ধর্ম আমদানী করে দুবৃত্তের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, এখন দিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা …

নোয়াখিালি

টা নিয়ে সবসময় বিতর্ক আছে যে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ধর্ম ঢুকানো হয়েছিল মানব মুক্তির জন্য, নাকি দুবৃত্তের দখলের হাতিয়ার হিসেবে। মানব সভ্যতায় ধর্মের সংযোজন নৈতিক বোধের গঠনমূলক রূপক হিসেবে, কিন্তু কালক্রমে সেটি নৈতিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে হয়ে যায় কর্তৃত্বপরায়ণ মানুষের শাসন ও শোষণের হাতিয়ার।

এর চেয়ে বড় কথা— সেই হাতিয়ারটা যখন একটি বিভ্রান্তিমূলক ছাতায় পরিণত হয় তখন তার নিচে আশ্রয় নিতে শুরু করে দুবৃত্তরা, ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা আসতে আসতে ধর্মের নৈতিক দিকটি আর প্রায়োগিক এবং প্রাসঙ্গিক থাকে না, হয়ে যায় দখলদারের হাতিয়ার। ধর্মের নামে ছড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকমূলক, মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সত্তা সৃষ্টির বিভিন্ন উপাদান।

সেই বাস্তবতা মাথায় রেখেই উন্নত দেশগুলোতে ধর্ম ধীরে ধীরে ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উৎসব ব্যতীত ধর্মের সেসব দেশে আর কোনো রাষ্ট্রীয় ভিত্তি নেই। আমাদের দেশে তেমনটি নয়, এখানে এখনও ধর্ম প্রবল, পরাক্রমশালী; এবং মানবিকতা এবং মর্যাদায় উন্নত দেশগুলো শত বৎসর আগে যেসব কারণে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে ধর্ম বাদ দিয়েছে আমাদের দেশে এখনও সেসব কারণ নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে।

মূলত এ কারণেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছিল— সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে ধর্ম সরিয়ে ফেলা, আলাদা করা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি লক্ষ্য, যাতে ধর্মটা কেউ বাজেভাবে ব্যবহার করতে না পারে, যাতে সমাজে এবং রাষ্ট্রে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আধিপত্য সৃষ্টি না হয়।

সমস্যা হচ্ছে, পৃথিবীতে এটা আগেও হয়েছে যে, যে কাঁটা দিয়ে আপনি কাঁটা তুলছেন সেই নতুন কাঁটাটি ঢুকে গিয়েছে আবার। এজন্য বাট্রান্ড রাসেল যেকোনো আদর্শকেই বিপদজনক বলেছেন, কারণ, যেকোনো আদর্শ দ্রুতই নতুন ধর্মে পরিণত হয়, এক সময় সেটি আর মানুষের জন্য থাকে না, হয়ে যায় কতিপয়ের হাতিয়ার, দুবৃত্তের হাতিয়ার।

মার্কসবাদ ব্যর্থ হওয়ার একটি বড় কারণও তাই বলে মনে করেন অনেক পণ্ডিত, আমাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও’ সেই একই ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে এখন, কারণ, ইতোমধ্যে তা বিভিন্ন ধরনের দুবৃত্তায়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

নোয়াখালির সুবর্ণচরে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সেটিই একমাত্র ঘটনা নয়, তবে একটি ভয়ঙ্করতম ঘটনা। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ১৯৭১ সালে ঘটিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা, এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছিল ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে।

সেই একই ধরনের কোনো ঘটনা যখন ২০১৯ সালে আবার ঘটে, এবং সেটি যদি ঘটে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক’ নৌকায় ভোট না দেওয়ার বিষয়টিকে সামনে এনে, তাহলে যেকোনো আদর্শবাদ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মীয় চর্চা যেমন ক্ষতিকর, তেমনি যেকোনো আদর্শবাদের প্রবল চর্চাই ক্ষতিকর, সে বিষয়টিই আবার সামনে এসেছে। 

সমাজ এবং রাষ্ট্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আইনের শাসন, সর্বাগ্রে প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা, প্রয়োজন মানিবকতাবোধের জাগরণ। পরিবার থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাস্তাঘাটে, রেলস্টেশনে সর্বত্র যদি মানবিক জাগরণমূলক শব্দ-বাক্য ব্যবহার না করে ভীতি উদ্রেককারী, পরকালমুখী, স্তুতিমূলক শব্দ-বাক্য সারাক্ষণ ব্যবহার করা হয় তাহলে নৈতিক বা মানবিক কোনো ধরনের বোধের জাগরণ ঘটবে না, হচ্ছেও না। মানুষ হয়ে থাকছে কুপমণ্ডুক, মানুষ থেকে যাচ্ছে আদীম, মানুষ থেকে যাচ্ছে যেমন পশু তেমন পশুই।

এসব ধর্মীয় আদর্শবাদ পারেনি মানুষকে টেনে তুলতে, পারছে না অন্য কোনো একক আদর্শবাদও। এটা প্রমাণিত যে, মানুষকে তার আপন পাহারায় রাখতে পারলেই সে সবচে’ বেশি নৈতিক এবং মানবিক হয়। আপন পাহারা মানে মানবিকতাবোধের জাগরণ, বিবেকবোধের জাগরণ। নিয়মিত পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে পরার্থপরতা, দয়া, মায়া, মূল্যবোধের চর্চা এবং সে ধরনের চর্চামূলক শব্দ-বাক্যের ব্যবহার ব্যতীত সে কাজটি কখনই হবে না।