পরীমনি কি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো টার্গেট, নাকি শুধু নাসির মাহমুদের? // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

মাস্তানদের একটা স্ট্রাটেজি আছে— তারা একটা সফট্ টার্গেট খুঁজে সবার সামনে সজোরে একটা থাপ্পড় মারে, যাতে অন্যরা ভয়ে সিধে হয়ে যায়। আবার অনেক সময় বসকে খুশি করতেও এরা হাত চালায়। ক্রিমিনাল টাইপের মাস্তান যারা, তারা আসলে মাস্তানি করে সুখে শান্তিতে থাকতে চায়, তারা বখে যেতে চায় না। মাস্তানিটা তাদের আয় উপার্জনের হাতিয়ার, ফলে তাদের স্ট্রাটেজি আর বখে যায় মাস্তানদের স্ট্রাটেজি এক নয়।

বর্তমান সরকার অনেকদিন ধরে ক্ষমতায় থাকায় তাদের সাথে বখে যাওয়া মাস্তান যেমন আছে, এখন তার চেয়ে বেশি আছে ক্রিমিনাল মাস্তান। এরা করে খেতে চায়। এরা গোল্লায় যেতে চায় না। ফলে সংকটে পড়লে এরা মাথা খাটায়। মাথা খাটিয়ে বুদ্ধি বের করে— চমক লাগা সব বুদ্ধি বের করে। আপন জুয়েলার্সের মালিক, বা একজন নাসির উদ্দিন মাহমুদ এদেশে কতটা শক্তিশালী তা আপনি ঐ তল্লাটে না মিশলে বুঝতে পারবেন না। 

কাজে লাগুক বা না লাগুক ব্যবসায়ীরা কারণে অকারণে পুলিশ এবং সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে পোষে। কাজে যে কখনও না কখনও লাগবে এটা তারা ভালো করেই জানে। ধরুণ, আপনাকে কেউ অগ্রীম এক লক্ষ টাকা দিয়ে গেল, আপনার কোনো বিপদের দিনে দিলো, আপনি তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন না? তাকে আপনার ভালো লাগবে না? কোনোদিন আপনি বিদেশ যাননি, সেই আপনাকে যদি কেউ সব খরচ বহন করে বিদেশ ঘুরিয়ে নিয়ে আসে, আপনার ভালো লাগবে না? তাকে ‘বাপ বাপ’ মনে হবে না? আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহ অনেক পেশার মানুষের এরকম ভিরমি খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, আছে না?

সরকার পরীমনিকে টার্গেট করেছে, এটা ভাবা এক্ষেত্রে সঙ্গত নয়। আমরা অনেক সময় ভাবি যে, এ ধরনের কোনো ঘটনা যখন ঘটে তখন বোধহয় কেন্দ্রীয় সরকার সবকিছু জেনে বসে থাকে। আসলে তা নয়। একজন এসপি বা ডিসি-ও অনেক সিদ্ধান্ত নেয়। একজন পুলিশ মহাপরিদর্শকও ভীষণ শক্তিশালী একজন মানুষ, ফলে একজন পরীমনিকে গ্রেফতার করতে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ লাগে না।

পুলিশ চাইলে যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। একটু যারা বিলাস বহুল জীবনযাপন করে, তাদের গ্রেফতার করা কঠিন কিছু নয়— পিছে লেগে থাকলে অপরাধ একটা না একটা খুঁজে পাওয়াই যায়। আর ইয়াবা পকেটে পুরে দিয়ে গ্রেফতার করার ঘটনাও তো আছে। পরীমনির অপরাধ তার বাসায় মদের বোতল পাওয়া গেছে। মদ খায় না এরকম অনেকের বাসায়ও আপনি মদের বোতল পাবেন। আমি ছোটবেলায় যে বোতলটায় কেরোসিন তেল কিনতাম সেটিও একটি মদের বোতলই ছিল। মদের বোতলগুলো দেখতে সুন্দর, শক্তপোক্ত, তাই এগুলো অনেকে সংগ্রহ করে। পরীমনি মদ খায় না সেকথা আমি বলছি না। বলছি কারও বাসায় মদের বোতল পাওয়া গেলে সেটি কিছু প্রমাণ করে না। আর মদ খেলেই যদি কাউকে গ্রেফতার করতে হয়, তাহলে পরীমনির আগে দেশ থেকে কয়েক হাজার গ্রেফতার করে নেওয়া দরকার পড়ে।

