Headlines

পচনশীল পণ্যের বাজারজাতকরণ এবং বিপণন সমস্যা

Jackfruit

বাসার সবাই কাঁঠাল পছন্দ করে, আমিও। কিন্তু সে কাঁঠালের কোষ হতে হবে হলুদ এবং রসালো, তেমন না হলে আবার কেউ খায় না। কাঁঠাল খাওয়ার সবচেয়ে বড় অুসবিধা হচ্ছে সেটি বইয়ে আনা, তার চেয়ে বড় অসুবিধা কাঁঠালটা ভেঙ্গে খাওয়ার উপযোগী করে প্লেটে রাখা, এরচেয়েও বড় অসুবিধা— কাঁঠালের কোষের মধ্যে পলিথিনের মতো একটা আবরণ থাকে, ফলে দুই হাতে দিয়ে ঠিকমতো ওঠা ছাড়ানো লাগে, ঐটাসহ খাইলে পেটে ব্যথা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, ফলে কাঁঠাল খাওয়ার ঢংটা শেষমেষ আর খুব একটা ভদ্রস্থ থাকে না।
এজন্য মূলত কাঁঠাল একটা পারিবারিক খাদ্য, সাহেদদের মতো বা কমপক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ভালো’ ঐ ডিজির মতো অতিথীদের আপ্যায়নের অনুষঙ্গ হওয়ার ভাগ্য কাঁঠালোর কপালে জোটে না, তাতে কোষ যতই সে হলদু এবং রসালো হোক না কেন।

কাঁঠাল চৈতন্যভাবের প্রেমিক প্রেমিকার খাদ্য, কাঁঠাল নব দম্পতির খাদ্য, কাঁঠাল কৃষকের খাদ্য; মন্ত্রীর নয়, আমার সুদিনের প্রিয়তমারও নয়।

