২০০৫ সালে ফ্রান্সের ট্যুর শহরে গিয়েছিলাম XXV IUSSP International Population Conference-এ প্রবন্ধ পড়তে। এই কনফেরেন্সের বিশেষত্ব হলো সারা পৃথিবীর একাডেমিকরাই নন শুধু পলিসি মেকার, বেশ কয়েকটি দেশের মন্ত্রী, এমনকি কয়েকটি দেশের প্রধানমন্ত্রী/প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত যোগ দিয়েছেন। এডিনবরা থেকে মোট ৬জন যোগ দিয়েছিলাম এই কনফারেন্সে। আমরা দুজন প্রফেসরের গাড়িতে ডোভার থেকে ফেরি পার হয়ে কালাই গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ট্যুর শহর। কনফারেন্স শেষে দক্ষিণ ফ্রান্স চষে বেরিয়েছি মোট ২১ দিনে। আমরা সবচেয়ে খুশি হয়েছিলাম নিস শহরে। তখন জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ, আর আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহ। উজ্জ্বল দিন, নীল আকাশ আর কড়া রোদ। সেই রোদে সমূদ্রের পাড়ে রোদ পোহানো আর সামুদ্রিক মাছ খাওয়া, হল্লা করা। জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়ের কিছু আটকে আছে সেই নিস শহরে। আমি যেসব জায়গায় ফের একবারের জন্য হলেও যেতে চাই, তার মধ্যে নিস অবশ্যই প্রথম দু’একটির মধ্যে। এতো উদার, সুন্দর, মালিন্যহীন শহর আমি খুব বেশি দেখিনি।
সেই শহরে মানুষ খুন করা হয়েছে। ৮৪ জন। কিংবা আরো বেশি। উৎসবের ফায়ারওয়র্কের মধ্যে। না, নিস শহয়ের ফায়ারওয়র্ক আমি দেখিনি। কিন্তু কনফারেন্সের পর ট্যুর শহরের মেয়র সংবর্ধনা দিয়েছিলেন কনফারেন্সে আগত সবাইকে। সেখানে ফায়ারওয়ার্কের সাথে যে ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের সমন্বয় ছিলো, খোলা আকাশের নীচে, সেখানে তরুণ-তরুণীদের নাচ গভীর রাত পর্যন্ত- মনে হয়েছিলো মানুষ মানুষের জন্য এমন জড়তাহীন সৌন্দর্যও তৈরি করতে পারে! ভেবে আপ্লুত হয়েছিলাম, মানুষই পারে। সেই স্মৃতিতে ফিরতে আমার এক মূহুর্ত লাগে না। ধারণা করি, বাস্তিল দিবসের ফায়ারওয়র্ক তেমনই কিছু, কিংবা আরো সুন্দর, সমূদ্রের পাড়ে, রাতের বেলা। এবং এখন জুলাই মাস।
সেই সৌন্দর্য গ্রাস করেছে খুনী মন, খুনী অস্ত্র। অন্তরে ঘৃণা নিয়ে নিরীহ মানুষদের জীবন আর উৎসবকে খুন করেছে। আমি ভীষণ আহত।
আমি আহত, কারণ:
উৎসবে আসা মানুষদের খুন করা হয়েছে;
নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে খুন করা হয়েছে;
মানুষকে ক্রমাগত নির্মম দুঃস্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে;
মৃত্যু আমাদের পেছনে ধাওয়া করছে, যার শেষ কোথায়, কেউ জানে না;
কিন্তু, তারচেয়েও বেশি আহত বোধ করছি কিছু ফেসবুক নোট দেখে। তাঁদের কেউ কেউ আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত, বন্ধু। অনেক দিন-রাত-চিন্তা-অবসর একসাথে শেয়ার করেছি। এক প্ল্যাটফর্মে কাজ করেছি। তাঁদেরই কেউ কেউ লিখছেন, এটি না কি খুব উত্তম কাজ হয়েছে। আমেরিকা-ইউরোপ এতোদিন অন্যদের কাঁদিয়েছে, এখন তারা কাঁদুক।
আমি স্তম্ভিত। এ কোন (কু)রাজনৈতিক মতবাদে আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে আমাদের মুখ? সুসময়-দুঃসময় একসাথে পার করা বন্ধুদের মুখ আর আমার মুখ কি আলাদা? আমি কি বাহবা দিচ্ছি এইসব নিরীহ মানুষের হত্যায়!
আজ মনে হয়, ক্রমাগত অপরিচিত হতে থাকা এইসব বন্ধুর সাথে আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের সময় হয়েছে। মতাদর্শিক বিচ্ছেদ শুরু হয়েছে অনেক আগেই যদিও। খুনী মতবাদ ধারণ করা আর খুনের মধ্যে তফাত সামান্যই। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে খুনী মতবাদ ধারণকারী খুনী হতেই পারেন।
নিরীহ মানুষকে হত্যার কথা যে মোড়কেই সাজানো থাক, সেই কথা হত্যারই কথা। অন্তত দশজন শিশু খুন হয়েছে। প্যালেস্টাইনের সেই শিশু মেয়েটি, যার নাম দিয়েছিলাম ‘সূর্যপাখি’, যে বাঁচেনি বলে বহুদিন ঘুমাতে পারিনি, সেই একই বেদনা অনুভব করি যে শিশুরা খুন হয়েছে আজ নিস শহরে। এই দুয়ের মধ্যে ভেদ যারা করেন, তারা আমার বন্ধু নন।
ঘৃণা সমাধান না। নিরীহ মানুষ খুন করাও সমাধান না। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রস্তুত না হয়ে এই ভয়ের পৃথিবীকে মোকাবেলা করা যাবে না। আমরা কেবল খুন দেখতে থাকবো আর পৃথিবীর যেখানেই যাই, আমাদের পেছনে তাড়া করবে খুনের আতঙ্ক। সেই পৃথিবী কার কাছে কাঙ্ক্ষিত? ঘৃণা- পালটা ঘৃণাটা সহজ। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পৃথিবীকে প্রস্তুত করার কাজে নিজের পরিসরে হলেও নিয়োজিত থাকাটা কঠিন। আমার যেসব বন্ধু নিরীহ মানুষকে হত্যার পরে খুনীদের পক্ষে ঘৃণা ছড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছেন, তাঁদের সাথে আপাত বিচ্ছেদ ঠেকানো গেলো না।
আশা করি, পৃথিবীর সকল খুনী শক্তিকে পরাস্ত করার যে লড়াই সামনের দিনগুলোতে, যতো ছোট পরিসরেই হোক, সেই লড়াইয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যা্লয়ের শিক্ষক অধ্যাপক কাবেরী গায়েন এর ফেসবুক থেকে