“মানুষের বিবর্তন” গ্রন্থ থেকে তৃতীয় কিস্তি

“মানুষের বিবর্তন” একটি স্বতন্ত্র ধাচের বই। এতে জীবনের পঁচিশটি সমস্যা উপস্থাপিত হয়েছে বিশেষ প্রশ্নোত্তর সন্নিবেশে। প্রতিটি সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে পাঁচটি প্যারার সমন্বয়ে, এভাবে একশো পঁচিশটি প্যারায় বইটি শেষ হয়েছে। এবারের পর্বে রয়েছে জনসংখ্যা, সম্পদ, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা। 

একজন ব্যক্তির যেমন বিচ্ছিন্নভাবে

দায়িত্বহীনভাবে সম্পদশালী থাকা উচিৎ নয়

একটি দেশেরও কি সে সুযোগ আছে?

কয়েকটি দেশ একত্রিত হয়ে কি নিজেদেরকে

অভিজাত ভাবতে পারে, আলাদা ভাবতে পারে?

দেশের স্বাধীনতা শুধু প্রশাসনিক ইউনিট

বিবেচনাতেই মানানসই হয়, তাই বলে

সম্পদ কুক্ষিগত করার অধিকার কি

কোনো দেশের থাকা উচিৎ?

মোজাম্বিকের মানুষ না খেয়ে মারা যাবে,

আর আমেরিকা, ইউরোপে খাবার নষ্ট হবে,

এ কি হতে পারে?

অবশ্যই এ হতে পারে না, কিন্তু হচ্ছে।

সভ্যতা সংকটাপন্ন বলে হচ্ছে, এমন নয়,

সভ্যতা তার চূড়ান্ত পর্যায়ে এখনো পৌঁছায়নি।

বিশ্বব্যাংক আছে, জাতিসংঘ আছে,

সমাধান করতে চাইলে সমাধান আছে।

তবে প্রত্যেকটি দেশ যদি অভ্যন্তরীণ

আইন প্রণয়নে শতভাগ স্বাধীন থাকে

তাহলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব কঠিন হবে।

সবাইকে একমতে আনা কি সম্ভব?

তা সম্ভব না হলেও কিছু ক্ষেত্রে

সবদেশ একমত হতে হবে।

রাষ্ট্র মানে মানুষের মৌলিক চাহিদার জায়গায় কাজ করা,

আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখা, এর বেশি কিছু তো নয়,

এর বেশি দায়িত্ব রাষ্ট্রের থাকা উচিৎ নয়।

যেমন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একটা

ঐকমত্য দরকার।

রাজনীতি এবং সমাজনীতিতে কিছু

হেরফের থাকতে পারে, তবে

অর্থনীতি পুরো পৃথিবীর একই

ব্যবস্থায় থাকা উচিৎ।

উদ্বৃত্ত সম্পদের একটা অংশ বিশ্বব্যাংকে থাকবে,

প্রয়োজনে সেখান থেকে তুলে নিতে হবে।

বিশ্বব্যাংক ক্ষুধা-দারিদ্র দূর করার জন্য

স্বাধীন এবং কার্যকরভাবে অর্থ ব্যয় করবে।

সমস্যা নির্ধারণ হবে গবেষণার ভিত্তিতে।

তুমি কি এসব প্রস্তাব করছ?

এর বেশি সামার্থ কবিদের নেই।

তবে ঠিক প্রস্তাবও নয়, আক্ষেপ;

বলছি, এটা হতে পারে না।

একই পৃথিবীতে, যখন জানছি

কেউ অভুক্ত আছে, কোনো শিশু

বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে

তখন আরেকটি দেশে বিলাসিতা চলতে

পারে না। এটা অন্যায়।

সম্পদ যেমন ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রেরও নয়।

উন্নত দেশের অনেক ‘উন্নতি’ দেখলে

গা শিউরে ওঠে, ঘৃণা লাগে।

আমার অর্জন তোমাকে দিব কেন?

তা তুমি দিবে না, কিন্তু তুমি কতটুকু

কীভাবে অর্জন করতে পারো তার

একটা প্রাকৃতির সীমারেখা নিশ্চয়ই আছে।

তোমার অর্জন তুমি আমায় দিবে না,

তাই বলে তোমার উপার্জিত সম্পদ দিয়ে

তুমি যাচ্ছেতাই করতে পারো না,

যাচ্ছেতাই করার সুযোগ ব্যক্তির থাকা উচিৎ নয়।

চাইলেই ‍তুমি দুইশো বিঘা জমি কিনে

একটা কিছু শুরু করে দিতে পারো না।

এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ হস্তক্ষেপ থাকা উচিৎ।

তবে রাষ্ট্র হওয়া উচিৎ পৃথিবীর একটা ইউনিট।

অান্তর্জাতিকতার অংশবিশেষ,

জাতীয়তাবাদ বর্জন করা উচিৎ।

ব্যক্তির উপর হস্তক্ষেপ

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই হওয়া উচিৎ।

তাছাড়া সুযোগ সবার সামনে সমানভাবে আসে না।

ধরো, পুকুরে খাবার দেওয়া হল,

খাবার সব মাছের সমান প্রাপ্য,

তাই বলে কি সবাই সমান পায়?

