একজন মানুষ যতই উন্নত চিন্তা কিংবা উন্নত কাজ করুক না কেন, তাকে কোনো না কোনো স্থানীয় এলাকায় বসবাস করতে হয়। তাকে চলাচলের জন্য ফুটপথ, বেড়ানোর জন্য পার্ক, প্রার্থনার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সন্তানদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শপিং করার জন্য মার্কেট ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়।
অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের সারাদিনের প্রায় ৯৫ ভাগ কাজ থাকে স্থানীয়তে। সেজন্য বর্তমানে “Think globally, Act locally” শ্লোগানটি বহুল প্রচলিত। এদেশের জনগণ স্থানীয়তাকে আত্মীয়তার মত দেখে থাকে। মনিষীরা রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বহু আগেই বলেছেন- “জাতীয় রাজনীতিতে জায়গা না পাওয়া গেলে স্থানীয়তে কাজ করা সমুচিত”।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই। সেখানকার বামফ্রন্ট সরকার প্রায় ৩৬ বছর ক্ষমতায় ছিলো শুধুমাত্র তৃণমূলে সমর্থক থাকার কারণে। ভবিষ্যতে যদি তারা আবারও ক্ষমতায় যায় সেটাও তৃণমূলের কারণেই সম্ভব হবে (যদিও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে–তারা জাতীয় রাজনীতি দখলের উদ্দেশ্যে ‘স্থানীয়’ কে কৌশল হিসেবে নিয়েছিল)।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেছেন, “স্থানীয়তাকে অস্বীকার করে পূর্ণ নাগরিক হওয়া যায় না।” এদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। এখানে একটি লিখিত সংবিধান আছে। আছে একটি সরকার ব্যবস্থাও। কিন্তু সরকার ব্যবস্থা সংস্কার ও কার্যকর করার বদলে এদেশের রাজনীতিবিদরা তুচ্ছ বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকেন। ফলে একজন চায়ের দোকানদার কিংবা মুদি ব্যবসায়ীও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে মশগুল থাকতে ভালোবাসেন। অথচ তাদের স্থানীয় সমস্যা নিয়ে সরব থাকার কথা।
বলা যায়, স্থানীয় সরকারগুলো অকার্যকর থাকায় জনগণ স্থানীয় কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারছে না এবং একই কারণে তারা ‘নাগরিক’ (Civic-জ্ঞানসম্পন্ন) শ্রেণীতে রূপান্তরিত হতে পারছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচীর মধ্যে জাতীয় সমস্যার কথা থাকে বেশি। তারা ভুলে যান যে, স্থানীয় কাজগুলোর সমষ্টিই ‘জাতীয় কাজ’।
বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে যে যত বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশারদ, দলে তার কদর তত বেশি। অথচ তাঁরা দীর্ঘ ৭৫/৮০ বছরেও স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কোথাও জনভিত্তি অর্জন করতে পারেননি। প্রসঙ্গক্রমে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের কেউ কেউ বলেন, “পরকাল আছে কি নেই তা নিয়ে চিন্তা করা পণ্ডশ্রমের সামিল। যদি থাকে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই, না থাকলেও সমস্যা নেই। যেহেতু আমরা ইহকালে সুকর্মে নিয়োজিত আছি, যদি পরকাল থাকে তবে স্বর্গ প্রাপ্তি নিশ্চিত। আর যদি না থাকে, তাহলে ইহলোক তো সুখের হলো।”
একইভাবে বামপন্থী রাজনীতিকরা যদি স্থানীয় কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন তাহলে এতদিনে স্থানীয়তে তাদের জনভিত্তি গড়ে উঠত। পাশাপাশি জনগণও উপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদেরকে সরকারের অংশ মনে করত। আবার এ প্রসঙ্গে নারায়নগঞ্জের সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভির নামও উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর সুনাম ও দক্ষতা দেখে অনেকে তাঁকে জাতীয় রাজনীতিতে নামার জন্য অনুরোধ করেছেন। কেউ কেউ তাঁর নেতৃত্বে একটি নতুন দল গড়ে তুলতেও আহবান করেছেন। সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “এই মুহুর্তে তিনি জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ভাবছেন না। স্থানীয় উন্নয়নে তিনি বেশি মনোযোগী হতে চান।”
