Headlines

পড়তে পারেন শেষের কবিতা: বইটির আসলে কোনো শুরু নেই, শেষও নেই!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বিবাহের মাধ্যমে যে প্রেম, তা শুরুতেই পার্থিব সত্য মেনে নেয়, ফলে এখানে যত পূজা সব সাজানো, দেনা পাওনা বুঝে নেওয়া সহজ হয়, নিয়মিত বলে সংশয়ও কম, তাই শুধু কাঠামো দিয়েও তা টিকে থাকে।


বইটি যত গোলমেলে মনে হয় আসলে বইটিতে অত গণ্ডগোল কিছু নেই। অমিতের কথার কৌলিন্য, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ বিবরণই এখানে পাঠককে গোলক ধাঁধায় ফেলে দেয় মাত্র।

বইটির আসলে কোনো শুরুও নেই শেষও নেই, আছে শুধু বহুধাবিভক্ত পথ, এখানেই হয়ত বইটির যত জটিলতা। কিছু কিছু অপ্রাসংগীকতাও অস্পষ্টতা বৃদ্ধি করেছে।

“সম্ভবপরের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকাই সভ্যতা; বর্বরতা সকল বিষয়েই অপ্রস্তুত” —এ ধরনের আখ্যান এ বইয়ের মূল কাহিনীর সঙ্গে বেমানান; মূলত বইটিতে বিশেষ কোনো কাহিনীই নেই, আছে শুধু কথা ।

আবার অসম্ভব সুন্দর ভাষায় রবীন্দ্রনাথ মানব প্রবৃত্তির সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। অভিজাত হলেও প্রবৃত্তি যে বদলায় না, সে ইঙ্গিতও আছে বইটিতে।

“পড়াশুনা করতে যান খুবই জোরের সাথে, কিন্তু তার চেয়ে জোর আছে এমন কোনো একটা চিন্তা তার কাঁধে চেপে বসে।”

“দ্বিধা করে যে পুরুষ যথেষ্ট জোরের সাথে প্রত্যক্ষ না করায় মেযেরা তাকে যথেষ্ট স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করে না।” একটি সাধারণ সত্য কথা রবীন্দ্রনাথের ভাষার ব্যবহারে হয়ে উঠেছে অসাধারণ। এই কথাটিই কোন অকবি লেখকের ভাষায় হয়ে উঠতে পারত অতি সাধারণ।

মানুষ যা সহজে জানে, তা গভীরে নিয়ে ঘোলাটে করার মাধ্যমেও ভাবনার যোগান সৃষ্টি করা হয়েছে বইটিতে। রবীন্দ্রনাথের শক্তিশালী কবিত্বের প্রকাশ রয়েছে বইটিতে, কিন্তু তত্ত্ব এককভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ নয়। গল্প হিসেবেও এটি অসাধারণ নয়। অনিশ্চিত সত্যের অবতারণা আছে, পাশাপাশি অহংকারেও বইটি কম কিছু নয়। সেসব অহংকার অমিতের ভাষাতেই প্রকাশ পেয়েছে। সেক্ষেত্রে বইটিতে পুরুষতান্ত্রিকতা রয়েছে বলা যায়।

“ আপন রুচির জন্য আমি পরের রুচির সমর্থনের লোভ করি না।”

কথাটির মধ্যে গাম্ভীর্য বা গভীরতার চেয়ে আভিজাত্যই বেশী, যা সাধারণের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে বেশী পছন্দ করে।  বইটিতে সাদাসিদে কথারও কোনো অভাব নেই, যেসব কথা একজন মোটা দাগের কোনো লেখকও লিখে ফেলবে, সেরকম অনেক কথাই সেরা কবির হাতে  বিশেষ রূপ লাবন্য পেয়েছে। আবার ব্যক্তিজীবনের অনেক জটিলতার সহজ সমাধানও আছে।

যেমন, “ ভালবাসার ট্রাজেডি ঘটে সেখানেই যেখানে পরস্পরকে স্বতন্ত্র জেনে মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি।” কথাটি চোখ বুঝে ভাববার মতো কথা অবশ্যই। তবে কথাটি সমাজবিচ্ছিন্ন কোনো সত্যের অবতারণা নয়, ‘প্রত্যেক মানুষই আলাদা’ সামাজিক সে কথাটিই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কাব্যিক হয়েছে।

এরকম অনেক কথা আছে, “ জগতে প্রজাপতি আর কিছুর চেয়ে যে কম সত্য তাতো নয়”। এখানে সহজ কথাটিকে কঠিন করার মধ্যেই এর মাহাত্ম, বক্তব্যের মধ্যে নয়।

নিজস্ব এবং পারিবারীক জীবন-যাপনের যে আভিজাত্য কবির ছিল, সে ছোঁয়া থেকেও বইটি মুক্ত নয়। “ঐশ্বর্য দিয়েই ঐশ্বর্য দাবী করতে হয়, আর অভাব দিয়ে চাই আশীর্বাদ।” বক্তব্যটি সত্য বটে, তবে আধুনিক সভ্যতার চাহিদা নিশ্চয়ই এটি নয়।

এছাড়া মনে হয়েছে বইটি খেই হারিয়েছে শেষের দিকে গিয়ে। গল্প মেলানোর চেয়ে তত্ত্ব মেলানোর ঝোঁক বেশি ছিল বলেই হয়ত এটি হয়েছে।

“তাদের মধ্যে একজন সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরি, আর একজন তোমার অনাদরে গড়া।” এটি পড়তে বা শুনতেই শুধু চমৎকার। কেতকী মিত্তিরকে তিনি যেভাবে চিত্রিত করেছেন তাতে অমিতের সাথে পূনরায় তার মিল অপ্রয়োজনীয়। এতে নারীর অসম্মান হয়েছে বলেও মনে করা যায়।