হয়ত কোনো একটি মাছ এক প্রান্তে ছিল

সেটি খাবার খাওয়ার সুযোগই পেল না,

কখন খাবার দেয়া হয়েছে মাছটি

তা জানলও না, না খেয়ে মারা গেল।

মাছেরা বুঝবে না, মৃত মাছটির জন্য

দরদী হবে না, পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে না।

সেই বৃদ্ধিবৃত্তি তাদের নেই।

তাই বলে বুদ্ধি এবং হৃদয়বৃত্তিতে শ্রেষ্ঠ

মানুষ কেন প্রান্তীক মানুষটাকে টেনে তুলবে না?

তুমি দায় নিতে বলছ, কিন্তু নিজ সিদ্ধান্তে

যে পতিত হয়েছে সে দায় আমি কেন নেব?

একজনের সিদ্ধান্তের দায় আরেকজনে নেবে কেন?

সিদ্ধান্ত বলতে চাকরি-ব্যবসা

বিয়ে, বাচ্চা নেওয়া ইত্যাদি

যে বিষয়গুলো জীবনকে খুব বেশি প্রভাবিত করে,

এর বাইরেও অনেক কিছু আছে-

অনাচার আছে, অন্যায় আছে, অলসতা আছে।

ব্যর্থতা, প্রান্তিকতা মানেই ভুলের ফলাফল নয়,

আবার সফলতা মানেই সব সঠিক হয়েছে এমন নয়।

অনেক জটিল সমীকরণ রয়েছে এর মধ্যে।

আসল কথা হচ্ছে, তুমি সমষ্টিতে বিশ্বাস করলে

ব্যক্তির অজ্ঞতা বলে কিছু নেই,

ব্যক্তির ভুল সিদ্ধান্ত বলে কিছু নেই।

দায় নিতে হবে সকলে একসাথে।

“সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট”

থিওরিটা তুমি কীভাবে দেখ?

এটা সেইসব প্রাণীদের জন্য

যারা প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ

করার সামার্থ রাখে না।

মানুষের বেলায় এ থিওরি খাঁটে না।

মানবসমাজ প্রাকৃতিক নিয়মে চলছে না,

‘দ্যা ফিটেস্ট’ রা সমাজে টিকে থাকছে

উন্নতি করছে, এ ধারণা শুধু ভুল নয়

সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য হুমকিও।

মানুষেরে ক্ষেত্রেও তো এরকম কোনো

থিওরি দরকার, নাকি?

দরকার নেই, মানুষের ক্ষেত্রে

সুযোগ ও সাহায্য প্রাপ্তির বিষয় আছে,

অপরাধ-অন্যায় তো আছেই।

আরো অনেক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কাজ

করে পরোক্ষাভাবে মানুষের সমাজে,

তাই কোনো একক থিওরি এক্ষেত্রে অসম্ভব।

থিওরি অনেক আছে, কিন্তু কোনোটিই

খুব বেশি কার্যকর নয়।

হৃদয়বৃত্তির চেয়ে, ভালবাসার চেয়ে

কার্যকর থিওরি মানুষের জন্য নেই।

ভালবাসার চর্চা করতে হবে,

সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার

কোনো বিকল্প নেই,

এটাই সামষ্টিক সৌন্দর্যের একমাত্র উপায়।

ভূখণ্ডগত সমস্যা

এবং স্বাধীনতার প্রশ্নের সমাধান হবে কীভাবে?

স্বাধীনতা থেকেও কি সম্পদ বণ্টনের স্থায়ী সমস্যা

সৃষ্টি হয়ে থাকছে না?

জনসংখ্যা কৃত্রিম উপায়ে রোধ করতে হবে

সেটি তো খুব বেশি আগের কথা নয়,

তার আগে থেকেই তো দেশ স্বাধীন হতে

শুরু করেছে, তাহলে বণ্টনের প্রশ্ন

কীভাবে মীমাংসা হতে পারে?

একদেশের সম্পদ তো আরেক দেশ

পেতে পারে না। পারে কি?

পারতে হবে, এখানেই বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রশ্ন।

সেই একই প্রশ্ন এখানেও আসতে পারে,

উন্নত দেশ বলতে পারে

যে তোমার অজ্ঞতার দায় আমি কেন নেব?