সে যাইহোক, বিপদ যেটা হচ্ছে— কাঁঠাল যেটাই কিনি খাওয়ার উপযোগী হয় না। এরপর শুরু করলাম ভাইঙ্গে কেনা। মানে কাঁঠালটার কপাল একটু চিরে দেখা, ভালো হইলে নিব না হইলে নিব না। কিন্তু এ কাজে আমার মন আবার সায় দেয় না, ছোটবেলা থেকে শিরদাঁড়া শক্ত রাখতে রাখতে একটুও নতজানু হতে হয় এমন কোনো কাজে আমার মন আর সায় দেয় না।
তারপরও কাঁঠাল আমার ভালো চাই-ই চাই। স্বস্তায় মা-ও খুশি বউও খুশি, এ সুযোগ হাতছাড়া করবে কেউ? কালকে এক ভ্যানালারে সকালে হাঁটতে বের হয়ে ধরলাম, ও তখন আকাশ থেকে পড়ার ভাণ করে বলে, বলেন কী মামা! আপনারে আমি খারাপ দিতে পারি? যেন আমি তার সম্মুন্ধি, কোনোভাবেই আমাকে সে খারাপ দিতে পারে না! এবার সে সিরাজের ফেলে যাওয়া হেরেমখানা থেকে মীরজাফরের নারী বাঁচাই করার মতো কাঁঠাল একটা ধরে, সেইটার বুকে পিঠে কয়েকটা থাবা দেয়, আবার রেখে দেয়।
বললাম, মামা, তোমাদের এই রঙ্গ আমি জানি, কারণ, আমি আসলে তোমাদেরই লোক। অতএব, রঙ তামাসা থামিয়ে কাঁঠাল এইটা ভাঙ্গো। ঠিকই এইটা ভালো হলো, স্বর্গের কল্পিত অপ্সরার মতো হলুদ না হলেও আমার প্রিয় নায়িকা কেট উইন্সলেটের মতো হয়েছে, টাইটানিকে যেমনটা দেখেছেন।
ঐটারে বোগলডাবা করার আগে ওকে টাকা দিতে গেলে ও অবাক হয়ে গেল! বলে, মামা, আপনি টাকা দিবেন তাতো বুঝি নাই, আমি তো ভাবছি— আপনি একটা খারাপ হইছে বলে আরেকটা নিতে এসেছেন। খুব একটা প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, তাই বললাম, করোনার সময় বলে মাপ করে দিলাম তোমারে।
আসলে বিষয় তা না। বিষয় হচ্ছে, আপনাকে গভীরে যেতে হবে। কাঁঠালের মতো একটা পচনশীল ভারী পণ্যের ব্যবসা কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিৎ, আর কীভাবে হচ্ছে —তা আপনাকে বুঝতে হবে। কাঁঠাল মূলত একটা স্থানীয় পণ্য, এটাকে স্থানান্তর করে খাওয়া বেশ কঠিন কাজ, যদি না মিয়ানমারের মতো শুকিয়ে চিপস্ তৈরি করা যায়।
সমস্যাটা কোথায় হয় বুঝতে হলে আপনাকে একটু দিনদুনিয়া বুঝতে হবে, আমার মতো এতটা গণমুখী হওয়ার দরকার নেই, তবে কিছুটা আগ্রহ থাকা লাগবে।
কাঁঠাল তো আর বসুন্ধরা সিটির আটতলায় ফলে না, এটা হয় গাছে। গাছ কোথায় থাকে? যেহেতু গাছ থাকে বাগানে, তাই প্রথমে এটা বাগান থেকে, বড় বড় গাছে উঠে পাড়তে হয়। কিন্তু গাছের সব কয়টা কাঁঠাল তো একবারে হয় নাই, এক দুই মাস আগেপরেও হয়। এখন, সবগুলো কাঁঠাল একবারে পাড়লে তা কি একবারে পাকবে, বা সবকয়টা আদৌ পাকবে?
পাকবে না, সব কয়টা খাওয়ার যোগ্য হবে না। আবার খুব ছাপোষা বিক্রেতা না হলে সে একটা দুটো করে পেড়ে পেড়ে স্থানীয় বা একটু দূরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রী করে বাজার করার তাগিদ অুনভব করবে না, সব কাঁঠাল গাছ ধরে সে একবারে বিক্রী করে দিবে। ব্যপারি কি দুই তিনবারে এই কাঁঠাল পাড়বে? না, সে ঝামেলায় সে যাবে না, সে গাছের সব কাঁঠাল একবারে পাড়বে। ব্যাপারি কাঁঠাল পেড়ে ‍নিয়ে দিবে মজুদদারের কাছে, স্থানীয় মজুদদার এক দিনের মধ্যে ওগুলো বড় শহরে চালান করে দিবে শহুরে আড়ৎদারের কাছে। একদিনের মধ্যে যেগুলো পেকেছিল, ঐটা সে রেখে দিয়েছে, কারণ, পাকা কাঁঠাল ট্রাকের ধাক্কায় ভালো থাকবে না।
শহরের মজুদদার এক ট্রাক কাঁঠাল হাতে পাওয়ার সাথে সাথে চিন্তা করবে কত দ্রুত এগুলো হাতছাড়া করা যায়, পঁচে যাওয়ার ভয় আছে, সময় মতো বিক্রী না হওয়ারও ভয় আছে। তাহলে তাকে সব কাঁঠাল রাতারাতি পাকাতে হবে। কারণ, শুটকো কাঁঠাল খুচরো বিক্রেতারা কিনতে চায় না, কারণ, কাস্টমার এটা কেনে না।
[এক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার, চকচকে একটা গাছ পাকা কাঁঠাল আপনার সাত তলায় পৌছে যাওয়ার বাস্তবতা আমাদের নেই, এটা বুঝতে হবে। একটু শুটকো সাটকা খাইতে হবে, যদি পাকিয়ে এবং বিষমুক্তভাবে খাইতে চান।]
পাড়ার পর একটা কাঁঠাল সাত দিনে পাকলেও সেটি খেতে খুব খারাপ হবে না। কিন্তু আড়ৎদার এই ঝুঁকি নেবে না, এবং তার এই মানসিকতার জন্য মূলত আমরাই দায়ী, কারণ, বোট শুকানো দেখলে সেইটা আর আমরা কিনতে চাই না।
এবার সে শিক মারবে। তুতে গুলে তাতে শিক চুপাবে আর ইয়াহিয়ার বাহিনীর মতো তা কাঁঠালের বোটার পাশ দিয়ে বুকে ঢুকিয়ে দেবে। এতে সবগুলো কাঁঠাল উপর থেকে একটু নরম হবে, শুনেছি আরও কী জানো একটা কেমিক্যাল আছে, যা দিলে উপরের আবরণটা নরম হয়ে যায়।
যে খুচরো বিক্রেতা ওগুলে কিনে নিয়ে আসবে সে তো আর বুঝমান একজন ব্যক্তি নয়, জীবীকার তাগিদে পাগলা কুকুরের মতো হন্যে হওয়া একজন দিশেহারা ‘অশিক্ষিত’ মানুষ মাত্র, যে কয়দিন আগে বিক্রী করেছে কচু, এখন বিক্রী করছে কাঁঠাল, সে না চেনে কচু না চেনে কাঁঠাল, তার কাজ যেকোনো প্রকারে জীবীকা নির্বাহ করা, কোনোমতে কিছু উপার্জন করা।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, পচনশীল পণ্যের বাজারজাতকরণ কীভাবে হবে তার জন্য থাকা চাই সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এবং নীতিমালা, যেটি আমাদের নেই। এই চিন্তাগুলো আমি যেমন করি, তার চেয়ে বেশি তাদের করা দরকার, যারা এই সিস্টেমটা চালায়। প্রশাসক হয়ত আড়তে মোবাইল কোর্ট করে সাজা দিয়ে চলে যায়, অথবা ধমক দিয়ে হাজার দশের টাকা পকেট পুরে নেয় আলাদা কোনো সময়ে। এতে সিস্টেম আরও খারাপ হবে, আড়ৎদার রেগে গিয়ে আরও যাচ্ছেতাই করবে।
বুঝতে হবে, ভাবতে হবে, ভালোবাসতে হবে। কাঁঠালের আড়ৎদারকে লুঙ্গিপরা আড়ৎদার বলে তাচ্ছিল্ল করা খুব সহজ, কিন্তু তার কাজের গুরুত্বটা বোঝা খুব সহজ নয়।
তাকে সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে, কখনও ঋণ মওকুফও করতে হবে, অন্তত সুদ মওকুফ করতে হবে। উপজেলা কৃষি বিভাগের তদারকিতে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, একটা বাগানের কাঁঠালের হারভেস্ট যেন কমপক্ষে তিন কিস্তিতে হয়, কারণ, কাঁঠাল আমের মতো নয়।
বাগানের মালিকদের সচেতন হতে হবে। উপজেলা কৃষিবিভাগের এলাকাভিত্তিক মাঠকর্মী আছে, যারা মাঠে না গিয়েই টিএ বিল করে, কৃষিকর্মতাও এটি মেনে নেয়, কারণ, সে তো আরও বড় চুরি করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে।
এরপর আড়ৎদারদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা কাঁঠালে শিক না মারে। খুচরা বিক্রেতা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, কারণ, ওরা যা পাবে তাই বিক্রী করবে। শুধু ওদের উপর চাঁদাবাজিটা বন্ধ করতে হবে।
ক্রেতা হিসেবে আমাদের সচেতন হতে হবে, স্বস্তা রূপশ্রী যুবতী বা আরও স্বস্তা চুল পাঙ্কু করা কোনো যুবকের মতো তিড়িং বিড়িং করলে হবে না, একটু ডানে বায়ে তাকাতে হবে।
কাঁঠাল একটা উদাহরণ মাত্র, পচনশীল পণ্যের বিপনণ এবং বাজারজাতকরণ বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট এবং গতিশীল পরিকল্পনা সরকারের থাকতে হবে, এবং মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।


দিব্যেন্দু দ্বীপ

Dibbendu Dwip