লাবণ্যর সাথে অমিতের বিচ্ছেদ প্রেমের দ্ব্যার্থবোধকতার চমৎকার চিত্রায়ন বলে মেনে নেওয়াও দু:সাধ্য, বরং এটি একটি অসামাপ্ত প্রেম। কেতকীর সাথে অমিতের যে প্রেম তাও ছিল অসমাপ্ত। এখানে অবশ্য পাঠক কোনো তত্ত্ব-দর্শন খুঁজতে চাইলে পাবে।

অর্থাৎ, প্রেম অসামাপ্ত রাখাই অমিতের মতো চরিত্রের মানুষের বৈশিষ্ট, তবে সে তত্ত্বও বেশীক্ষণ টিকবে না, যখন ঐ অমিতই আবার কেতকীর সাথে ঘর বাঁধতে যাবে। দেখা যায়, শেষ পর্যন্ত অমিতের প্রেম কোনো সমীকরণেই পড়ল না। অমিত শুধু একজন পুরুষ হয়েই থাকল।

প্রবৃত্তি প্রেম ছদ্মবেশে আসক্তিতে পরিণত হওয়ার আগেই কেতকীর সাথে অমিতের বিয়ে হয়ে গেল, আবার প্রেম-প্রবৃত্তি-ভালোবাসা এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমানা পেরোনোর আগেই লাবণ্যের সাথে সম্পর্কের সমাপ্তি হল । মূলত, অমিতের স্থুলতা আড়াল করা হয়েছে বইটিতে।

“মোর লাগি করিয়ো না শোক –
আমার রয়েছে কর্ম আমার রয়েছে বিশ্বলোক।”

তাই যদি হয়, তাহলে আবার কেতকীর সাথে বিয়ে কেন? তাহলে রবীন্দ্রনাথ কি কেতকীকে শুধু যৌনতার প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন?

বইটি পড়ে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ তার কবিতার মতো কথা গ্রন্থিত করেছেন, কোনো কাহিনী রচনা করতে চাননি। বিভিন্ন ফুল দিয়ে কোনো দক্ষ মালাকার মালা গাঁথলে যেমন একটি অনিন্দ্য সুন্দর মালা হয়, তেমনি কবি রবীন্দ্রনাথ চমৎকার ভাষাশৈলিতে রচিত কিছু লাইন একত্রিত করে যে বই রচনা করেছেন তার নাম দিয়েছেন ‘শেষের কবিতা’। অবশ্যই এটি একটি ভীন্নধর্মী রচনা, মনে হয় পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। সুবিচার করলে বলতে হয়, শেষের কবিতায় কোনো সফল প্রেম চিত্রিত হয়নি, আবার সুস্পষ্ট কোনো দ্বান্দ্বিকতাও নেই। অস্পষ্টতা এবং কাব্যিকতাই কি তাহলে বইটির সবচেয়ে বড় সম্বল নয়?

রবীন্দ্রনাথ মূলত দেখিয়েছেন উভয়ে উচ্চতর হলে প্রেম উঁচু হয়, তবে সংসার হয় না। চমৎকার প্রেম বিনিময়ে সম্পর্ক শুরু হলে বিচ্ছেদের সম্ভাবনাই বেশী, মানে আত্মিক যোগাযোগে যে প্রেম শুরু হয়েছে বিচ্ছেদে তা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আধ্যাত্মিকতা সবসময় আবছায়া, অনিশ্চিত, তা মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়, “বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না …” কথাটির তাৎপর্য আছে এখানে। তবে যা কাছে টানে না তাকে বড় প্রেম কেন বলতে হবে, তা-ও অবশ্য বোধগম্য নয়।

“না পেলেই ভাল, পেলেই তা মন্দ” ভালো-মন্দের এমন ভেদরেখা মানুষের প্রতি অবিচারই আসলে। প্রেমে সততা না থাক, সত্যবাদী হলে তা কাঙ্খিত না হলেও চরম এবং পরম, ন্যায্যও। ভাববাদ দিয়ে যে প্রেম শুরু, তা চাঁদের মতো সুন্দর, তবে আলোটুকু তার নিজের নয়। ভাব ফুরালেই সে প্রেমও ফুরায়।

একটি কথা খুবই প্রচলিত, প্রেমের বিয়ে স্থায়ী হয় না। একথা সত্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ, সাধারণত বেশীরভাগ প্রেম শুরুতে ভাবের ঘোরে হোক আর যে কারণেই হোক ভালোবাসাকেই সম্বল ভাবে। অবশেষে যখন নিজের মাঝে দেখে প্রেমের অন্তরালে সদা সাজা পাচ্ছে পরম সত্য এবং আরো বেশি পার্থিব আরেকজন, তখন না যায় নিজেকে মানা, না যায় সঙ্গীকে। ভালোবাসা অপার্থিব এবং চিরন্তন ভেবে যে ভুল, সে ভুলই অবশেষে বিচ্ছেদে গড়ায় সংশোধনের জন্য। তবে তাতে ভালবাসাটুকু ঠিকই বেঁচে থাকে। হয়ত বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এ বিচ্ছেদ। লাবণ্যর সাথে অমিতের প্রেমের ব্যাখ্যা এরকমই হয়।

বিবাহের মাধ্যমে যে প্রেম, তা শুরুতেই পার্থিব সত্য মেনে নেয়, ফলে এখানে যত পূজা সব সাজানো, দেনা পাওনা বুঝে নেওয়া সহজ হয়, নিয়মিত বলে সংশয়ও কম, তাই শুধু কাঠামো দিয়েও তা টিকে থাকে।