এক পৃথিবী, একই মানুষ, দায় তো

নিতেই হবে, এই দায় নেয়ার মানসিকতাই

শুধু পারে পৃথিবীটাকে একত্র করতে।

ভূখণ্ড স্বাধীন করা বস্তুত আর প্রয়োজনীয় নয়,

মানুষকে শৃঙ্খলমুক্ত করা হচ্ছে আসল কথা।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী

করতে হবে। জাতিসংঘের ভূমিকা বাড়াতে হবে,

জাতিসংঘের ক্ষমতা থাকা উচিৎ

যেকোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার।

তার আগে জাতিসংঘ হতে হবে

নিরপেক্ষ এবং গতিশীল।

প্রত্যেক দেশ তার জিডিপি’র অনুপাতে

প্রতি অর্থবছরে জাতিসংঘে চাঁদা দেবে,

এরকম নিয়ম কার্যকর থাকা খুব জরুরী।

জাতিসংঘের প্রত্যেকটি অঙ্গসংঘটন আরো

বেশি শক্তিশালী হলে দেশগুলো ইচ্ছেমত

চলতে পারবে না। একই পৃথিবীতে

চূড়ান্ত বিচারে কোনো দেশ অন্তরীণ,

অভ্যন্তরীন এবং একাকী হতে পারে না।

তুমি জনসংখ্যা সমস্যার কথা বলছিলে?

হ্যাঁ, এটা অনেক বড় সমস্যা।

পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা এখনো ধারণ ক্ষমতার

অতিরিক্ত কিনা সেটি বলা দুঃসাধ্য,

কিন্তু দেশগুলো ভারসাম্যে নেই।

বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক,

কোনোভাবেই এত কম জায়গায় এত বেশি

জনসংখ্যা সুখে-শান্তিতে বসবাস করা সম্ভব নয়।

কয়েকটি নগররাষ্ট্রের কথা বাদ দিলে

পৃথিবীতে বাংলাদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে

সবচেয়ে বেশি লোক বাস করে।

এত মানুষকে বিদ্যমান সম্পদ দিয়ে

সুন্দর ব্যবস্থাপনায় রাখা অসম্ভব।

বিদেশে গিয়ে তারা উপার্জন করলে কি

সমস্যার সমাধান হচ্ছে না?

মোটেই হচ্ছে না, বিদেশে গিয়ে তারা কাজ করছে,

এটা গ্রাম থেকে ঢাকায় এস কাজ করার মতই,

বরং তার থেকে নিচুতর, যেহেতু

নাগরীক সুবিধা সেখানে তাদের থাকে না।

বিদেশে কাজ করে ব্যক্তির সাময়িক ক্ষুধা মেটে,

দীর্ঘমেয়াদে মানুষের ভালো কিছু হয় না।

এটা তো আসলে আধুনিক দাস-প্রথারই নামান্তর।

দাসপ্রথা উৎসাহিত করা যাবে না।

জনসংখ্যা ভারসাম্যে না আনতে পারলে

জীবনমান ভারসাম্যে আনতে না পারলে

দেশে দেশে প্রাচীর থেকেই যাবে।

প্রাচীর উঠাতে হবে,

মানুষের এক দেশ স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে

আরেক দেশে বসবাসের সুযোগ থাকতে হবে।

তার আগে একটা নিয়ম আন্তর্জাতিকভাবে করা

খুব জরুরী। জাতিসংঘ এটা করতে পারে।

পৃথিবীতে কারোরই একটার বেশি

সন্তান থাকার অধিকার থাকা উচিৎ নয়,

তুমি একজন মানুষ একজনই তুমি

পৃথিবীতে রেখে যেত পারো,

এটাই প্রাকৃতির অধিকার।

একজন মানুষ একজন রেখে যাবে।

তাহলে পৃথিবীর জনসংখ্যা আর বাড়বে না।

মানুষ যেহেতু প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করে বাঁচে

তাই মানুষের সংখ্যা এভাবে বাড়তে থাকলে

পৃথিবীতে প্রাকৃতির বিপর্যয় ঘটবে,

ঘটছেও, এর মাত্রা বাড়তে থাকবে;

অন্য প্রজাতিগুলো ধারাবাহিকভাবে

বিলুপ্ত হতে থাকবে।

পৃথিবীতে প্রজাতি টিকয়ে রাখার স্বার্থেই

মানুষের সংখ্যা প্রকৃতির সাথে

ভারসাম্যে রাখতে হবে। যদিও পৃথিবী

টিকবে কিনা সে প্রশ্ন আছে।

#এর পরের পর্ব যৌনতা বিষয়ে।