Headlines

মেয়ে তুমি তোমার মতো হও: পেশা ও ব্যক্তিজীবনে সাফল্যের পথরেখা // হাসিন জাহান

হাসিন জাহান

আর্থিকভাবে দরিদ্র দেশের মানুষ হওয়াতেই কিনা জানি না— আমাদের একটা ভুল ধারণা আছে, আমরা মনে করি জীবনের সংগ্রাম মানেই অর্থনৈতিক সংগ্রাম। এজন্যই সফল মানুষ বলতে আমরা বুঝি তাদের যেসব মানুষ ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা জয় করে একটা বিশেষ জায়গায় পৌঁছুতে পেরেছেন। হাসিন জাহানের বইটা পড়ে আপনি বুঝতে পারবেন যে, অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের বাইরেও মানুষের জীবনে অনেক ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, এবং পরিবারে একটু স্বচ্ছলতা থাকলে তখন ভেঙ্গে পড়া বা গা এলিয়ে দেওয়াটাই বরং স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়। তবে লেখক এখানে ব্যতিক্রম, তিনি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন এবং সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্যে একইসাথে নিজেকে আরো বেশি শাণিত করেছেন। বইটি পড়ে পাঠকের মনে হবে একটি মেয়ে, এবং একইসাথে একজন মা কীভাবে ধাপে ধাপে তার পথ তৈরি করে চলেছেন। যদিও বিষয়টি এ বইটিতে অন্তর্নীহিত। অবশ্য আমি লেখকের প্রথম বইটিও পড়ায় আমার পক্ষে এ বিশ্লেষণ খানিকটা সহজ হয়েছে।  

তাই বলে লেখক অমিতভাবে নিজেকে প্রকাশ করেননি, এক্ষেত্রে তিনি খুবই পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি নিজের কথা কিছুটা আনলেও দ্রুতই শেষ করেছেন। এ কারণে পাঠকের দিক থেকে লেখককে আরো ভালোভাবে জানার আগ্রহটুকু জারি রয়েছে। বইটি প্রধনত অনুপ্রেরণামূলক, ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষা, একইসাথে নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ছোট্ট তরিকা। লেখক কোথাও বলেননি যে, তুমি আমার মতো হও, কারণ, কেউ কারো মতো হওয়া যায় না। লেখক বইটিতে বলতে চেয়েছেন— যেকোনো পরিস্থিতিতে তুমি তোমার পথটি তৈরি করো, পিছপা হইও না। তবে কোনো পথই অবধারিত নয়, কোনো পথ থেকে তুমি ছিটকে পড়লে সবকিছু শেষ ভেবে নিও না, আবার কোনো নতুন পথের সন্ধান করো— মোদ্দা কথা থেমে যেও না। 

বইটির নাম পড়ে মনে হতে পারে যে, বইটি হয়ত শুধু মেয়েদের জন্য। প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বইটি সকল পাঠকের জন্য, তবে মেয়েদের জন্য বাড়তি কিছু বিষয় আছে, যেখান থেকে ছেলেদেরও শেখার আছে। আমাদের সমাজে পারিবারিক এবং সামাজিক কারণে মেয়েরা যে পিছিয়ে ছিল এবং এখনো অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে— এ সত্যটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সন্তানের মা হতে গিয়ে একজন নারীর ওপর যে শারীরিক এবং মানসিক চাপ তৈরি হয় তার সাথে কর্মক্ষেত্র এবং পারিবারিক জীবনের সমন্বয় করে কীভাবে পথ চলতে হবে তার একটি শর্টকার্ট দিকনির্দেশনা হাসিন জাহানের এ বইটিতে রয়েছে। বইটার শুরুর দিকে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “কিন্তু জীবনে সামনে আগানোর জন্য ‘আর্ট অব সারভাইভাল’ জানা খুব জরুরী। আমরা মেয়ে। আমাদের অনেককে সারাজীবনই পরিবারে ও কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলতে হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, বিচিত্র পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে হয়। কোনো পরিস্থিতিতেই আমি যেন শুধু বার বার পিছন ফিরে না তাকাই, থেমে না থাকি। কারণ যে-কোনো পরিস্থিতিতেই আমাকে শক্তভাবে টিকে থাকতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এটাই হচ্ছে আর্ট অব সারভাইভাল।” কথাগুলো মেয়েদের প্রসঙ্গে হলেও বস্তুত তা সবার জন্য।

এরপর লেখক নিজের উদাহরণ টেনে বলেছেন, “আমার জীবনটা খুবই সংগ্রামমুখর। একটু ভিন্ন ধরনের। আগেই বলেছি সতেরো বছর বয়সে আমার প্রথম বিয়ে হয়। আঠারো বছর বয়সে আমি মা হই, পুত্র সন্তানের। উনিশ বছর বয়সে আমার ডিভোর্স হয়ে যায়। আমি বুয়েট জীবনের পুরো পড়াশুনাটাই করি শিশু সন্তান নিয়ে। একদিকে পড়াশুনার প্রচণ্ড চাপ, তীব্র প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে সামাজিক বিড়ম্বনা! কোনোটারই কমতি ছিল না। আমাকে খুব কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। কারণ আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে একজন সিঙ্গেল মা হিসেবে যখন আমি বাচ্চাটিকে বড় করেছি , তখন সমাজ আমার প্রতি এত উদার ছিল না। যথেষ্ট প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে পড়াশুনা করেছি এবং ভালো ফলাফলও করেছি।”

