা কথা শুনল। পনেরো দিন পর দেখা করল। কিন্তু তাদের মন খারাপ। কিছু বলতে গিয়েও বলে না। 
বুঝলাম যে আগের মতোই চলছে না। দোকান ভিজিট করলাম। ঐদিন বিকাল থেকে ওদের দোকান থেকে রুটি আর ডিম খাওয়া শুরু করলাম, আমি আর অফিশে আরেকজন। তাহলে দৈনিক বিশ টাকা লাভের ব্যবস্থা তাদের হয়ে গেলো। 
এটা তাদের জন্য রেগুলার করে দিলাম। বিকালে তো কিছু খেতেই হয়, সেটি একটা ডিম আর আটার রুটি হলে সমস্যা নেই। 
এক সপ্তাহ পরে আবার দুজন আসল। কিছু বলে না, সাহস পায় না। 
জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিলাম। এবার আমি তাদের সংসারের খরচের এবং দোকানের আয়ের হিসাব নিলাম। বুঝলাম যে আরও হাজের তিনেক টাকা ইনকাম দরকার। 
মাথা খাটাচ্ছি—কীভাবে এটা হতে পারে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। দোকানে একটু দূরে হাসপাতাল, কয়েকটা হাসপাতাল এই রোডে। এমনি এলাকাটা ব্যস্ত এলাকা নয়, তবে হাসপাতাল একটা ফ্যাক্ট। 
বললাম, দশটা ডাব কিনে এনে সামনে রাখেন। 
কাচুমাচু করে, সম্ভবত পূঁজি নেই অথবা আমার কথায় আস্থা রাখতে পারছে না। বললাম, যেভাবে পারেন টাকা সংগ্রহ করে কিনে আনেন। সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করবেন। এই দশটা ডাব বিক্রি না হলে আমি কিনে নেব। 
সন্ধ্যায় তারা আমার সাথে দেখা করল। মহিলার হাতে একটা ডাব কাটা। 
জিজ্ঞেস করলাম, কি, ডাব তাহলে চলল না?
হাসে, বলে, এই ডাবটা আপনি খান। 
খাইলাম। বলল, নয়টা ডাব বিক্রি হয়েছে, এটাও বিক্রি হত, কিন্তু এটা আপনাকে খাওয়ালাম। আমি আর ওদের দিকে তাকালাম না। চলে গেল। 
এখন তাদের দোকানে প্রতিদিন ডাব বিক্রি হয় গড়ে পনেরোটা। প্রতি ডাবে দশ টাকা ব্যবসা, অর্থাৎ ডাব থেকে দৈনিক ব্যবসা হয় একশো বিশ টাকা থেকে একশো পঞ্চাশ টাকা। 
দোকানটাও আগের চেয়ে ভালো চলছে, কারণ, দুজনে একসাথে চালানোই নিয়মিত খুলতে পারছে, মেয়েটাও স্কুলে যাচ্ছে নিয়মিত। 
এখন তারা বলছে, দোকানটা সুন্দর করবে, কিছু টাকা ম্যানেজ করবে। 
এবার আবার ঝাড়লাম, বললাম, যেদিন ব্যাংকে কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা জমবে সেদিন দোকান সুন্দর করবেন, তার আগে এভাবেই চালান। 
শুধু খাবারটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখেন, আশপাশ পরিস্কার রাখেন, রংচং দরকার নেই, রংচং-এর কাস্পটমার আপনাদের কাছে আসবে না, দরকারও নেই।


দিব্যেন্দু দ্বীপ