গ্রামভিত্তিক ছোট ছোট শহরই (টাউন) হতে পারে আগামী বিশ্বের আধুনিক জীবনব্যবস্থা // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

সারসংক্ষেপ

আমেরিকান সরকারের জনগণনা বলছে, সে দেশের চার ভাগের তিনভাগ লোক এমন সব ছোট ছোট শহরে বাস করে যেখানে ৫০০০-এরও কম লোক বাস করে। এর মধ্যে এমন অনেক ছোট ছোট শহর রয়েছে যেখানে ৫০০-এরও কম লোক বাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলনীয় না হলেও বাংলাদেশের গ্রামগুলিও আজকাল শহরের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করছে— এই অর্থে যে কয়েকটা গ্রামের মোড়ে এমনভাবে একটি বাজার এবং পণ্যসামগ্রির প্রদর্শনী তৈরি হচ্ছে, যা গ্রামগুলোকে অনেকটা শহরের বৈশিষ্ট দান করছে। গ্রামের ঘরবাড়ী এবং রাস্তাঘাট চলাচল এবং বসবাসপোযোগী হলেই গ্রামগুলি আরো অধিকমাত্রায় টাউনের বৈশিষ্ট লাভ করতে পারে। এর ফলে উৎপাদিত পণ্যের যোগান এবং প্রদর্শনী সহজতর হতে পারে। একইসাথে এর একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে— গ্রামগুলোতে সহজেই এমন সব শহুরে পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে যেগুলো অপ্রয়োজনীয় এবং গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে বেমানান। গ্রামের দরিদ্র মানুষ এসব পণ্যের নাগাল পেতে দিশেহারা হচ্ছে, অনেকক্ষেত্রে তারা এগুলো কিনতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছে। যেমন, কয়েকটি গ্রামের মোড়ে একটি ফ্রিজের দোকান থাকার অর্থ ফ্রিজের প্রতি গ্রামের সকল মানুষের আকর্ষণ তৈরি হবে। অনেকে কিস্তিতে ফ্রিজ কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। দেখা যাবে কিস্তি হয়ত শোধ হয়ে পারেনি, কিন্তু ইতোমধ্যে তার ফ্রিজটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আবার ফ্রিজের রাখার মতো তেমন কিছু গ্রামের দরিদ্র মানুষের ঘরে থাকেও না। ফলে একইসাথে তাদের আকর্ষণ তৈরি হয় কোল্ড ড্রিঙ্কস্ এবং আইসক্রিম ইত্যাদির মতো পণ্যের প্রতি, যা তাদের আরো দরিদ্র করে তোলে। অর্থাৎ গ্রাম সংলগ্ন ছোট বা শহরতলী গড়ে ওঠার অর্থ একটি বাজার তৈরি হওয়া, যে বাজারটি দ্বিমুখী চরিত্রের অধিকারী— বাজারটি গ্রামের উৎপাদিত পণ্য যেমন বড় শহরগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে, একইসাথে শহরে উৎপাদিত অপ্রয়োজনীয় পণ্য গ্রামে নিয়ে আসছে। ফলে গ্রামগুলোতে যদি একটি নৈতিক স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে না থাকে, এবং তাদের গ্রাম সংলগ্ন বাজার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গ্রামের স্বার্থ সমুন্নত রাখার মতো জ্ঞান এবং ক্ষমতা হাতে না থাকে তাহলে গ্রামের এ ধরনের শহুরে চরিত্র গ্রামগুলোকে সবল করার পরিবর্তে বরং আরও দুর্বল করবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে দায়বদ্ধ এবং দায়িত্বশীল করা অত্যন্ত জরুরী।

মূল শব্দগুচ্ছ: গ্রাম ভিত্তিক ছোট ছোট শহর, গ্রামীণ অর্থনীতি, অপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনুপ্রবেশ

