প্রশ্নফাঁস কি আসলেই ক্ষতিকর?

হলের ভেতরে উত্তরপত্রও মিলছে।
হলের ভেতরে উত্তরপত্রও মিলছে।
পরীক্ষার হলেই নাকি মিলছে এরকম উত্তরপত্র। লিখেছেন একজন পরীক্ষার্থী।

হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে বলা যায়, পরীক্ষার আগে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়া অত্যন্ত ক্ষতিকর পরীক্ষার্থীদের জন্য, তাঁর পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, জাতির জন্য। কিন্তু এই দৃশ্যমান প্রশ্নফাঁসের চেয়েও বড় ক্যান্সার যে শিক্ষাব্যবস্থায় ঢুকে গেছে তা হয়ত অনেকেই জানে না!

আগের পরীক্ষাগুলোতেও দেখেছি, আজকেরটাতেও দেখলাম। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে ঢুকে যায় (কেন্দ্রের বাইরে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে এটির কার্যকারিতা রয়েছে)।
যেটা হচ্ছে, এই আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রের কোনো শিক্ষক বা কর্মচারী সবচেয়ে ভালো ছাত্রটির কাছে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র নিয়ে যান। আজব ব্যাপার? পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন কেন? তাহলে কি একজন ছাত্রকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে? না, তেমন কিছু না। তাঁরা খুব সাম্যবাদী এক্ষেত্রে, কারো রাগ করার সুযোগ নেই। কেউ বাইরে গিয়ে বলবেও না একথা। এমন পোয়াবারো হলে কে বলে তা?
প্রশ্নটা ছাত্রটিকে দেয়া হয় সমাধান করার জন্য। ছাত্রটি তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে ৫ মিনিটে প্রশ্নপত্রে সঠিক উত্তরগুলো দাগিয়ে দেয়। সেই মহান শিক্ষক বা কর্মী উত্তরসহ প্রশ্নপত্র নিয়ে চলে যান! প্রশ্ন ফাঁস কিন্তু হয়ে গেল, তাও আবার কেন্দ্রের ভেতরে! এবার আসুন আসল খেলায়। সেই শিক্ষক বা কর্মী উত্তরগুলো নিয়ে প্রত্যেক নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের সেটের সমাধানপত্র তৈরি করেন এবং পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১০/১৫ মিনিট পর প্রতিটি রুমে সেগুলো সরবরাহ করেন।
এই কাজে কিন্তু সেই শিক্ষক বা কর্মচারী একা দায়ী নন, যুক্ত আছেন পুরো কেন্দ্রের প্রতিটি শিক্ষক এবং কর্মী। কেননা, যে শিক্ষকেরা পরীক্ষার হলে গার্ড দিচ্ছেন, তাঁদের সামনেই অবলিলায় নকল সরবরাহ করা হচ্ছে! আমরা কেন্দ্রের বাইরের প্রশ্নফাঁস নিয়ে হাউ-মাউ-খাউ করছি। অথচ কেন্দ্রের ভেতরে আমাদের ন্যায়ের আদর্শ শিক্ষকেরা যে প্রশ্নফাঁস, এমকি উত্তরও ফাঁস করছেন, তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই।
আসলে, অনেকে এই ব্যাপারটা জানেনই না। ছাত্ররা কি নিজেদের এহেন উপকারের কথা মাইকিং করবে? করবে না। পরীক্ষার হলের গার্ডে যারা থাকেন, তাঁরা আসলে খুব মজার লোক! চিৎকার করে বলবেন, “কেউ কথা বলবা না! এতো বলাবলি কীসের? এটা পরীক্ষার হল!” কিন্তু দেখাদেখি করে বা অন্যের খাতা কেড়ে নিয়ে কপি-পেস্টের নমূনা দেখালে তাদের কোনো সমস্যা নেই। অনেক গার্ড তো সোজাসুজি বলেই দেয়, “দেখাদেখি করো। কিন্তু কথা বলো না।” কী মজার ঘটনা, তাই না?
