আইন করে অনাত্তীকৃত বিদেশী শব্দে নাম রাখা বন্ধ করতে হবে

green line

green line


ভাষা অনেকটা স্বয়ংক্রিয় বিজ্ঞান। বিষয়টা এমন- শুধু জন্ম দিলে হয় মানুষ করা লাগে না। ভাষা নিজে নিজেই বিকশিত হয় যদি বাঁধা না দেয়া হয়। এরপর ভাষাটি বড় হতে থাকে বিভিন্নভাবে। ভাষাবিদের কাজ হচ্ছে যা ঘটছে তা সংকলন করা এবং বিশ্লেষণ করা। একটু এদিক ওদিক করা। 

প্রশ্ন হচ্ছে, জন্ম দেয়ার বিষয়টি তাহলে কেমন? শব্দ (সাউন্ড) থেকে শব্দ (ওয়ার্ড), এটা নিশ্চয়ই। মানুষের প্রকাশের তীব্র আকাঙক্ষা থেকেই ভাষার উদ্ভব, এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। কীভাবে এত এত শব্দ একটি ভাষায় আসে? কোনো ভাষাবিদ চিন্তাভাবনা করে লিখে দেন এগুলো? না, তা নিশ্চয়ই করেন না। তাহলে?

আচ্ছা পৃথিবীতে কত ধরনের ‘নাম’ প্রয়োজন হয় একবার ভাবুন তো! মানুষের নাম, জিনিসপত্রের নাম, গাছের নাম, রাস্তার নাম, বাসের নাম ইত্যাদি কত কিছুর নামের প্রয়োজন হয়, তাই না?

মানুষ আসলে যা করে–নাম রাখে। কীভাবে নাম রাখে–পরিচিত শব্দ আওড়াতে আওড়াতে আরেকটি শব্দ সৃষ্টি করে নাম রাখে। দুটি শব্দের দুটি অংশ যুক্ত হয়েও একটি নতুন শব্দ তৈরি হতে পারে। অসংখ্যা উপায়ে শব্দ সৃষ্টি হয়, সম্ভবত ভাষাবিদরা তার নাগাল পাবেন না, কারণ, এটা একেবারেই অন্তর্নীহিত বিষয়।

অর্থাৎ জন্ম দেয়া মানে হচ্ছে, নাম রাখা। একসময় বিশেষ্য পদটি প্রয়োজনে আপনি আপনিই বিশেষণ এবং ক্রিয়ায় রুপান্তর হয়ে যায়। এরপর ভাষাবিদরা সেগুলো সংকলন করে পরিশীলিত করার চেষ্টা করেন। প্রত্যয়, উপসর্গ ইত্যাদি খুঁজে বের করেন।
বিষয় হচ্ছে, আপনি প্রয়োজনীয় নামগুলো নিজ ভাষা দিয়ে রাখার চেষ্টা না করে অন্য ভাষার শব্দ দিয়ে রাখলে আপনার ভাষার উৎকর্ষ সাধান কীভাবে হবে?

বলা হয়েছে, ভাষাবিদরা ভাষার বিশ্লেষণ এবং কিছুটা পরিশীলন করতে পারেন, একটি ভাষাকে বিকশিত করতে পারেন না। এটা গণমানুষকে করতে হয়। ভাষা হচ্ছে গণমানুষের হাতে অবচেতনে সৃষ্ট বিজ্ঞান।

যখন কেউ নিজ ভাষায় নতুন শব্দে কিছুর নাম রাখে–এর মানে হচ্ছে সে ভাষাটিকে বিকশিত করল। এই শব্দটি আরও অনেক নতুন শব্দের জন্ম দেবে। নদী থেকে নদী হবে। এই নতুনত্ব সবার হাতে যে হয় তাও নয়, একটু সৃষ্টিশীল মানুষেরাই আনকমন কিছু করতে চায়, নামের ক্ষেত্রেও আনকমন রাখতে চায়। তবে ভাষা আসলে সব মানুষের হাতেই বিকশিত হয়, বিষয়টিকে প্রাকৃতিক বলা যায় তাই।

বারে বারে একই নাম রাখলে তো ভাষাটি বড় হলো না। ইংরেজি ডিকশনারিতে প্রতিবছর পৃষ্ঠা বাড়ে, আমাদের অভিধান সেই একই জায়গায় আছে, বরং পৃষ্ঠা কমানোর প্রয়োজন এখন, কারণ, অনেক শব্দই আর ব্যবহৃত হয় না।

একবার ভাবুন তো, দেশের ১৬ কোটি মানুষের নাম যদি ১৬ কোটি বাংলা শব্দে হতো, তাহলে কেমন হতো! আমাদের ভাষায় কি ১৬ কোটি শব্দ আছে? কোনোভাষাতেই তা নেই, তাই এতটা আশা করার সুযোগ নেই। কিন্তু ১ কোটি তো হতে পারত। তাতেও কিন্তু প্রতি ১৬ জনের একই নাম হতো। তাও কি হয়েছে? হয়নি। নামগুলো রাখা হয়েছে বেশিরভাগ আরবি বা অন্য অনেক ভাষার শব্দে। এবং সম্ভবত একই নামে গড়ে হাজার খানেক মানুষ পাওয়া যাবে, বা তারও বেশি।

সবসময় নতুন নাম রাখতে হবে–বিষয়টি এমনও নয়, বরং নামটি বাংলা শব্দে রাখতে হবে। তাহলে সাধারণ মানুষও ভাষাটি ভালোভাবে জানবে, অনেক শব্দ জানবে এবং সেগুলো ব্যবহার করবে। ফলে পরিবেশটাও শ্রুতিমধুর হবে। আমাদের চারপাশের মানুষেরা বাংলা শব্দগুলোও কি ঠিকমত জানে? জানে না। পড়াশুনা করে ভাষা শেখার সুযোগ কম। ব্যবহারের মাধ্যমেই ভাষা শিক্ষা হয়। ব্যবহারের সুযোগটি তৈরি রাখতে হবে।

শুধু মানুষের নাম তো নয়, অন্য অনেক কিছুর নাম–সকল কিছুর নাম যথাসম্ভব সৃজনশীলভাবে এবং বাংলা শব্দে রাখার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাভাষাটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত পৃথিবীতে। পৃথিবীতে ৩০ কোটি লোকের একটি ভাষা এরকম দৈনদশায় থাকাটা মানা যায় না। যেহেত দেশ হিসেবে শুধু বাংলাদেশই একমাত্র বাংলাভাষাভাষী দেশ, তাই দায়িত্বটা আমাদেরকেই নিতে হবে।

বাসের নাম ‘টিআর ট্রাভেল’, ‘ন্যাশনাল ট্রাভেল’, ‘গ্রিন লাইন’, ‘জাবালে নূর’, ‘নূর-ই-মক্কা’ রাখা যাবে না। সাংস্কৃতিকভাবে এই জাগরণটি ঘটাতে না পারলে, আইন করে এভাবে নাম রাখা বন্ধ করতে হবে। বাসের নাম দিয়ে উদাহরণ দিলাম। সবক্ষেত্রেই তো এরকম।
সম্ভবত জার্মানিতে মানুষের নামও যেকোনো শব্দে রাখা যায় না। আমাদের দেশে নাম নিয়ে এরকম একটি আইন খুবই প্রয়োজন, কারণ, নাম রাখার মধ্য দিয়ে ভাষাবিজ্ঞান অগ্রসর হয়, একটি ভাষা বিকশিত হয়।


দিব্যেন্দু দ্বীপ