অর্থাৎ স্থানীয় উন্নয়নে মনোনিবেশ করেও জাতীয় পর্যায়ের নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব–এটা তিনি প্রমাণ করেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রকৃত কোনো বিরোধী দল নেই । কিন্তু সচেতন জনগোষ্টি আশা করছে–আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে এমন একটি দল গড়ে উঠুক যে দলটি মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের পক্ষে ভুমিকা রাখবে। স্বাভাবিক কারণেই এ বিষয়ে প্রগতিশীল দলগুলোর দায়বোধই বেশি থাকার কথা । দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এদেশের বামপন্থী দলগুলো দূরবর্তী সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে নিকটবর্তী সমস্যা থেকে দুরে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, “এদেশের সকল সমস্যার জন্য সাম্রাজ্যবাদ দায়ী। সাম্রাজ্যবাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত জনগণের মুক্তি আসবে না”।
তাহলে কি আমরা সাম্রাজ্যবাদের পতন পর্যন্ত অপেক্ষা করবো? প্রসঙ্গক্রমে আজ থেকে ৭/৮ বছর আগের ঈশ্বরদীর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। চাউল তৈরির মৌসুমে সেখানকার চাতাল শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে সভা শুরু করলে মালিকরা বাধা দেন। ফলে সভাটি বন্ধ হয়ে যায়। তাদের কেন্দ্রীয় নেতা এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে ঢাকা থেকে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় লেখেন, “সাম্রাজ্যবাদের দোসরদের আক্রমণে চাতাল শ্রমিকদের সভা পণ্ড।” লেখাটি পড়ে জনৈক মিল মালিক বলেন, “সারাজীবন বামদল করে হয়ে গেলাম সাম্রাজ্যবাদের দোসর!”
ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে তাদের এ জায়গায় চরম মিল রয়েছে। ইসলামী দলগুলোও মনে করে মুসলিম দেশগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহের পিছনে একমাত্র বিধর্মীরাই দায়ী। তারা মুসলমানদের অজ্ঞতা, মূর্খতা ও ধর্মান্ধতাকে কোনোক্রেমেই দায়ী করতে রাজী নন। তারা ভুলে যান যে, একটি মানুষ নিজ হাতে একটি বৃক্ষরোপণ করলে পক্ষান্তরে তিনি বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার পক্ষেই কাজ করলেন। একইভাবে যিনি নিজ হাতে ডাস্টবিনে ময়লা-আর্বজনা ফেলেন, নিজ হাতে বাড়ির সামনের ড্রেনটি পরিষ্কার রাখেন, তিনি শুধু নাগরিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিই নন, তিনি একজন ইহজাগতিক ব্যক্তিও। তাকে অতিসহজে কোনো জঙ্গীবাদী দলে কিংবা কোনো দেশবিরোধী কাজে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে না।
ইদানিং রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলা শুরু করেছেন–আগামী ১০/১২ বছরের মধ্যে রাজনীতিতে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। প্রধান দুই দলের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকবে। কাজেই ষাটোর্দ্ধ কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বে আশানুরুপ কোনো পরিবর্তনও আশা কারা যায় না। আমাদের যুব সমাজ নানা কারণে বিভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্থ। কতিপয় বামপন্থী রাজনীতিক শর্টকাট পথে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে বারবার বিভ্রান্ত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ দিকনির্দেশনাহীন পথে তাদেরকে আন্দোলনে নিয়ে এসে একই ক্ষতি করেছে।
এমতাবস্থায় যুব সমাজকে সময়োপযোগী একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ডিজাইনের আলোকে সংগঠিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা ‘স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা’ এবং ‘জাতীয় সরকার ব্যবস্থা’ উপযুক্ত ডিজাইন হতে পারে। সে লক্ষ্যে স্থানীয় সমস্যাগুলোকে ইস্যু করে একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ- ভিজিডি, ভিজিএফ, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, কর্মসূজন কর্মসূচী, কাবিখা, টিআর ইত্যাদি কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা ও দূর্নীতিমুক্ত করার দাবী নিয়ে আন্দোলন শুরু করা সম্ভব হলে ব্যাপক জনগোষ্ঠি সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মোশাররফ হোসেন মুসা
লেখক: গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।