অতএব, এটা স্পষ্ট যে পরীমনি কারও না কারও রোষানলের শিকার। কে হতে পারে সেই ব্যক্তি? কিছুদিন আগে পরীমনি গুলসান বোটক্লাবে একটা ঝামেলায় জড়িয়েছিলেন, যেটি আমরা সবাই জানি। পরীমনি বোটক্লাবের পরিচালক নাসির মাহমুদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ এনেছিলেন।  যে ঘটনার কোনো সুরুহা এখনও হয়নি। তবে নায়িকা পরীমনির মামলায় ঢাকা বোট ক্লাবের বিনোদন সম্পাদক ও ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদসহ পাঁচ জনকে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। সেদিন (১৪ জুন) দুপুরে তাদের গ্রেপ্তারের আগে সাভার থানায় ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন পরীমনি।

উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের একটি বাসা থেকে তাদের গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। নাসির উদ্দিন ও অমি ছাড়া গ্রেফতার অন্য তিন নারী হলেন, লিপি আক্তার (১৮), সুমি আক্তার (১৯) ও নাজমা আমিন স্নিগ্ধা (২৪)। জামিনে বেরিয়ে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে নাসির বলেন, বড় রকমের ভিকটিম হলাম। কোনো দিন হাজত দেখিনি। রিমান্ডে ১২ দিনসহ ১৮ দিন জেল-হাজতে কাটিয়েছি। সত্যিকারে অন্যায় করলে আফসোস ছিল না। আশা করি তদন্তকারী সংস্থা সঠিক বিষয়টি তুলে আনবে। একজন সেলিব্রিটির অভিনয়ে আমি সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলাম।

পরীমনি
নায়িকা পরীমনি ও ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ

৮ জুন রাতে পরীমনি গুলসান বোট ক্লাবে গেলে হত্যা ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হন। রোববার প্রথমে তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে ঘটনার বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চান। রাতে তিনি তার গুলশানের বাসায় অভিযোগের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি অভিযোগ করেন, প্রধান অভিযুক্ত ব্যবসায়ী নাসির নিজেকে আইজিপি বেনজীর আহমেদের বন্ধু পরিচয় দেন। ঘটনার পর ভোররাতে তিনি বনানী থানায় অভিযোগ করতে গেলেও থানা মামলা নেয়নি। পরে তিনি বেনজির আহমেদের কাছে বার বার অভিযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা জানান,” এধরনের কোনো অভিযোগ নিয়ে কেউ আইজিপি মহোদয়ের সাথে যোগাযোগ করেননি।” বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া ডয়চে ভেলের কাছে ঘটনার পর পরীমনির অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে তিনি দাবি করেন,” পরীমনি তখন মদ্যপ ছিলেন। অসুস্থ ছিলেন আরকি। সে কারণে অভিযোগ না নিয়ে হাসপাতলে পাঠিয়ে দেই। অসুস্থ কারুর কাছ থেকে আমরা অভিযোগ নিতে পারি না।”

১৩ জুন নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাসে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে পরীমনি লেখেন, ‘বরাবর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি পরীমনি। এই দেশের একজন বাধ্যগত নাগরিক। আমার পেশা চলচ্চিত্র। আমি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমাকে রেপ এবং হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।’

‘এই বিচার কই চাইবো আমি? কোথায় চাইবো? কে করবে সঠিক বিচার? আমি খুঁজে পাইনি চার দিন ধরে। থানা থেকে শুরু করে আমাদের চলচ্চিত্র বন্ধু বেনজীর আহমেদ আইজিপি স্যার! আমি কাউকে পাই না মা। যাদের পেয়েছি সবাই শুধু ঘটনার বিস্তারিত জেনে, দেখছি বলে চুপ হয়ে যায়!’