তাঁরা বলেন যে, সবাই ‘সোনা’ পাক, এটাই তাদের কামনা। আহা! এঁদের মতো মানুষই তো দরকার এই জাতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলের জন্য, তাই না? এরূপ চমৎকার পরীক্ষা পদ্ধতির জন্য আমি ও আমার মতো সকলেই ভুক্তভোগী হচ্ছে। কিন্তু কেউ বুঝছে, কেউ বুঝছে না। প্রথম পরীক্ষায় ভালোভাবে পড়ালেখা করে গেলেও, এতো সুন্দর আয়োজন দেখে দ্বিতীয় দিন থেকে বই ধরা হয়নি ভালোভাবে। দুই বছরের পড়ালেখা এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল! পারা জিনিসও নাদেখে লিখতে কষ্ট হয়! চমৎকার না ব্যাপারটা?!
আমরা সরকার, শিক্ষামন্ত্রী, মন্ত্রণালয় কে দোষ দিচ্ছি প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে অকার্যকর হওয়ায়। আরে ভাই, যে জাতির ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকদের মধ্যে ‘সোনা’ পাওয়ার লোভ চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে, সেই জাতির জন্য কেন্দ্রের বাইরে আধাঘণ্টা, এক ঘন্টা আগে প্রশ্নফাঁস না হলেও সমস্যা নাই। তাঁরা কেন্দ্রের ভেতরে ব্যবস্থা করে নিতে জানে এবং পারে।
যে ছাত্র প্রশ্ন পাওয়ার আশায় কেন্দ্রের বাইরে মোবাইল নিয়ে ঘোরাঘুরি করতো, সে আজ জেলে বা পরীক্ষা না দিতে পারায় আত্মহত্যার চিন্তা করছে হয়ত। অথচ বোকা ছেলেটা বুঝতেই পারেনি—কেন্দ্রের ভেতরের বিলাসবহুল ব্যবস্থার কারণে তাঁর এতো জ্বালা পোহানোর দরকারই ছিল না!
সরকার জানে বাইরের খবর। ভেতরের খবর জানলেও কিছু একটা খেয়ে টাল হয়ে ভুলে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট নাকি রোজ একবার করে পরীক্ষার কেন্দ্রে ঢুঁ মারেন। তাহলে তিনি বিষয়টা কীভাবে না জানা হন? নাকি ভাবের কারণে বোধশক্তি থাকে না তাঁদের?
অথবা খানাপিনা ভালো হওয়ায় পেট থাবড়াতে থাবড়াতে ‘দুর্নীতি থাবড়ানোর’ কথা ভুলে যায়। বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি, নকল নিয়ে ধরা পড়ায় শিক্ষকেরা ছাত্রদের বহিস্কার করে দিত। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ধরা খেলে তো লাইফ শেষ!
বাবা-মায়েরা যে কেনো এ যুগে জন্মালেন না? তাহলে তাঁরাও ‘সোনা’ গলায় ঝুলিয়ে তাকধিন তাকধিন নাচ দিতে পারতেন! পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিলিয়ে মুখ ১০০ ওয়াটের বাল্বের চেয়েও উজ্জ্বল করতে পারতেন!
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের মেরুদণ্ড শিক্ষামন্ত্রী বা সরকার যতটা না ভাঙছে, তার চেয়ে বহুগুণ ভেঙে ফেলেছে আমাদের চারপাশের এইসব সচেতন, শিক্ষিত, হিতকামী মানুষেরা—যারা অজ্ঞান হারিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতি ভালোবাসার নমূনা দেখাচ্ছেন! সম্ভবত প্রাইভেট পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের কমিটমেন্ট ছিল, না হলে ক্যামনে কী?

বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল থেকে এবার (২০১৮) এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী একজন ছাত্র।