ভূমিকা
আমার এই নিবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের সমাজ, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তোলা এবং কিছু অনুমান বা হাইপোথিসিস উপস্থাপন করা। আমি এই নিবন্ধে কোনো ধরনের উপসংহার তুলে ধরার চেষ্টা করব না। বাংলাদেশের গ্রামগুলো গত দশ বছর ধরে যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে পর্যবেক্ষণ থেকে এ উপস্থাপন। ফলে এ লেখা বাংলাদেশের গ্রামগুলোর বর্তমান অবস্থা বুঝতে সহযোগিতা করবে বলে আশা করি। এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বৃহত্তর গবেষণার দ্বার উন্মোচন করবে।

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬৪.৯৬ শতাংশ গ্রামে বসবাস করে। যাদের মধ্যে ৭.৬ শতাংশ মানুষ প্রতি বছর শহরে অভিবাসন করে (২০১৭ বিবিএস)। এর বড় একটি অংশ শহরের সুযোগ সুবিধার ওপর চাপ তৈরি করে, অর্থাৎ বিদ্যমান শহুরে অবকাঠামো এই বাড়তি জনসংখ্যা ধারণ করার সক্ষমতা রাখে না। ফলে সৃষ্টি হয় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, গ্রাম ও শহরের মধ্যে যেন কোনো পার্থক্য না থাকে। জাতির পিতার সে ইচ্ছা এবং পরিকল্পনাকে ভিত্তি ধরে বর্তমান সরকার প্রতিটি গ্রামকে ‘শহরে’ উন্নীত করার কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে ৩.১০ অনুচ্ছেদে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’: প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। উন্নত রাস্তাঘাট, যোগাযোগ, সুপেয় পানি, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ও সুচিকিৎসা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, উন্নত পয়:নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি, কম্পিউটার ও দ্রুত গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সুবিধা, মান সম্পন্ন ভোগ্যপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে আধুনিক শহরের সকল সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ।)
গ্রামে বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে এবং হচ্ছে একথা নি:সন্দেহে বলা যায়, কিন্তু বিপরীতে কীভাবে গ্রামের অর্থনীতি কৃষি শিল্পনির্ভর হয়ে উঠতে পারে, কীভাবে এবং কী আঙ্গিকে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি না করে গ্রামে বিনিয়োগ বাড়ানো যেতে পারে— সেদিক থেকে এখনো কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা সরকারের নেই। উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ডিজিটাল ব্যবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে গ্রামের বেকার যুবকরা কী ধরনের ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হতে পারে, সে বিষয়ে পলিসি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী।
করোনা অতিমারি আসার পরে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, শহর আর কোনোভাবেই বসবাসের জন্য উত্তম স্থান নেই। শহরের কৃত্রিম আয়োজন বসবাসকারীদের সবকিছু হাতের নাগালে এনে দিলেও তাদেরকে নানান ধরনের মৌলিক সংকটে ফেলছে— তার মধ্যে দূষণজনিত স্বাস্থ্য সংকট এবং ভেজালমুক্ত খাবারের নিশ্চয়তা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যতদিন যাচ্ছে শহরে বসে খাদ্যের যোগান পাওয়া ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন একটা সময় সম্ভবত খুব দ্রুতই আসতে যাচ্ছে যখন প্রতিটি মানুষকে তার খাদ্যের যোগান নিয়ে ভাবতে হবে। গ্রামে নি:শর্তভাবে বেগার খাটার লোক দিনকে দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, নতুন প্রজন্মে নি:শর্তভাবে ফসল উৎপাদনে জড়িত হতে আর রাজি নয়, ফলে সরকারকে নতুন কোনো পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে, যাতে গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকে এবং গ্রামের মানুষ জীবীকা, শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য শহরমুখী হয়ে অহেতুক শহরের ওপর চাপ না বাড়ায়।
গ্রামকে যুগোপযোগী এবং আধুনিক সুবিধাযুক্ত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে গ্রামে অপ্রয়োজনীয় পণ্যের নির্বিচার অনুপ্রবেশ। বাজার কখনো একমুখী হয় না, এটা সত্য, কিন্তু লাগামহীনভাবে যদি কোল্ডড্রিংকস্, আইসক্রিম, চিপস্ এবং এ জাতীয় নিম্নমানের পণ্য লাগামহীনভাবে গ্রামে ঢুকতে থাকে তাতে গ্রামের শিশুদের স্বাস্থ্য যেমন ঝুঁকিতে পড়ছে একইসাথে গ্রামের টাকা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে যারা শহরে চাকরি করতে যাচ্ছে তারাও গ্রামে পিতা-মাতাকে রেখে গ্রামে বিনিয়োগ করতে উৎসাহীত হচ্ছে না, কারণ, গ্রামে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখনো অপ্রতুল। গ্রাম থেকে জেলা/উপজেলা শহরের দূরত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আধা ঘণ্টা/এক ঘণ্টার মধ্যে, সেদিক থেকে জেলা/উপজেলা শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যদি ঢেলে সাজানো যায় এবং গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সেবার মানের দিক থেকে আরেকটু উন্নত করা যায়, তাহলে মানুষ গ্রাম থাকতে আরো বেশি উৎসাহিত হবে।

উপরের এ লেখা থেকে যে প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা যেতে পারে:
১. গ্রামের কৃষিব্যবস্থা যুগোপযোগী করতে হবে এবং কৃষিতে প্রয়োজনমাফিক ভর্তুকি দিতে হবে। বহুজাতিক কীটনাশক এবং সার কোম্পানির প্রচারণা নির্ভর প্রতিকারের পরিবর্তে উপজেলা কৃষি অফিশগুলোকে সক্ষম এবং সচল করে কৃষকদের সমস্যা সমাধান করতে হবে।
২. গ্রামের বাজার ব্যবস্থার ওপর প্রশাসনিক নজরদারী বাড়াতে হবে, যাতে অনুমোদনহীন, অপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলো অবাদে গ্রামের দোকানগুলোতে বিক্রয় হতে না পারে।
৩. গ্রামের বেকার যুবকেরা যাতে কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলতে পারে সেজন্য ট্রেনিং এবং ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. গ্রামের জলাধারগুলোকে দখলমুক্ত করতে হবে এবং লবণাক্ত পানির প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
৫. গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। গ্রামের সাথে উপজেলা এবং জেলা সদরের যোগযোগ উন্নত করতে হবে, এবং উপজেলা এবং জেলা সরকারি স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. গ্রামের স্কুলগুলোকে যথাযথ মনিটরিং-এর আওতায় এনে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

৭. শহরের মতো গ্রামেও খামারভিত্তিক বাড়ি নির্মাণের জন্য ঋণ প্রদান করতে হবে।
৮. গ্রামে সমন্বিতভাবে পাঠাগার, সংস্কৃতিকেন্দ্র এবং ব্যয়ামাগার গড়ে তুলে গ্রামবাসীর জন্য স্বাস্থ্যসুরক্ষা এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. এবং সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা করতে হবে।

মোদ্দাকথা শহর নয়, গ্রামই হয়ে উঠতে পারে বসবাসের জন্য উত্তম স্থান— আগামী বিশ্ব হবে গ্রামভিত্তিক বিশ্ব ব্যবস্থা, ছোট ছোট শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর অসাধারণ এক গ্রামভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। প্রত্যাশা— বাংলাদেশ যেন দ্রুতই সে সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

Next Post

এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার বিজয়ের গৌরব গাঁথা

বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র স্যান্যাল একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার রতন কান্দি গ্রামের বীর সন্তান তিনি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণাকারীদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ বিজয়ী হলে বাঙালিরা পাকিস্তানি অবাঙালি শাসনের নিপীড়ণ আর বৈষম্যের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। দেশের […]
রতন কান্দি