পরীমণি আরও লেখেন, ‘আমি মেয়ে, আমি নায়িকা, তার আগে আমি মানুষ। আমি চুপ করে থাকতে পারি না। আজ আমার সাথে যা হয়েছে তা যদি আমি কেবল মেয়ে বলে, লোকে কী বলবে এই গিলানো বাক্য মেনে নিয়ে চুপ হয়ে যাই, তাহলে অনেকের মতো (যাদের অনেক নাম এক্ষুণি মনে পড়ে গেল) তাদের মতো আমিও কেবল তাদের দল ভারী করতে চলেছি হয়তো। আফসোস ছাড়া কারোর কি করার থাকবে তখন! আমি তাদের মতো চুপ কি করে থাকতে পারি মা? আমি তো আপনাকে দেখিনি চুপ থেকে কোনো অন্যায় মেনে নিতে!’

‘আমার মা যখন মারা যান তখন আমার বয়স আড়াই বছর। এতদিনে কখনো আমার এক মুহূর্ত মাকে খুব দরকার এখন, মনে হয়নি এটা। আজ মনে হচ্ছে, ভীষণ রকম মনে হচ্ছে মাকে দরকার, একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরার জন্য দরকার। আমার আপনাকে দরকার মা। আমার এখন বেঁচে থাকার জন্য আপনাকে দরকার মা। মা আমি বাচঁতে চাই। আমাকে বাঁচিয়ে নাও মা।’

এ ছাড়াও পরীমনি সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘৯ জুন (২০২১) রাত ১২টায় আমাকে বিরুলিয়ায় নাছির ইউ. মাহমুদের কাছে নিয়ে যায় অমি। সেসময় নাছির ইউ. মাহমুদ নিজেকে ঢাকা বোট ক্লাবের সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন। সেখানে নাছির ইউ. মাহমুদ আমাকে মদ খেতে অফার করেন। আমি রাজি না হলে আমাকে জোর করে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে আমাকে চড়-থাপ্পড় মারেন। তারপর আমাকে নির্যাতন ও হত্যার চেষ্টা করেন। অমিও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’

এরপর গত ৫ আগস্ট (২০২১) বাসায় মদ রাখার অভিযোগে পরীমনিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। যদিও পরীমনির মদ পানের লাইসেন্স রয়েছে বলে যাচ্ছে। তবে সেটির মেয়াদ না থাকায় অপরাধ আমলে নিয়েছে পুলিশ। এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সহ বিভিন্ন মাধ্যমে সাধারণ জনগণ বলছে যে, পরীমনি প্রভাবশালী নাসির মাহমুদের রোষানলের শিকার। অনেকে বলছে নাসির মাহমুদ পুলিশ প্রধানের বন্ধু, এজন্য এক সময়ের ঠিকাদার এবং বর্তমানে ব্যবসায়ী নাসির সহজেই পুলিশকে দিয়ে পরীমনিকে গ্রেফতার করিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাইছেন। গ্রেফতারের মুখে পরীমনি স্বভাবসুলভ পোশাকে যেভাবে লাইভ করেছেন, তাতে অনেকে তার প্রশংসা করে বলেছেন পরীমনি মাথায় হিজাব টেনে ভন্ডামি করেননি, যেমন তিনি তেমনই থেকেছেন। চলচ্চিত্রাঙ্গনের গুণী শিল্পীরা বলছেন ঘটনা যাইহোক না কেন এটা চলচ্চিত্রাঙ্গনের জন্য মারাত্মক হুমকি।

Next Post

পড়তে পারেন শেষের কবিতা: বইটির আসলে কোনো শুরু নেই, শেষও নেই!

বিবাহের মাধ্যমে যে প্রেম, তা শুরুতেই পার্থিব সত্য মেনে নেয়, ফলে এখানে যত পূজা সব সাজানো, দেনা পাওনা বুঝে নেওয়া সহজ হয়, নিয়মিত বলে সংশয়ও কম, তাই শুধু কাঠামো দিয়েও তা টিকে থাকে। বইটি যত গোলমেলে মনে হয় আসলে বইটিতে অত গণ্ডগোল কিছু নেই। অমিতের কথার কৌলিন্য, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ […]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর