১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে নজিরবিহীন গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে। গণহত্যা ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পরবর্তী নয় মাসে সমগ্র বাংলাদেশে অব্যাহত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কিংবা আরো বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজারের অধিক বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আফসোসের বিষয় স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই বধ্যভূমিগুলো অরক্ষিত রয়ে গেছে। অরক্ষিত উল্লেখযোগ্য বধ্যভূমিগুলো নিয়ে এই ধারাবাহিক রচনা।
ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও পাকিস্তানের বাঙালিরা বরাবরই বৈষম্যের শিকার ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার গোপন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন করে তারা বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা শুরু করে ২৫ মার্চ। অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে একের পর এক শহরগুলো দখল করতে থাকে। রাজধানী ও বৃহৎ সেনাছাউনিগুলো থেকে ক্রমশ তারা শহর থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরে তাদের অবস্থান গড়ে তুলতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় এক মাস পর স্থানীয়ভাবে সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে ২১ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী স্থল ও নদীপথে ফরিদপুর শহর আক্রমণ করে শহর ও আশপাশের এলাকা দখল করে নেয়।
ঢাকা থেকে আসার সম্ভাব্য পথ গোয়ালন্দ ও নাড়ারটেক চরে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান স্থাপন করেন। গানবোটে করে পাকিস্তানি সৈন্যদের ফরিদপুর শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার তথ্য মুক্তিযোদ্ধারা আগেই পেয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নাড়ারটেকের পথে না এসে নদীপথে গোয়ালন্দ অভিমুখে চলে যায়। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভাবছিলেন যে, ফরিদপুর আক্রমণ হয়তো গোয়ালন্দের দিক থেকেই হবে। ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সামান্য অস্ত্র নিয়ে গোয়ালন্দ বাজার থেকে অল্প দূরে নদীর পাড়ের শাহবাজ গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তোলেন।
২১ এপ্রিল সকাল ৬টার দিকে গানবোটে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোয়ালন্দের দিকে অগ্রসর হয়। ২ ঘণ্টার বিরামহীন যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিহিংসার শিকার হয় বাহাদুরপুর গ্রাম। তারা গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয় এবং ফরিদপুর শহর ও আশপাশের এলাকাগুলো দখল করে নেয়।
ফরিদপুর দখলের ১১ দিন পরে ১৯৭১ সালের ২রা মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল ফরিদপুর শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকার দিকের রাস্তার গোপালপুর ইউনিয়নের ঈশান গোপালপুর গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। উল্লেখ্য যে, জনদরদি ও দানবীর জমিদার ঈশান সরকারের নামে ঈশান গোপালপুর গ্রামটির নামকরণ হয়েছিল। তিনি এলাকায় খুবই জনপ্রিয় ছিলেন এবং সংস্কৃতিমনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। ঈশান সরকারের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে গ্রামবাসীরা নিজ উদ্যোগে গ্রামটির নামকরণ করেন ঈশান গোপালপুর। তার ছেলে ইন্দ্রভ‚ষণ সরকার ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ আমলে তিনি ইবহমধষ খবমরংষধঃরাব অংংবসনষু-এর সদস্য (এমএলএ) ছিলেন। তা ছাড়াও জমিদারের ভ্রাতুষ্পুত্র ড. সুবোধ সরকার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ব্যারাকের কর্মকাণ্ডের সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০১ সালের পরে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক অনুশীলন দলের সদস্য ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ শাসনামলে ঈশান গোপালপুর ছিল স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নিরাপদ আবাসস্থল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ফরিদপুর শহর থেকে প্রায় ১০টি বিপন্ন হিন্দু পরিবার ঈশান গোপালপুরে আশ্রয় নেয়। ফরিদপুর পতনের পর গ্রামের রাজনীতি সচেতন ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন যে, তাদের ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
ঈশান গোপালপুর গ্রামের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দোসরদের নজর ছিল। তারা ফরিদপুরে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনাছাউনিতে তথ্য প্রদান করে যে, ঈশান গোপালপুর গ্রামের স্বাধীনতাকামী জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন এবং এখানকার পাকিস্তানবিরোধী জনগণ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা হিন্দু পরিবারকে আশ্রয় দিচ্ছেন। তাই তাদের আক্রমণ করে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার জন্য এখনই উপযুক্ত সময় যেন গ্রামবাসীরা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা না করতে পারেন।
২ মে (১৩৭৮ সনের ১৯ বৈশাখ), রবিবার। প্রত্যুষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল পুরো গ্রামটিকে ঘেরাও করে। বড় দলটির মূল লক্ষ্য ছিল জমিদার ঈশান সরকারের পরিবার ও আশ্রয় নেয়া ১০টি হিন্দু পরিবারের প্রায় ৬০ জন মানুষ। তারা হিন্দু পরিবারগুলোর পুরুষদের টানাহ্যাঁচড়া করে সেই বাড়ির পশ্চিম দিকের একতলা একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্য দলগুলোও গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষদের ধরে পুরনো জমিদার বাড়িতে এনে জড়ো করতে থাকে। এই বাড়িটিও ছিল ঈশান সরকারের। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক তখন সন্ত্রস্ত মানুষগুলোর উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে থাকে যে, তোমাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। ঘরের মধ্যে বন্দিদের দুহাত পিছনে বেঁধে ২ জন করে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করতে থাকে নিষ্ঠুর পাকিস্তানি সৈন্যরা। এভাবে মোট ২৮ জনকে হত্যা করে তাদের লাশ জমিদার বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের আঙিনার পাশের নিচু জায়গাতে ফেলে রাখা হয়। যুদ্ধ না করেও নিরীহ মানুষগুলো শহীদ হলেন। মৃত্যুর আগে তারা জানতেও পারেননি কী ছিল তাদের অপরাধ আর কেনই বা তাদের হত্যা করা হয়!
ইতোমধ্যে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পরই পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রাম ত্যাগ করে। শহীদ পরিবারের নারীরা শোকে আর্তনাদ করতে থাকেন। বৃষ্টির মধ্যে তারা এতগুলো মৃতদেহ নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় তাদের দাহ করবেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রাম ত্যাগ করার পরে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন একই গ্রামের ইউনুস মোল্লা, জেনু মোল্লা, মনির মৃধা, জয়নাল মৃধা, জসিম মোল্লা, কসিম উদ্দিন মোল্লা, আহম্মদ শেখ, রুস্তম শেখ, আবেদ শেখ ও আরো অনেকে। তারাও বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে, এতগ্রলো লাশ নিয়ে কী করবেন এখন; কিছুক্ষণ পরেই রাত নেমে আসবে; হয়তো শিয়াল-কুকুরে মৃতদেহগুলোর ওপর আক্রমণ করবে। যা হোক, সবাই মিলে মৃতদেহগুলো পাহারা দিয়ে কোনো মতে রাতটা পার করলেন। সকাল হতেই তারা ঘটনাস্থলের কাছে একটি গণকবর খুঁড়ে তাদের সেখানে সমাহিত করেন। ঈশান গোপালপুরের এই ঘটনাই ছিল ফরিদপুরের প্রথম বৃহৎ গণহত্যা।
এই ঘটনার পর সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীদের অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপত্তার জন্য এলাকা ত্যাগ করেন। স্থানান্তরের সময় অনেকেই আবার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারান।
১৯৭১ সালের ২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যার শিকার শহীদদের নাম নিম্ন উল্লেখ করা হলো-
শহীদ আশুতোষ সরকার, শহীদ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, শহীদ গৌর গোপাল ঘোষ, শহীদ সমরেন্দ্র নাথ ঘোষ, শহীদ বাদল সরকার, শহীদ বাদল গোস্বামী, শহীদ যাদব চন্দ্র বিশ্বাস, শহীদ দয়াল চন্দ্র বিশ্বাস, শহীদ মন্টু চন্দ্র দাশ, শহীদ দুঃখীরাম দাশ, শহীদ মণীন্দ্রনাথ সিকদার, শহীদ সন্তোষ চন্দ্র দাশ-ঈশান গোপালপুর; শহীদ তারকেশ্বর গাঙ্গুলি, শহীদ পার্থসারথি গাক্সগুলি, শহীদ অশ্রু গাঙ্গুলি- গোয়ালচামট; শহীদ হরিদাস সাহা, শহীদ উমেশ চন্দ্র সরকার, শহীদ গণেশ চন্দ্র সাহা, শহীদ মুকুন্দ বিশ্বাস, শহীদ বটা চন্দ্র বিশ্বাস, শহীদ কালাচাঁদ বৈরাগী- শোভারামপুর; শহীদ স্বদেশ সাহা- রাজবাড়ী; শহীদ বিমল চন্দ্র সাহা, চাঁদপুর; শহীদ বিষ্ণু ঠাকুর, জানা যায়নি।
সরকারি উদ্যোগে ঈশান গোপালপুর গণকবর সংরক্ষণের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। প্রতি বছর ২ মে কেবল শহীদ পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসীরা গণকবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিনটিকে স্মরণ করেন। উল্লেখ্য, স্থানীয় গ্রামবাসী, শহীদ পরিবারের সদস্য ও শহরের সুশীল সমাজের প্রচেষ্টায় ২০১০ সালের ২ মে (১৪১৭ সনের ১৮ বৈশাখ) নির্মিত হয়েছে স্মৃতিফলক ‘ঈশান গোপালপুর গণসমাধি’। ৪ জন বহিরাগতের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বলে স্মৃতিফলকে ২৪ জন শহীদের নাম লিপিবদ্ধ আছে।
লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির
বীরপ্রতীক, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত