ছোটগল্প: মাটি // হাসনা হেনা

follow-upnews
1 0
আকাশ জুড়ে মেঘের দাপাদাপি, গুমোট নিরবতার বুক চীরে ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে মেঘ।গা জ্বালানো গরম পড়েছে।গাছের একটা পাতাও নড়ছে না।মেঘশাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা পরে টুকটুকে লাল সূর্যটা ডুবতে বসেছে। উঠোনে ছড়িয়ে দেয়া লাকড়িগুলো গুছিয়ে ঘরে তুলতে গিয়ে নগেনের শরীর ঘেমে প্যাচপেচে অবস্থা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে সন্ধ্যে।
মেয়ে দু’টোকে তাড়া দেয় লক্ষ্মী—  “আকাশের অবস্থা ভালা না, জলদি জলদি যা মা, দুই বইনে মিইল্লা হাঁস-মুরগীগুলান খোয়াড়ে তোল।”
লক্ষ্মী কুপি জ্বালাতে গিয়ে দ্যাখে কেরোসিন নেই। কখন আকাশ ভেঙে অঝোরে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করবে বলা মুশকিল । দু’চালা টিনের  খুপড়ি ঘর।ওদের ক্ষুদ্র জীবনের অতিবাহিত সময়ের সাক্ষী এ ঘর।ঝড়বৃষ্টি আর রোদের ধকল সহ্য করে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটিতে এক সময় নগেনের ঠাকুরদাদা থাকতেন । তারপর পালাক্রমে নগনের বাবা, নগেন পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। চালের টিনগুলোর এখন শেষ বয়স চলছে, জং ধরে ফুঁটো হয়ে একদম বেহাল অবস্থা । 
একবার ঘরের চালের ফুঁটো টিনগুলো বদলাতে অনেক কষ্টে টাকা জমিয়েছিল নগেন দিদির বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পথে লক্ষ্মী রোড অ্যাক্সিডেন্ট করে মারাত্মক ভাবে আহত হয়। বেশ লম্বা সময় ধরে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল । তখন লক্ষ্মীর পায়ে অপারেশন করাতে নগেনের সঞ্চয় যা ছিল সব শেষ হয়ে যায়। ঘরের পাশ ঘেঁষেই একচিলতে জমি ছিল তার। সে জমিতে দুজন মিলে শাকসবজির চাষ করে পরিবারের চাহিদা অনেকটাই মেটাতে পারতো। সেই এক চিলতে জমিও নগেনের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এখন বসতভিটেটুকু ছাড়া আর কোনো জমি তার নেই। বিপদে পড়ে জমিটুকু পানির দামে বিক্রি করতে হয়েছে। তবে এসব নিয়ে নগেন কখনও আফসোস করে না।লক্ষ্মীকে বাঁচাতে পেরেছে এটাই তার কাছে অনেক বড় পাওয়া।
লক্ষ্মীর অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে নগেনের উপর বাড়তি চাপ পড়েছে। লক্ষ্মী আর আগের মতো নগেনের কাজে সাহায্য করতে পারে না। উল্টো লক্ষ্মীর সব কাজে নগেনের সাহায্য করতে হয়।অভাবের তাড়নায় অবিরত ছুটতে থাকে নগেন। দিশেহারা  দু’চোখ কখনও কখনও ঝাপসা হয়ে আসে। লক্ষ্মীর হাসির নিনাদ মুহূর্তেই প্রাণবন্ত করে দেয় নগেনের পৃথিবী। কোন ক্লান্তি ছুঁতে পারে না তাঁকে।
দু’বছর চলে গেল, শত চেষ্টা করেও আর কোনো টাকা জমাতে পারেনি সে।ঘরটা আর সারানো হয় না। ভবিষ্যতেও হবে কি না কে জানে।তার মাথার উপর এখন চব্বিশ ঘণ্টা ঝুলতে থাকে ঋণের বুঝা।
ভারি বৃষ্টি হলে ছেলে মেয়ে নিয়ে বিছানাপত্র গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। কুপি না থাকলে কোথায় জল পড়ে কী ভিজে যাবে কিচ্ছুটি ঠাহর করা যাবে না। ছোট মেয়েটা আবার ঝড়-বৃষ্টির দিনে আন্ধারে থাকতে ভয় পায়।
ঝোপ ঝাঁড়ের ভেতরে তুমুল বৃষ্টি চেয়ে ব্যাঙ ডাকছে। বৃষ্টি হলে ওরা আনন্দে মেতে উঠবে। প্রকৃতিও গা ভিজিয়ে প্রশান্তির প্রলেপ মাখবে। ঝিঁঝিঁরাও গলা সাঁধতে শুরু করেছে বৃষ্টিভেজা রাত্রিকে স্বাগত জানাতে। কিন্তু আকাশে মেঘ করতে দেখলেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যায় লক্ষ্মীর।
দু’পাশে সুপারি গাছের সারি, মাঝখানে সরু মেঠোপথ। ঘর ফিরতি পাখিদের কলরবে মূখরিত চারপাশ।এই বুঝি টুপ করে নেমে এলো আঁধার। লক্ষ্মী দ্রুত পা চালায়। ক্রাচে ভর করা পা, পথ যেন ফুরাতেই চায় না।গলায় সুতলি দিয়ে বাঁধা ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের বোতল লক্ষ্মীর হাতে।পাশের বাড়ির ফচুর মায়ের কাছ থেকে কেরোসিন ধার করতে যাচ্ছে সে।
 ফচুর মা লক্ষ্মীকে দেখে অবাকস্বরে প্রশ্ন করে—
– বৌদি, তুমি এই ভর সাঁঝে আমাগো বাড়ি!
– আর বইলো না, এই তো তোমার দাদা ভাটি বেলায় হাঁটথন ফিরল। তোমার দাদা যহন হাঁটে গেল তহন আমার একবারটিও মনে হইল না ঘরে কেরোসিন নাই।এহন কুপি জ্বালাইতে গিয়া দেহি কেরোসিনের বোতল খালি। কও দেহি কেমন একটা বিচ্ছিরি কাম অইল।
লক্ষ্মীর এমন অবস্থায় নগেন অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল।থকথকে এক ক্ষত বুকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে কত চোখের জল আর কত মিনতি, তার হিসেব নেই।দিনরাত্রি এক করে নগেন সেবাযত্ম দিয়ে সারিয়ে তুলেছে লক্ষ্মীকে। নগেনের বুকের ক্ষত এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি। লক্ষ্মীকে ক্রাচে ভর করে হাঁটতে দেখলে বড় বেশী কষ্ট হয় নগনের। ক্রাচের প্রতিটি শব্দ নগেনের বুকে তীক্ষ্ণ আঁচড় কাটে।
লক্ষ্মী এবং নগেনের ভালোবাসা মাটির মতই খাঁটি।শত অভাব অনটনেও জানালা দিয়ে পালিয়ে যেতে চায়নি তা কখনও।দু’বছর হলো দূর্ঘটনায় লক্ষ্মী একটা পা হারিয়েছে।নগেনের দিক থেকে বিন্দু মাত্র অবহেলা পায়নি লক্ষ্মী।বরং নগেন এ অবস্থায় আরও বেশী ভালোবাসায় আগলে রেখেছে তাকে।অভাব অনটনের স্রোতধারায় নগেনের ভালোবাসার খড়কুটো আকড়ে ধরে বহাল তবিয়তে ভেসে আছে লক্ষ্মী ।ওদের সংসারে অর্থের অভাব থাকলেও দুচোখ ভরা সরল সুখের স্বপ্ন আছে। ভালোবাসার অদ্ভুত এক বন্ধনে আবদ্ধ নগেন আর লক্ষ্মী। 
সেই যে কিশোরী বেলায় নগেনের হাত ধরে এ ভিটেয় পা রেখেছিলো, সেই থেকেই এ ভিটের সাথে, নগনের সাথে নিজেকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে নিয়েছে সে।নগেনের মগজে বিদ্যে নেই, কিন্তু বুদ্ধিতে কেউ তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। কাদামাটি ছেনে ছেনে সুন্দর সব আকার দেয় নগেন। ওদের কুমার পাড়ায় নগনের হাতের তৈরী মাটির পাত্রের অনেক সুনাম।তার গলায় অদ্ভুত এক সুর আছে।লক্ষ্মী নগেনের গানের সুরকে নাম দিয়েছে মাটির সুর। নগেন গান গাইতে শুরু করলে প্রশান্তির সুবাতাস বয়ে যায় লক্ষ্মীর ছোট্ট পৃথিবী জুড়ে।খুব ভালো গান গায় সে। আর সেই সুরের টানে পাগল হয়েই নগেনের প্রেমে পড়েছিল লক্ষ্মী।কুমারের বেটার কাছ মাইয়া দিমু না বলে লক্ষ্মীর বাপ জেদ করে বসে ছিল। একদিন সাত পাঁচ না ভেবেই বাবা মায়ের অমতে নগেনের হাত ধরে বাপের ঘর ছেড়েছিল সে। 
নগেনের উদয়াস্ত কাটে মাটির সাথে নিবিড় সখ্যতায়। নানা রকম মাটির জিনিস বানিয়ে এক সময় ভালোই আয় হতো। প্লাস্টিকের পাত্র বাজারে আসার পর থেকে মৃৎপাত্রের কদর কমতে শুরু করেছে। প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন বিলীন হতে চলেছে এ শিল্প । আয় কম হলেও বাপদাদার কাছ থেকে শেখা কাজ ছাড়তে পারে না নগেন। নগেন-লক্ষ্মী দু’জনে মিলেই মাটির জিনিস তৈরী করে। মেয়েরাও হাতে হাতে মা বাবাকে সাহায্য করে।
উঠোন ভর্তি ছড়ানো ছিটানো মাটির পাত্র। সন্ধ্যের পর হাওয়া দিয়ে দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি ঝরেছে। মাটির পাত্রে জল জমে আছে। বৃষ্টিধোয়া শীতল বাতাস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে নগেন-লক্ষ্মীর খুপড়ি ঘরের ছোট্ট জানলা দিয়ে। মেয়েরা গভীর ঘুমে। লক্ষ্মীর চোখ জুড়েও রাজ্যের ঘুম। মেঘ সরে গিয়ে প্রকৃতি জুড়ে জ্যোৎস্নার মাখামাখি । নগেন জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় ।ঘরের পেছনে সবচেয়ে উঁচু কলা গাছটার ঠিক মাথার উপর অবাক করা চাঁদ হাসছে।চাঁদটা যেন ফ্যাল ফ্যাল চোখে নগনের দিকেই  তাকিয়ে আছে । নগেন খাটো স্বরে লক্ষ্মীকে ডাকে—
– এই … বউ, দ্যাখো, দ্যাখো, আকাশে কেমন ফকফইক্কা চান্নি উইঠছে। চল বাইরে গিয়্যা চান্নি দেহি । 
লক্ষ্মী আহ্লাদের স্বরে বলে, আমার চোখে রাজ্যের ঘুম। ঢং রাইখা ঘুমাও দেহি, সকালে মেলা কাম আছে । কিন্তু নগেন নাছোড়বান্দা। লক্ষ্মীর এসব কথা মোটেই কানে তুলছে না সে। লক্ষ্মীর হাত ধরে টেনেই যাচ্ছে। একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় উঠে বসে লক্ষ্মী।
আবেগ জড়ানো কণ্ঠে নগেনকে বলে,
– চান্নি দেইখবার যাইবার পারি, কিন্তু আমার একখান শর্ত আছে!
– আইচ্ছা! ক দেহি তোর শর্ত খান কী?
– মেলা দিন হইছে তোমার কণ্ঠে গান হুনি না।তুমি আমারে দাওয়ায় বইস্যা সুন্দর একখান গান হুনাইবা। নগেন শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে লক্ষ্মীর হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে বলে, 
– চল, চল, হুনামোনে!
মাথার উপর অবাক করা চাঁদ ঝুলছে, নগেনের কাঁধের ওপর লক্ষ্মীর মাথা, দু’জন বসে চাঁদ দেখছে।দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে।নগেন লুঙ্গির কুচর থেকে কিছু একটা বের করে বলছে,
– আইজ হাঁট থেইক্যা তোর জন্য একটা জিনিস আনছি।
লক্ষ্মী একগাল হেসে বলে,
– দেহি, দেহি, কী আনছো?
এক ডজন কাঁচের চুড়ি লক্ষ্মীর হাতে দিয়ে নগেন বলে, ইচ্ছেতো করে তোরে সোনা দিয়া মুড়াইয়া রাখি, কিন্তু সে সামর্থ নাই। লক্ষ্মী নগেনের কথার রেশ ধরে বলে, দুঃখ কইরো না, আমি তোমারে পাইয়া খুব সুখে আছি। তোমার ভালোবাসা আমার কাছে পৃথিবীর সব কিছুর থাইকা দামী। আমার সোনা, রূপা, হিরা, মানিক —কিচ্ছু চাই না গো। তুমিই আমার সব। চুড়িগুলো নগেনের হাতে দিয়ে লক্ষ্মী আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– আমারে চুরি পরাইয়া দিবা না?
– নগেন লক্ষ্মীর হাত দুটো নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, হ দিমু ।
স্বামী সন্তানদের খাওয়ানোর পর পাতিল ভাত শূন্য ছিলো। ক্ষিদেয় লক্ষ্মীর পেট টা চো চো করছে, তারপরও লক্ষ্মীর মনে  হচ্ছে তার চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই । হঠাৎ উঁচু গলায় নগেন বলে,  বউ, দ্যাখ, দ্যাখ মাটির পাত্রের জলে ক্যামন সুন্দর চান ঝলমল করতাছে। 
Next Post

অশ্রাব্য গালিগালাজ // দিব্যোন্দু দ্বীপ

কাব্যগ্রন্থঃ অশ্রাব্য গালিগালাজ প্রকাশকালঃ একুশে বইমেলা, ২০১৫ প্রকাশকঃ রতন চন্দ্র পাল প্রকাশনীঃ গ্রন্থকুটির উৎসর্গঃ দুবৃত্তের বিষবৃত্তে বন্দী যারা  সাধারণ মানুষ ওদের যেভাবে থুথু ছিটাচ্ছে, শাপশাপান্ত করছে, বাপবাপান্ত করছে, সে কথাই বলা হয়েছে ‘অশ্রাব্য গালিগালাজ’ কাব্য গ্রন্থটিতে। লুটেরাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ এবং ঘৃণা কী রূপ ধারণ করেছে, তাই-ই বইটির মূলভাব […]
দিব্যেন্দু দ্বীপ