উপরের এই অভিজ্ঞতাটুকু লেখকের ব্যক্তিগত হলেও তার সমষ্টিক গুরুত্ব অনেক বেশি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের নারীদের বিয়ের গড় বয়স ১৬.৯ বছর। এসব কিশোরীর শতকরা ৫৯ ভাগ বিয়ের পর পরই মা হয়ে পড়েন। রিপোর্টের অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৬৬ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। এবং এদের বেশিরভাগই এক ধরনের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য এবং ভঙ্গুর পারবারিক জীবনযাপন করে। যদিও সরকারি জরিপ বলছে ২০১৫ সালে দেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ছিল ১৮ দশমিক ৪ বছর। ২০১৯-এ এসে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৫বছর। এখন সেটা প্রায় ১৯ বছরের কাছাকাছি। আমরা যদি সরকারি জরিপকেও সঠিক ধরে নিই সেক্ষেত্রেও লেখক যে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও নিজেকে সফলতার চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যেতে পেরেছেন সেটি একটি উদাহরণ অবশ্যই।

লেখক বইটিতে প্রধানত মেয়েদের ক্যারিয়ার গড়ার দিকে মনোযোগী হতে বলেছেন। একজন ব্যক্তির, একজন নারীর, একজন মায়ের স্বাবলম্বী হওয়াটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি তিনি নানানভাবে বলতে চেয়েছেন। তিনি চ্যাপ্টার বাই চ্যাপ্টার বলেছেন— ক্যরিয়ার গড়তে হলে শেখা এবং আত্মোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। এবং দরকার পর্যাপ্ত নেটওয়ার্কিং, যে জায়গাটিতে নানান কারণে পুরুষের তুলনায় নারীরা পিছিয়ে থাকে।

লেখক বলেছেন, অনেক সময় নারীরা নিজেকে উপস্থাপন করতে কুণ্ঠা বোধ করে, এটিও তাদের পিছিয়ে থাকার একটি অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে হাসিন জাহানের পরামর্শ হচ্ছে— “শুরু করুন নিজের অফিসের গ্রুপ মিটিং বা স্টাফ মিটিং থেকে। নিজের কাজ সুপারভাইজর ও সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার সুবিধা-অসুবিধাগুলো তুলে ধরুণ। আস্তে আস্তে আপনার কাজ, আপনার কনফিডেন্স অন্যদের নজরে পড়বে। আজে থেকেই শুরু করুন। 

তিনি কর্মক্ষেত্রে অনেক ধরনের আচরণের কথা বলেছেন। আমরা অনেক সময় ভাবি— আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলে বোধহয় আমি ছোট হয়ে গেলাম। অনেক সময়ই আমরা এক ধরনের খোলসবন্দী হয়ে থাকতে পছন্দ করি। লেখক বলেছেন, “মনে রাখবেন, আপনাকেই স্বত:স্ফুর্তভাবে কথা বলতে এগিয়ে যেতে হবে। অন্যপক্ষ এগিয়ে এসে আপনার সাথে যেচে কথা বলবে, সেজন্য অপেক্ষা করবেন না।” আমার তো তাইই মনে হয়— যে আগে হাতটা বাড়ালো সে-ই বরং এগিয়ে গেলো।

কাজের প্রায়োরিটি নির্ধারণ, নিজের জন্য সময় বের করা, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট অনেকগুলো বিষয় তিনি বিশ্লেষণ করেছেন— তবে খুব ছোট্ট পরিসরে। বিষয়গুলো তিনি শতভাগ বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে বইয়ের ভাষায় বিশ্লেষণ করেননি, বরং বিষয়ের সাথে নিজের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে বিষয়গুলোকে তিনি সকলের জন্য পাঠোপযোগী করেছেন। স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য তিনি বিভিন্ন উপায়ের সাথে এটিও বলেছেন যে, না লুকিয়ে নিজের বাস্তব অবস্থা প্রকাশ করে ফেললেই বরং স্ট্রেস কমে। কারণ, কোনো না কোনোভাবে বাস্তব অবস্থা প্রকাশিত আসলে হয়ই। লেখক বলছেন, “আমি একটা সময় কোনো অনুষ্ঠানে যাবার আগে মারাত্মক অস্বস্তিতে ভুগতাম। যাব কি যাব না, এ নিয়ে অন্তদ্বন্দ্বে ভুগতাম। একটা পর্যায়ে এসে ভেবে বের করি কেন আমি এ স্ট্রেস অুনভব করি? কারণ, কেউ যখন আমাকে আমার স্বামী সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন, তখন আমি কী উত্তর দেব। যখন এই দুর্ভাবনার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর তৈরি করলাম আমি। নিজেকে প্রস্তত করলাম আমার এই স্ট্রেসকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসে তা মোকাবেলা করার। এখন দেখেন, কত সহজে আমি নিজেকে প্রকাশ করতে পারছি।”

