মানব প্রেমিক বঙ্গবন্ধু ।। অধ্যক্ষ ফারুক আহমেদ

Bangabandhu

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

বাঙ্গালী জাতির কর্ণধার বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান মহান সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব সৃষ্টি, স্রস্টার এক অকৃপণ দান। প্রতিটি জাতির কর্ণধার হিসেবে বিধাতা নির্দিষ্ট একজনকে সৃষ্টি করেছেন। ভারতের মহাত্মা গান্ধী, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত আর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি ক্ষণজন্মা পুরুষ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ। ছোটবেলা থেকেই তিনি মানুষকে মনে-প্রাণে ভালোবাসতেন। তাঁর হৃদয় ছিলো আকাশের মত উদার আর হিমালয় পর্বতের মত বিশাল। আর্তমানবতার বন্ধু এই মহান ব্যক্তির হৃদয়ে কিশোর বয়সেই অসহায়-দুঃখী মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জেগে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর যখন কিশোর বয়স তখন একদিন জানতে পারলেন গ্রামের অনেক লোক অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান পোষ্ট অফিসে জরুরী কাজে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে কিশোর মুজিব অর্থাৎ মা-বাবার খোকা গ্রামের অসহায় গরীব লোকদের নিজেদের বাড়ীতে ডেকে এনে গোলার ধান বিলিয়ে দিয়েছিলেন। পিতা-মাতা ছেলের এই কাজে মনে মনে খুশী হয়েছিলেন। তাদের খোকা এই বয়সে পরপোকারী, জনদরদী হয়েছে দেখে তারা গর্ব অনুভব করলেন। আরও একদিনের একটা বাস্তব ঘটনা না বললে নয়। তখন ছিলো শীতকাল। কিশোর মুজিব একটি পাগল ছেলেকে বিবস্ত্র অবস্থায় দেখতে পেয়ে তাকে নিজের পোষাক খুলে দিয়ে চাঁদর পরে বাড়ীতে এলেন। পিতা লুৎফর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, খোকা তোর কাপড় কি করেছিস। তাদের আদরের সন্তান উত্তর দিলেন, পথে একটা ছেলেকে বিবস্ত্র অবস্থায় শীতে কাঁপতে দেখে খুব খারাপ লাগলো, তাই তাকে আমার কাপড় দিয়ে দিয়েছি। সন্তানের এ মহৎ কাজে পিতা অবাক হয়ে গেলেন। শুধু তাই নয়, স্কুল জীবনে অর্থাৎ কিশোর বয়সে শেখ মুজিবের জন্য প্রতিমাসে অনেকগুলি ছাতা, কয়েক সেট বই এবং ঘনঘন জামা-কাপড় কিনতে হত। কারণ, দূর-দুরান্ত থেকে আগত গরীব অসহায় ছাত্রদের রোদ-বৃষ্টি কষ্ট দেখে নিজের ছাতা দিয়ে দিতেন। যার বই-পুস্তক নেই, গরীবের সন্তান, তাকে নিজের বই দিয়ে দিতেন, কাপড়-চোপড় দিয়ে দিতেন। স্কুল ছুটির পর যখন বাড়ীতে যেতেন তখন তাঁর বেশ কয়েকজন সহপাঠী বা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন এবং দুপুরে তাঁরা একসাথে খাবার খেতেন।
বাল্যকাল থেকে এভাবে শেখ মুজিবের মধ্যে সুন্দর মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটেছিল। উদারতা, মহত্ত্ব এবং গরীব অসহায় মানুষকে আপন করে নেয়ার এক অলৌকিক ক্ষমতা তার মধ্যে ছোটবেলাতেই দেখা যায়। ১৯৪৩ সালের কথা, অবিভক্ত বাংলায় অর্থাৎ পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের ফলে না খেয়ে ৫০ লক্ষ লোক মারা যায়। বাংলার বন্ধু শেখ মুজিবের মন কেঁদে ওঠে। তিনি নিজের লেখাপড়ার ক্ষতি করে দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কলিকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় একটি রিলিফ ক্যাম্প পরিচালনা করেন। তারপর গোপালগঞ্জ ও টুঙ্গীপাড়ায় বসে অভুক্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। তিনি নিজের বাড়ীর গোলার ধান-চাল স্থানীয় লোকদের বিলিয়ে দেন। ফুড কমিটি গঠন ও ধর্মগোলা করে ক্ষুধার্ত মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্য পরিচালনা করেন। গ্রামে গ্রামে নোঙরখানা খুলে মানুষকে খাবার দিতেন। বিরামহীনভাবে নিপীড়িত ও অসহায় মানুষের সেবা করতে গিয়ে শেখ মুজিব অসুস্থ হয়ে পড়েন। লেখাপড়া হচ্ছে না, শুধু রিলিফের কাজে ব্যস্ত। বিপদগ্রস্ত, অভুক্ত মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। তখন তাঁর পিতা বললেন, “বাবা রাজনীতি কর, মানুষের সেবা নিজেকে নিঃশেষ করে দাও, আপত্তি করব না। তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আরেকটা কথা মনে রেখ “Sincerity of purpose & honesty of purpose” থাকলে জীবনে পরাজিত হবে না।’ বঙ্গবন্ধু পিতার এই উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তিনি লেখাপড়াও শিখেছেন এবং এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।
এই মণীষীর জীবনের একট আশ্চর্যজনক ঘটনা আছে। মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার পর প্রতিটি শিশু কেঁদে ওঠে। এটা নাকি প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালার অসীম কুদরতে মা সায়েরা খাতুনের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ট হবার পরে আদরের খোকা শেখ মুজিব নাকি কাঁদেননি। এটা সত্যি সত্যি বিস্ময়ের ঘটনা বাঙ্গালী জাতির পিতা সর্বদা সকলকে হাসিমুখেই বরণ করে নিয়েছিলেন। এ দেশের মানুষের জন্য তিনি নিজের জীবন উৎস্বর্গ করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার অমর সৃষ্টি শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি শোষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। দেশ স্বাধীন হলে তিনি ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে ৩০ লক্ষ শহীদের এবং ২ লক্ষ ধর্ষিত মা-বোনের জন্য আবেগে আপ্লুত হয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু কেঁদেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহান উদার ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বাস ছিল সীমাহীন। তিনি বাঙ্গালীর জন্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাংলার নিপীড়িত, শোষিত, নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তার ভালবাসার যাদুমন্ত্রের দ্বারা সকল শ্রেণীর মানুষেকে তিনি কাছে টানতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মানব প্রেমে দীক্ষিত হয়ে এদেশের কোটি কোটি মানুষ পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তার পাতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে বাংলার আপামর জনগণের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অগাধ প্রেম-ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদ কর্তৃক সর্বোচ্চ সম্মানসূচক পুরস্কার ‘জুলিওকুরি’ পদক পেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ই অক্টোবর ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকীতে বিশ্বশান্তি পরিষদের সভায় বাংলাদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সংগ্রাম তথা বিশ্বশান্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ‘জুলিওকুরী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ শে মে বঙ্গবন্ধুকে পদক প্রদান করেন বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল মি. রমেশ চন্দ। শ্রী রমেশ চন্দ তার উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ববন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষও ভালবাসতেন গভীরভাবে। তাইতো কবি ফারুক আসিফ রচিত ‘জাতির পিতা’ কবিতার ভাষায় বলতে হয় :
“তুমিতো বিশ্ববীর, তুমি আর্ত মানবতার বন্ধু”
তোমার জন্য কাঁদে পদ্মা, গঙ্গা, সিন্ধু।
পদ্মা, গঙ্গা,সিন্ধু নদ-নদী দ্বারা তিনটি দেশের মানুষকে বুঝানো হয়েছে। পদ্মা অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষকে, গঙ্গা অর্থাৎ ভারতের মানুষ আর সিন্ধু দ্বারা পাকিস্তানের মানুষকে বুঝানো হয়েছে।
এই মানব প্রেমিক শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজনীতির কবি ও দার্শনিক। তার প্রতিটি ভাষণ এক একটি গদ্যে রচিত কবিতা। তার দর্শন হচ্ছে মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া। কীভাবে অভাগা জাতি বাঙ্গালীর ভাগ্য পরিবর্তন ঘটানো যায় সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতেন এবং রীতিমত গবেষণা করতেন।
বাঙালী রাজনীতিকদের রাজা বঙ্গবন্ধুর দর্শনের বিষয়বস্তু হচ্ছে কিভাবে, কোন পথে, কিসের দ্বারা মানুষের মঙ্গল করা যায়। অর্থাৎ আশরাফুল মাখ্লুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীবের কল্যাণ সাধনই তার দর্শনের মূল প্রতিবাদ্য বিষয়।
এই মানব দরদী নিজের সন্তানদের চেয়ে বাংলার মানুষকে বেশী ভালবাসতেন। নিজের সন্তানদের আদর-স্নেহ করার সময়-সুযোগ তিনি পেতেন না। হয়তো, এ অভাগা বাঙালী জাতিকে ভালবাসা দিয়ে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁর জন্ম হয়েছিল।
তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান বলে কোন জাতিভেদ তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি সকল ধর্মের মানুষকে সমানভাবে ভালবাসতেন, সুযোগ-সুবিধা দিতেন। পাখি যেমন আকাশের মাঝে অবাধে স্বাধীনভাবে উড়তে পারে তেমনি বঙ্গবন্ধুর হৃদয় আকাশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ বিচরণ করতে পারত। তিনি তাঁর চরম শত্রুকেও কটু কথা বলতেন না। বরং বিপদে পড়লে অর্থ দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। শেখ মুজিবুর রহমানের মা-বাবা উদার মনের মানুষ ছিলেন। সেই পরিবেশে শিশুকাল ও কিশোর জীবন অতিবাহিত করেছেন। এরপর যখন রাজনৈতিক জীবনে পা দিলেন তখন যে রাজনৈতিক গুরু ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনিও উদার প্রকৃতির ছিলেন। তাই ছোটবেলায় মা-বাবার উদারতা, মহত্ব এবং বড় হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদারতার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে তাঁর জীবন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু মহান আল্লাহ তা’য়ালার বিশেষ সৃষ্টি।
বঙ্গবন্ধু শিশুদের আদর-স্নেহ দিতেন, হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। তাই তাঁর জন্মদিন অর্থাৎ ১৭ই মার্চ জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তিনি দেশের মানুষকে যে মনে-প্রাণে ভালবাসতেন তার বাস্তব প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হওয়া স্বত্বেও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তার সবচেয়ে ছোট আদরের শিশুটি শেখ রাসেল রিক্সায় চড়ে স্কুলে যাতায়াত করত। এমনকি তাঁর সন্তানেরা পিতা-মাতার কাছে কোন বড় কিছু দাবী করত না। তিনি নিজের সুখের কথা ভাবতেন না। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের কথাই তিনি ভাবতেন। পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষের জন্ম হয় অন্যের জন্যে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁদেরই একজন। তাই কবির ভাষায় বলতে হয়
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”
কবি কামিনী রায়ের কবিতার এই অংশটুকু বঙ্গবন্ধুর জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। তিনি বাঙ্গালী জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী। তিনি আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। কিন্তু বাঙ্গালী জাতি বড়ই দুর্ভাগা। কারণ, তারা নিজেরাই নিজেদের জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। পরিশেষে মনে পড়ে যায়- ভারতের বিখ্যাত কবি ও লেখক গৌরি শংকর রচিত দুটি লাইন:
“যতোদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরি, যমুনা বহমান,
ততোদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”


লেখক : গবেষক, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন এবং বাংলাদেশের ইতিহাস।