লেখক এখানে একটি বিষয়ে উদাহরণ টেনেছেন। আসলে খুব গোপনীয় না হলে বাস্তব বিষয়গুলো ফেস করলেই বরং স্ট্রেস কমে। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোই অবশ্যই স্বযত্নে গোপন রাখতে পারতে হবে— সেকথাও লেখক এক জায়গায় বলেছেন। ডিজিটাল এ দুনিয়ায় ব্যক্তিগত কোনো বিষয় ব্যক্তিগত রাখাটাও একটা বিশেষ দক্ষতা বটে।

সন্তানকে সময় দেওয়া, অহেতুক উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা না বাড়ানো, বয়সভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ— এরকম অনেক বিষয় লেখক বইটিতে লিখেছেন। এমনকি খাদ্যাভাসের দিকটিতেও তিনি আলোকপাত করেছেন। “আপনাদের দৈনন্দিন খাবার তালিকা থেকে ভাত, রুটি, চিনি ও আলু বাদ দিন। প্রতিদিনের তালিকায় দুধ, ডিম, টকদই, ফল ইত্যাদি রাখবেন।” আমাদের বাঙালিদের যে চিরচারিত একথালা-ভাত-নির্ভর খাদ্যাভ্যাস সুস্থ থাকার জন্য সেখানে থেকে যে বেরিয়ে আসা দরকার সেটি লেখক বলেছেন, বিশেষ করে মেয়েদের এবং মায়েদের কথা তিনি বললেও এটি আসলে সকলের জন্য প্রযোজ্য।

ছোটখাট বিষয়গুলো অভারলুক করে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ফোকাস করা যায় সেকথাও লেখক গুছিয়ে বলেছেন। নিজেকে আপডেট রাখার কথা বলেছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকে ব্যাকডেটেড হয়ে যায়, অথচ সময়ের সাথে সাথে এগোলে সেটি কিন্তু হওয়ার কথা নয়। মূলত পড়াশুনা এবং শেখার অভ্যাস থামিয়ে দেওয়ার কারণেই এটি হয়। এ কারণেই লেখক হাসিন জাহান লিখেছেন, “এ বয়সে এসেও আপনার দরকার নিজেকে যুগোপযোগী রাখা। নতুনদের সাথে টেকনোলজি নিয়ে, থিমেটিক বিষয়ের ভাবনা নিয়ে দূরত্ব তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। সেজন্য নিজেকে যুগোপযোগী রাখার জন্য নতুন বিষয় নিয়ে জানা দরকার, পড়াশুনা করা এবং প্রয়োজনে নতুন স্কিল শেখাও দরকার।”

যদিও লেখক খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন, তারপরেও ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বিষয়টা অনেকের কাছে কঠিন লাগতে পারে। লেখকের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায়— ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স হলো আপনার নিজের আবেগ বোঝা, ব্যবহার এবং পরিচালনা করার ক্ষমতা। ইতিবাচক উপায়ে চাপ উপশম করতে, কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে, অন্যদের সাথে সহানুভূতিশীল হতে, চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে এবং দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য উপায় নির্ধারণ করার দক্ষতা। লেখক আত্মসচেতন হতে বলেছেন, নিজের ভালো এবং মন্দ দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা এবং মন্দ দিকগুলো কীভাবে দূর করা যায় তা ক্রমাগতভাবে শেখা।

পোশাক পরিচ্ছদ, অন্যের প্রতি দরদী হওয়া, শেয়ারিং কেয়ারিং, কর্মক্ষেত্রে নবাগতদের প্রতি দায়িত্ব, টিম ওয়ার্ক, লিডারশিপ ইত্যাদি অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে প্রতি লেখক আলোকপাত করেছেন আপন শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার বিনিময়ে যা প্রতিটি পেশাদার মানুষের জন্য কাজে লাগবে এবং নিজের মতো করে বিষয়গুলো লালন করতে পারলে পেশাগত উৎকর্ষ বাড়বে বলে মনে করি।

মোটকথা জীবন এবং কাজের প্রতি ইতিবাচক থাকা, নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া, নতুন পথ, নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা, লেগে থাকা, নতুন কিছু শিখতে পিছপা না হওয়া, অন্যের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা এবং বোঝার চেষ্টা করা, পরনিন্দা এবং পরচর্চা না করে সকলের প্রতি সহমর্মী থাকা এবং দিনশেষে নিজের কর্মজীবনের পাশাপাশি সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা— একজন্য নগন্য পাঠক হিসেবে এভাবেই আমি বইটিকে পড়েছি এবং বুঝেছি।


রিভিউ লিখেছেন দিব্যেন্দু দ্বীপ

Hasin Jahan
বইটির লেখক। কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটার এইড।